তালিকা তৈরি হচ্ছে। ছবি রয়টার্স।
গুয়াহাটি শহরের নিতাই ঘোষ, দিলীপ ঘোষের সঙ্গে বরপেটার শেখ আজিমুদ্দিন বা বরাক উপত্যকার হাইলা কান্দির সইফুল আলি— এঁদের আপাত কোনও মিল নেই। কিন্তু নাগরিক পঞ্জি তাঁদের এক তালিকায় এনে দিয়েছে। এঁরা কেউই নিজেদের নাগরিক হিসাবে প্রমাণ করতে পারেননি।
তবে কী ভবিতব্য? এই প্রশ্নটাই ঘুরপাক খাচ্ছে অসমের বুকে সেই তালিকায় নাম না ওঠা কয়েক লাখ মানুষের মনে। তালিকায় নাম না থাকার অর্থ তাঁরা নাগরিকত্ব হারাবেন। তারপর? সেই উত্তরটা স্পষ্ট করে বলতে পারছেন না কেউ। অসমের শাসক দল বিজেপি হোক বা খোদ সরকার— কেউই এই প্রশ্নের কোনও স্পষ্ট উত্তর দিতে পারছেন না। আর সেখান থেকেই ক্রমাগত ছড়াচ্ছে বিভ্রান্তি। আর তার সঙ্গে গোটা রাজ্য জুড়ে উড়ে বেরাচ্ছে নানা গুজব।
আর তার মধ্যেই নাম না ওঠা মানুষরা অপেক্ষা করে আছেন ৭ অগস্টের জন্য। কারণ নাগরিক পঞ্জিকরণ সংস্থা জানিয়েছে, ওই দিন নাম যাদের তালিকায় নেই, তাঁদের জানিয়ে দেওয়া হবে কেন তাঁদের নাম নেই।
প্রতীক হাজেলা, অসম সরকারের মূখ্য সচিব এবং নাগরিক পঞ্জিকরনের দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি বুধবার রাতে বলেন, “৭ অগস্ট থেকে এনআরসির বিভিন্ন সেবা কেন্দ্র থেকে জানিয়ে দেওয়া হবে কেন নাম বাদ পড়ল।” সেই সঙ্গে তিনি বলেন ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ফের সময় দেওয়া হবে নাম তালিকাভুক্ত করার জন্য ফের আবেদন করার। সেই সঙ্গে তিনি জুড়ে দেন যে, ওই সময়ের মধ্যে যাদের নাম উঠেছে তাদের নাম নিয়েও যদি কোনও অভিযোগ থাকে, তা হলে সেটাও খতিয়ে দেখা হবে। অর্থাৎ যাদের নাম তালিকাভুক্ত হয়েছে তাঁরাও পুরোপুরি নিশ্চিত নন, যে চূড়ান্ত তালিকায় তাঁদের নাম থাকবেই।
আরও পড়ুন: গুয়াহাটির হাজার হাজার বাঙালির চোখে নাগরিক-আশঙ্কা
এই অনিশ্চয়তার মাঝেই আতঙ্ক আরও বাড়িয়েছে নির্বাচন কমিশনের বুধবারের ঘোষণা। গুয়াহাটি শহরের বুকে বাড়ি সুবিমল বিশ্বাসের। তিরিশ বছরের বেশি সময় তিনি একটি রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কের কর্মী ছিলেন। তাঁর নামও নেই এই তালিকায়। টেলিভিশনে তিনি খবর দেখতে গিয়ে জানতে পারেন নির্বাচন কমিশন জানিয়ে দিয়েছে— যাঁদের নাম এই তালিকায় থাকবে না, তাঁদের নাম এখনই বাদ যাবে না ভোটার তালিকা থেকে। কিন্তু চূড়ান্ত তালিকাতে নাম না থাকলে? পরবর্তীতে কী নাম থাকবে? সেটা জানেন না এঁরা কেউ।
উদ্বেগ কমবে কবে, চিন্তায়। ছবি: এএফপি
আর্থিক ভাবে যারা স্বচ্ছল, তাঁদের অনেকেরই যোগাযোগ রয়েছে কলকাতা বা শিলিগুড়িতে। বিপুল সরকার তাঁদেরই একজন। আদাবাড়ির এই ব্যাবসায়ী বলেন, “একান্তই যদি নাম না ওঠে, তা হলে বেঙ্গলে চলে যাব। শিলিগুড়িতে আমার ছোট শ্যালক থাকেন।”
আরও পড়ুন: ‘শান্তি না গৃহযুদ্ধ’, কী চায় ওরা? সনিয়ার সঙ্গে দেখা করেই বিজেপিকে তোপ মমতার
বিপুলের যেটা ভাবা সম্ভব, তা আদৌ ভাবতে পারছেন না কামাখ্যা কলোনিতে পরিচারিকার কাজ করা গীতা দেবনাথ। তাঁর ভাবনার স্রোত বরং বইছে অন্য খাতে। তিনি খুঁজছেন কোন মুরুব্বি ধরলে এই বার অন্তত নামটা উঠে যাবে।
এর মধ্যেই এনআরসিকে কেন্দ্র করে দিল্লির বুকে টানাপড়েন বা পড়শি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিবাদ— মানুষ নজর রাখছেন সব কিছুতেই। শহরের অনেকেই জানেন, বৃহস্পতিবার তৃণমূলের ছ’সদস্যের প্রতিনিধিদল প্রথমে শিলচরে যাবেন। তারপর গুয়াহাটি আসবেন তাঁরা।
যদিও তাতে তাঁরা কতটা ভরসা পাচ্ছেন তা নিয়ে সংশয় আছে। কারণ শহরের অনেক পুরনো বাঙালির বলেন, “মমতা এখানে রাজনীতি না করলেই ভাল।” তাঁরা আশির দশকের অসম আন্দেলনের উদাহরণ টেনেই বলেন, “আমরা যারা সংখ্যালঘু, তাঁদের সংখ্যাগুরুদের সাহায্য নিয়েই বাঁচতে হবে।”
এই চরম বিভ্রান্তির মাঝেই এনআরসি কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করেছে, চূড়ান্ত তালিকাতে নাম না থাকলেও ধরে নেওয়ার কোনও কারণ নেই যে তাঁদের ডিটেনসন ক্যাম্পে পাঠানো হবে।
এই ঘোষণা আদৌ স্বস্তি আনতে পারেনি মানুষের মনে। গোয়ালপাড়ার বাসিন্দা হাফিজুল আলি। তাঁর প্রশ্ন, “তা হলে সরকার কোটি কোটি টাকা খরচ করে একের পর এক ক্যাম্প তৈরি করছে কেন?”
এই অবিশ্বাসের আর অনিশ্চয়তার আবহর মধ্যেই অসমের কয়েক লাখ মানুষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন নিজেদের নাগরিক প্রমাণ করার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy