ছাত্রদের মোমবাতি মিছিল। বৃহস্পতিবার চণ্ডীগড়ে। ছবি: রয়টার্স।
অভিযান চুকেছে। তবু বিড়ম্বনার শেষ নেই পঠানকোট ঘিরে।
বায়ুসেনা ঘাঁটিতে জঙ্গিদের মোকাবিলার নেতৃত্ব সেনা দেবে না এনএসজি, অভিযান চলাকালীনই তা নিয়ে জারি ছিল সমান্তরাল টানাপড়েন। এ বার বিতর্কের পারদ চড়ল সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)-কে ঘিরে। বিএসএফের দাবি, পঞ্জাব লাগোয়া পাক-সীমান্তে তাদের পাহারায় কোনও ত্রুটি ছিল না। বরং সেনার নজরদারির আওতায় থাকা কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে জঙ্গিরা এসেছিল কি না, সেই প্রশ্ন তুলেছে বিএসএফ।
এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনীর এই যুক্তি মানতে নারাজ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। গোয়েন্দা সূত্রের দাবি, জঙ্গিরা যে পাকিস্তানের শকরগড় হয়ে পঞ্জাবের বামিয়াল এলাকার সীমান্ত পেরিয়েই পঠানকোটে ঢুকেছিল, এমন মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
গত কাল পঞ্জাবে গিয়েছিলেন বিএসএফের ডিজি ডি কে পাঠক। প্রায় ২০ কিলোমিটার সীমান্ত ঘুরে দেখেন তিনি। সূত্রের খবর, ডিজি-র সফরের পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে বিএসএফ যে রিপোর্ট জমা দেয় তাতে বলা হয়েছে, গত ক’দিনের মধ্যে পঞ্জাব সীমান্তে কোনও অনুপ্রবেশ হয়নি। কাঁটাতারের বেড়া অক্ষত আছে। যেখানে নদীকে মাঝখানে রেখে সীমান্ত নির্ধারিত হয়েছে, সেই এলাকার সন্ধানী ক্যামেরা ও যন্ত্রপাতিতে গত ১৫ দিনে কোনও সন্দেহজনক গতিবিধি ধরা পড়েনি। এই যুক্তি তুলে ধরেই বিএসএফের দাবি, তাদের তরফে কোনও গাফিলতি হয়নি। হতে পারে, নিয়ন্ত্রণরেখা বা মাদক পাচারের জন্য খোঁড়া কোনও সুড়ঙ্গ বেয়ে এসেছিল জঙ্গিরা। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তাদের একাংশের অভিযোগ, গাফিলতির দায় এড়াচ্ছে সীমান্তরক্ষী বাহিনী।
এই টানাপড়েনের আবহেই জঙ্গিদের পাক-যোগ নিয়ে বেশ কিছু তথ্য ইসলামাবাদের হাতে তুলে দিয়েছে দিল্লি। প্রমাণ সহযোগে তাতে বলা হয়েছে, পঠানকোট হামলার ছক কষা হয়েছিল পাকিস্তানের মারকাজ নামে একটি জায়গায়। এবং গোটা পরিকল্পনার পাণ্ডা হল— জইশ-ই-মহম্মদ প্রধান মৌলানা মাসুদ আজহার। সেই জঙ্গি নেতা, ১৯৯৯ সালে কন্দহরে বিমান ছিনতাইয়ের সময় যাকে জেল থেকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল দিল্লি। ২০০১ সালে সংসদে হামলারও অন্যতম পাণ্ডা সে।
গোয়েন্দা-সূত্রের দাবি, সংসদ-হামলার অন্যতম চক্রী আফজল গুরুর ২০১৩ সালে ফাঁসি হওয়ার পরেই নতুন করে ভারতে হামলার ছক কষতে শুরু করে জইশ। ফাঁসির বদলা নিতে তৈরি হয় ‘আফজল গুরু স্কোয়াড’। গত বছর নভেম্বরে জম্মু-কাশ্মীরের কুপওয়ারায় গোর্খা রাইফেলসের ক্যাম্পে হামলা চালায় এই স্কোয়াডের তিন জঙ্গি। ঠিক দশ দিনের মাথায় ফের হামলা। এ বার উরি এলাকায় একটি সেনা ছাউনিতে। জইশের এই স্কোয়াডই পঠানকোটে হামলা চালিয়েছে বলে গোয়েন্দারা প্রায় নিশ্চিত।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রের দাবি, মাসুদ আজহারের নির্দেশে গোটা অপারেশনটি চালনা করেছিল জইশের তিন শীর্ষ নেতা— আশফাক আহমেদ, হাফিজ আব্দুল শকুর এবং কাশিম খান। বায়ুসেনা ঘাঁটিতে হামলা শুরুর আগে এই তিন ‘হ্যান্ডলারের’ সঙ্গেই ফোনে তিন বার কথা বলেছিল জঙ্গিরা। গুরুদাসপুরের এসপি সলবিন্দ্র সিংহের মোবাইল থেকেই সেই ফোনগুলি করা হয়। আজ সলবিন্দ্রকে জেরা করেছে এনআইএ।
সূত্রের বক্তব্য, পঠানকোট হামলার জন্য জঙ্গিদের বাছাই করা, তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া থেকে শুরু করে আগাগোড়া ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিল এই তিন জইশ শীর্ষ নেতা। জঙ্গিরা কোন পথে ভারতে ঢুকবে, তা চূড়ান্ত করেছিল এরাই। সেই মতো পাকিস্তান থেকে ফোন করে পঠানকোট এলাকায় নির্দিষ্ট দিন ও সময়ে একটি গাড়ি ভাড়া করে রাখা হয়েছিল। ভারতে ঢুকে জঙ্গিরা কাদের কাছ থেকে স্থানীয় সাহায্য পাবে, অস্ত্র-গোলাবারুদ কোথা থেকে জোগাড় হবে— সে সবেরই ব্যবস্থা করেছিল ওই তিন জন। আর তাই মাসুদ আজহারের পাশাপাশি ওই তিন জঙ্গি নেতার বিরুদ্ধেও দ্রুত ব্যবস্থা নিতে ইসলামাবাদকে অনুরোধ করেছে সাউথ ব্লক। পাকিস্তানকে দেওয়া হয়েছে তাদের ফোন নম্বর।
পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ইতিমধ্যেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ফোন করে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছেন। মুম্বই হামলার মতো এ ক্ষেত্রেও পাকিস্তান দাবি করেছে, ‘নন-স্টেট অ্যাক্টর’রাই এই কাণ্ড ঘটিয়েছে। কিন্তু জঙ্গিরা যে ভাবে কম্যান্ডোদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাড়ে তিন দিন ধরে লড়ে গিয়েছে, তাতে সেনা থেকে গোয়েন্দা— সব শিবিরই মনে করছে, উন্নত মানের প্রশিক্ষণ ছাড়া এই লড়াই অসম্ভব। আর সেই প্রশিক্ষণ সেনাই দিতে পারে।
ভারতীয় গোয়েন্দাদের সন্দেহ, পাকিস্তানের কোনও বিমানঘাঁটিতে প্রশিক্ষণ পেয়েছিল জঙ্গিরা। এরা হয়তো বিমান চালাতে জানত না। কিন্তু কোনও বিমানঘাঁটির কৌশলগত যাবতীয় সম্পদ কী ভাবে নষ্ট করতে হয়, সেই প্রশিক্ষণ তাদের ছিল। যে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক তারা এনেছিল, তা দেখে এমনই মনে হচ্ছে।
তদন্তে উঠে আসছে অনেক কিছুই। কিন্তু থেকে থেকে মাথাচাড়া দিচ্ছে অস্বস্তি-কাঁটাও!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy