Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
National News

মেরুকরণ এ বারও ছিল উত্তরপ্রদেশে, কিন্তু অনেক সুক্ষ্ম ভাবে

রামজন্মভূমি নিয়ে হুঙ্কার ছিল না। নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের কণ্ঠস্বরে মেরুকরণের চেষ্টা খোলাখুলি অন্তত ছিল না। নির্বাচনী মরশুমে বড় কোনও সাম্প্রদায়িক উত্তজেনার সাক্ষীও হতে হয়নি উত্তরপ্রদেশকে।

ভোট ময়দানে যেমন ঘুরেছেন, তেমনই ঘুরেছেন মন্দিরে মন্দিরেও। —ফাইল চিত্র।

ভোট ময়দানে যেমন ঘুরেছেন, তেমনই ঘুরেছেন মন্দিরে মন্দিরেও। —ফাইল চিত্র।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১১ মার্চ ২০১৭ ১৯:১৭
Share: Save:

রামজন্মভূমি নিয়ে হুঙ্কার ছিল না। নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের কণ্ঠস্বরে মেরুকরণের চেষ্টা খোলাখুলি অন্তত ছিল না। নির্বাচনী মরশুমে বড় কোনও সাম্প্রদায়িক উত্তজেনার সাক্ষীও হতে হয়নি উত্তরপ্রদেশকে।

দেশের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্যে বিজেপির এই অভূতপূর্ব জয়কে তাই সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের জয় বলে সরাসরি আক্রমণ করতে পারছেন না বিরোধীরাও। অখিলেশ যাদব বলেছেন, ‘‘গণতন্ত্রের রায় মাথা পেতে নিচ্ছি।’’ রাহুল গাঁধী মোদীকে অভিনন্দন জানিয়েছে, তবে ফলাফলের ব্যাখ্যায় যাননি। এক মাত্র মায়াবতী এই পরাজয়কে পরাজয় হিসেবে মানতে নারাজ। কিন্তু তিনিও মেরুকরণের প্রসঙ্গ তোলেননি, ভোটযন্ত্রে কারচুপির অভিযোগ তুলেছেন। প্রশ্নটা উঠছে এখানেই। জাতপাতের রাজনীতি আর সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর পীঠস্থান যে উত্তরপ্রদেশ, সেখানে মূলত উচ্চবর্ণের দল হিসেবে পরিচিত বিজেপি ধর্মীয় মেরুকরণের রাস্তায় না হেঁটেও এই বিপুল জয় হাসিল করল কী ভাবে?

আসলে বিজেপি এ বার উত্তরপ্রদেশে ছাপিয়ে গিয়েছে সমস্ত সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংকে। বলছেন বিশ্লেষকরা। মুসলিম প্রধান আসনগুলিতে সপা-কংগ্রেসের জয় হওয়ার কথা ছিল। হয়নি। বিজেপি জিতেছে। দলিত প্রধান আসনগুলি বসপার চিরকালীন গড়। সেই সব এলাকাতেও বিজেপি জিতেছে। ব্রাহ্মণ, ঠাকুর-সহ উচ্চবর্ণের ভোট বেশি যে সব আসনে, সেই সব এলাকায় বিজেপির দাপটই বেশি। নিজেদের সে সব গড়ও বিজেপি সাফল্যের সঙ্গেই ধরে রেখেছে। হরিয়ানার বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে জাঠ সম্প্রদায়ের ক্ষোভ এ বার উত্তরপ্রদেশের ভোটে ছাপ ফেলবে বলে অনেকে মনে করেছিলেন। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের জাঠ প্রধান অঞ্চলে অজিত সিংহের দল আরএলডি এ বার ওই অঞ্চলে বিজেপিকে জোরদার ধাক্কা দেবে বলে কয়েকটি সমীক্ষার পূর্বাভাস ছিল। সে পূর্বাভাসও ভুল প্রমাণিত হয়েছে। জাঠ বলয়েও গেরুয়া ঝড়ের গতি একই রকম।

প্রায় সব অঞ্চলের মানুষকে নিজেদের ছাতার তলায় আনতে পেরে বিজেপি উচ্ছ্বসিত। ভোটের ফল কী হতে চলেছে, তা কিছুটা স্পষ্ট হতেই তাই উত্তরপ্রদেশ বিজেপির সভাপতি কেশবপ্রসাদ মৌর্যের মন্তব্য, ‘বিজেপি সর্বজন সমাজের দল’। কিন্তু উত্তরপ্রদেশে দীর্ঘকাল ধরে উচ্চবর্ণের দল হিসেবে পরিচিত বিজেপি রাতারাতি ‘সর্বজন সমাজ’-এর দল হয়ে উঠল কী করে, চর্চা এখন তা নিয়েই।

‘ফ্যাক্টর’ অনেকগুলো। বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাঁদের বাখ্যা জেনে নেওয়া যাক এক নজরে:

১. নোটবন্দির প্রভাব পড়েছে ভোটের ফলে। বিরোধী দলগুলি নোটবন্দি ইস্যুতে যতই হইচই করুক, সাধারণ মানুষের মধ্যে তার প্রভাব খুব বেশি ছিল না। বরং কালো টাকার বিরুদ্ধে সরকার কিছু একটা পদক্ষেপ করার চেষ্টা অন্তত করেছে, এমনই একটা বার্তা চারিয়ে গিয়েছিল তৃণমূল স্তরে। ফলে নোটবন্দির পর থেকে বিভিন্ন রাজ্যে হওয়া যাবতীয় নির্বাচনের ফলের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই উত্তরপ্রদেশেও জনমত থেকেছে মোদীর পক্ষে।

২. সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ইস্যু কাজে লেগেছে উত্তরপ্রদেশের ভোট ময়দানে। ভারত-পাক উত্তেজনার প্রেক্ষিতে জাতীয়তাবাদের হাওয়া সরকারের পক্ষেই ছিল। সার্জিক্যাল স্ট্রাইক সেই হাওয়াকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সরকারের পালের হাওয়া কাড়তে বিরোধীরা সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের সত্যতা নিয়ে যে ভাবে সন্দেহ প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন, তাতে সাধারণ জনতা খুশি হননি। বিরোধীদের মারাত্মক ক্ষতি হয়ে গিয়েছে।

৩. লোকসভা নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশের ৮০টি লোকসভা আসনের মধ্যে ৭৩টি এনডিএ পেয়েছিল। সেই ফলকে তুলে ধরে বিজেপি গোটা রাজ্যে জোর প্রচার শুরু করেছিল, বলেছিল, লখনউয়ের মসনদ হাসিল করা শুধু সময়ের অপেক্ষা। কেন্দ্রে বিজেপির সরকার থাকায় এবং প্রধানমন্ত্রী-সহ ডজনখানেক মন্ত্রী বার বার উত্তরপ্রদেশ সফর করায় বিজেপি উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতায় আসার আগেই জনমতের উপর নিজেদের শাসক সুলভ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছিল। সেই ভাবমূর্তির সুবাদে লোকসভা নির্বাচনে নিজেদের প্রাপ্ত ভোট এ বারও ধরে রাখতে বিজেপির সুবিধা হয়েছে। উল্টো দিকে বিজেপি-বিরোধী ভোট সপা-কংগ্রেস এবং বসপার মধ্যে আড়াআড়ি ভেঙেছে। ফলে বিপুল ব্যাবধানে এগিয়ে গিয়েছে বিজেপি।

মোদীর ব্যক্তিগত ক্যারিশ্মাও উত্তরপ্রদেশে বিজেপির বিপুল জয়ের অন্যতম কারণ। —ফাইল চিত্র।

৪. মুজফ্ফরনগরের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা, দাদরির ঘটনা, কৈরানার পরিস্থিতি নিয়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার চোরাস্রোত উত্তরপ্রদেশে ছিলই। তাকে কেন্দ্র করে হিন্দু ভোট একত্রিত হয়েছিল অনেকটাই। পূর্ব উত্তরপ্রদেশে শেষ দফার ভোটগ্রহণের আগে লখনউয়ের বুকে জঙ্গি বিরোধী অভিযান এবং ৯জন মুসলিম যুবকের বিরুদ্ধে আইএস-এর সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ ওঠায় সাম্প্রদায়িক হাওয়া কিছুটা হলেও তীব্র হয়েছিল।

৫. নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহের মতো শীর্ষ নেতারা নিজেদের ভাষণে খুব প্রকট সাম্প্রদায়িক হুঙ্কার না ছাড়লেও, মাঝারি এবং নীচের স্তরের বিজেপি নেতারা মেরুকরণের চেষ্টা কিন্তু চালিয়ে গিয়েছেন। নরেন্দ্র মোদী একবার বলেছেন, কোনও গ্রামে কবরস্থান তৈরি হলে, সরকারের উচিত সেখানে শ্মশানও তৈরি করে দেওয়া। সঙ্গে সঙ্গে সেই বার্তা বিজেপি নেতা-কর্মীদের মুখে মুখে ফিরতে শুরু করেছে। পাশাপাশি সাক্ষী মহারাজ, যোগী আদিত্যনাথ, বিনয় কাটিয়ার, সঙ্গীত সোমদের মতো কট্টরবাদী নেতারা প্রকাশ্যেই কট্টরবাদী ভাষণ দিয়েছেন বিভিন্ন সভায়। মেরুকরণের চেষ্টা এই ভাবে নরমে-গরমে চালিয়ে গিয়ে হিন্দু ভোটকে একত্রিত করতে বিজেপি নেতারা সক্ষম হয়েছেন অনেকটাই।

আরও পড়ুন: মোদী প্রতিষ্ঠা করলেন এই মুহূর্তে তাঁর কোনও বিকল্প নেই

৬. অখিলেশ যাদবের পাঁচ বছরের মুখ্যমন্ত্রিত্বে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে বলে সপা যতই দাবি করুক, সে উন্নয়ন ছিল মূলত লখনউ-কেন্দ্রিক, গ্রামীণ উত্তরপ্রদেশের চেহারা আমূল বদলে দিয়েছেন অখিলেশ, তেমন নয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বার বার উত্তরপ্রদেশ সফর করে রাজ্যের গ্রাম-গ্রামান্তরেও বিপুল উন্নয়নের স্বপ্ন দেখিয়েছেন।

৭. মায়াবতীকে বিকল্প হিসেবে আর মেনে নিতে চাননি মানুষ। শেষ বার ২০০৭ থেকে ২০১২ পর্যন্ত মায়াবতী উত্তরপ্রদেশে মুখ্যমন্ত্রিত্ব করেছেন। কিন্তু সেই পাঁচ বছরে নিজের ও দলিত আইকনদের মূর্তির পিছনে যে বিপুল ব্যয় হয়েছে, প্রকৃত উন্নয়ন তার ছিটেফোঁটাও হয়নি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে মায়াবতীর দিক থেকেও মুখ ফিরিয়েছেন মানুষ।

এতগুলি ফ্যাক্টরের সমাপতনেই উত্তরপ্রদেশে এই নজিরবিহীন সাফল্য বিজেপির। বলছে ওয়াকিবহাল মহল। তবে নরেন্দ্র মোদীর ব্যক্তিগত ক্যারিশ্মাও যে অত্যন্ত প্রভাব ফেলেছে উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে, তা নিয়েও বিশ্লেষকদের সংশয় নেই।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE