Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
National News

ছেলেমেয়ে, নাতিনাতনির নাম আছে, তালিকায় ঠাঁই মেলেনি ইলার

কাকলি তাঁর প্রয়াত স্বামীর ১৯৬০ সালের পাসপোর্ট দেখিয়ে বলেন, “নাগরিক পঞ্জির নিয়ম অনুসারেই এই নথি দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই নথিতে কোনও কাজ হয়নি।”

নাগরিকপঞ্জিতে নাম আছে কিনা, জানতে লাইন।

নাগরিকপঞ্জিতে নাম আছে কিনা, জানতে লাইন।

সিজার মণ্ডল
গুয়াহাটি শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০১৮ ০৭:৩০
Share: Save:

জলপাইগুড়ি থেকে বিয়ে হয়ে যখন গুয়াহাটির পাণ্ডু ঘাটের কাছে শ্বশুরবাড়ি এসেছিলেন, তখন ব্রহ্মপুত্রর বুকে কোনও সেতু ছিল না। বাড়ির পাশের ঘাট দিয়েই ভেসেলে চেপে পারাপার করতে হত মানুষ-গাড়ি-ঘোড়া সবই।

সালটা এখনও মনে আছে আশি বছরের ইলা ভৌমিকের, “১৯৫২। জলপাইগুড়ির দোমোহানি পলওয়েল স্কুলে পড়তাম। আমার দু’ক্লাস ওপরে পড়তেন সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। ক্লাস নাইনে উঠতেই বাবা বিয়ের ঠিক করলেন। সেই বছরেই বিয়ে। তারপর থেকে এখানে।”

সোমবার নাগরিক পঞ্জির চূড়ান্ত খসড়া তালিকা প্রকাশিত হওয়ার পর দেখা গেল ইলার নাম নেই। তাঁর সব ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনির নাম থাকলেও ইলাকেই নাগরিক হিসেবে মানতে নারাজ নাগরিক পঞ্জির আইন। কারণ, তিনি জলপাইগুড়ির বাসিন্দা হিসেবে কোনও প্রমাণ দিতে পারেননি। তিনি বলেন, “ছেলেকে পাঠিয়েছিলাম আমার স্কুলে। কিন্তু ১৯৬৮ সালের বন্যায় ভেসে গিয়েছিল স্কুল। সঙ্গে ভেসে যায় আমাদের সবার নথিও। তাই স্কুল কিছু দিতে পারেনি।”

মা ইলা ভৌমিকের সঙ্গে ছেলে উজ্জ্বল।

আরও পড়ুন: গুয়াহাটির হাজার হাজার বাঙালির চোখে নাগরিক-আশঙ্কা

ইলার মতোই হাল কলকাতার সুন্দরী মোহন অ্যাভিনিউয়ের বাসিন্দা কাকলি চৌধুরীর। কর্মসূত্রে তাঁর স্বামী দীপক এসেছিলেন গুয়াহাটিতে। তারপর এখানেই পাকাপাকি থেকে যান। কাকলি তাঁর প্রয়াত স্বামীর ১৯৬০ সালের পাসপোর্ট দেখিয়ে বলেন, “নাগরিক পঞ্জির নিয়ম অনুসারেই এই নথি দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই নথিতে কোনও কাজ হয়নি।” শুধু কাকলি নয়, তাঁর ছেলে-দেওরদেরও নাম নথিভুক্ত হয়নি এই তালিকায়। যেমন হয়নি আদতে উত্তরবঙ্গের ফালাকাটার বাসিন্দা সঙ্গীতা দে-র নাম। লালগণেশ এলাকার বাসিন্দা সঙ্গীতার মাসি শম্পা বর্ধনের বাপের বাড়ি ফালাকাটার কাছেই জটেশ্বরে। তাঁর স্বামী মানিক পাল এবং ছেলেমেয়েদের নাম নথিভুক্ত হলেও তিনি সরকারি ভাবে নাগরিক হতে পারেননি এনআরসি-র নিয়মের গেরোতে।

আরও পড়ুন: ‘শান্তি না গৃহযুদ্ধ’, কী চায় ওরা? সনিয়ার সঙ্গে দেখা করেই বিজেপিকে তোপ মমতার

এনআরসি-র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রথম খসড়া তালিকা থেকে যে প্রায় দেড় লাখ নাম চূড়ান্ত তালিকায় বাদ পড়েছে, তার মধ্য প্রায় ৪৯ হাজার জনই বিবাহিত মহিলা।

শহরাঞ্চলে অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত পরিবারেই বিবাহিত মহিলারা তাঁদের বাপেরবাড়ির পর্যাপ্ত নথি দিতে পারছেন না। সেখানে গ্রামাঞ্চলের হাল আরও খারাপ, বিশেষ করে সংখ্যালঘু পরিবারে। কারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁদের শিক্ষাগত কোনও নথি নেই, কারণ তাঁরা স্কুলে যাননি। জন্ম সার্টিফিকেটও নেই কারণ বাড়িতে জন্ম হয়েছে। ফলে হাজার হাজার পরিবারে ছেলেমেয়েরা নাগরিকত্বের প্রমাণ পেলেও মা থেকে যাচ্ছেন নাগরিকত্বহীন হয়ে।

হাড়োয়ার বাসিন্দা দিলীপ ঘোষ (ডান দিকে), এবং কোচবিহারের বাসিন্দা প্রতিমা সাহা।

২০০২ সালে বিয়ের পর কোচবিহার থেকে গুয়াহাটি আসা প্রতিমারও একই দশা। তিনি তাঁর স্কুলের সার্টিফিকেট থেকে শুরু করে বাবার জমিজমার কাগজ দিয়েছিলেন। তাতেও কোনও লাভ হয়নি। সন্দেহভাজনের তালিকাতেই থেকে গিয়েছেন তিনি। আর তার জন্য নিজের রাজ্য, অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গকেই দুষছেন প্রতিমার মতো অনেকেই।

আরও পড়ুন: অসম-মেঘালয় সীমান্তে মার খাচ্ছে বাঙালিরা, সংসদে সরব সুস্মিতা দেব

প্রতিমার অভিযোগ, পশ্চিমবঙ্গ থেকে এই নথি সংগ্রহের ক্ষেত্রে কোনও সহযোগিতা করা হচ্ছে না। একই অভিযোগের সুর উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়ার বাসিন্দা দিলীপ ঘোষের। হাড়োয়ার স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করেছিলেন ১৯৬৭ সালে। তারপর থেকেই গুয়াহাটিতে। সেই স্কুল সার্টিফিকেট থেকে শুরু করে পঞ্চায়েতের শংসাপত্র, সব জমা দিয়েও তাঁর নাম ওঠেনি।

তবে এই দায় নিজেদের কাঁধে রাখতে নারাজ অসমের এনআরসি কর্তৃপক্ষ। তাঁদের দাবি, এখানে জমা দেওয়া অন্য রাজ্যের বিভিন্ন শংসাপত্র যাচাই করে দেখার জন্য সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলিকে পাঠানো হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গেও পাঠানো হয়েছিল প্রায় এক লাখ কুড়ি হাজার নথি। তার মধ্যে ১৫ হাজারের বেশি যাচাই হয়ে আসেনি। সেই ক্ষেত্রে এনআরসি নথি যাচাই না করে কী ভাবে সেই নথিকে আসল বলে মেনে নেবে?

আর তাই এনআরসি নিয়ে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে তৃণমূল প্রতিনিধিদল বৃহস্পতি এবং শুক্রবার যখন অসমের মানুষের মুখোমুখি হবে, তখন এই প্রশ্নটা তাদের অস্বস্তির কারণ হতেই পারে।

ছবিগুলি তুলেছেন সিজার মণ্ডল।

অন্য বিষয়গুলি:

Assam NRC Tension List Draft
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE