অরবিন্দ কেজরীবাল।
মন ভাল নেই তাঁর। শরীরও ভাল নেই। বিভিন্ন দিক দিয়ে ঘিরে ধরেছে সমস্যা। চাপে জেরবার তিনি। কিন্তু বিশ্বাস রাখছেন, রাত যত গভীর হয়, ভোর ততই কাছে আসে। পুব আকাশে না হলেও, পশ্চিমে একটা ভোর হওয়ার সম্ভাবনা কিন্তু দেখতেও পাচ্ছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী। সেই সূর্যোদয়টা যদি সত্যিই হয়, তা হলে ভোরের হাওয়াটা বুক ভরে নিতে চান অরবিন্দ কেজরীবাল। তার আগে আপাতত বিশ্রান্তি।
রাজ্যপাট ছেড়ে দশ দিনের জন্য কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে চলে যাচ্ছেন অরবিন্দ কেজরীবাল। এই সময়টুকুর জন্য সমস্ত সরকারি কাজ, দলীয় কাজ, অন্যান্য দায়দায়িত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছেন। দিল্লির সরকার সামলানোর দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছেন উপমুখ্যমন্ত্রী মণীশ সিসৌদিয়ার উপর। কিন্তু কোথায় যাচ্ছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী?
কেজরীবাল ২ অগস্ট বেঙ্গালুরু চলে যাচ্ছেন। একটি বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছেন তিনি। সম্পূর্ণ মানসিক এবং শারীরিক শান্তি ফিরে পেতে ‘বিপাসনা’য় মগ্ন হবেন তিনি। কেন বিপাসনা? শরীর এবং মন থেকে সব গ্লানি আর অশান্তি ঝেড়ে ফেলতে চাইছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী। তাই বৌদ্ধরীতির এই চিকিৎসা তথা উপাসনায় অংশ নেওয়া। আগেও এক বার বেঙ্গালুরুর এই বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠানে গিয়ে বিপাসনায় অংশ নিয়েছিলেন তিনি। ফলও পেয়েছিলেন। তাই সমস্যায় জেরবার মসনদটা আপাতত দূরে সরিয়ে রেখে দশ দিনের জন্য চলে যাচ্ছেন শান্তির খোঁজে।
কিন্তু স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এমন নজির নেই যে কোনও মুখ্যমন্ত্রী টানা ১০ দিনের জন্য কাজকর্ম দূরে সরিয়ে রেখে শান্তির খোঁজে আধ্যাত্মিক প্রতিষ্ঠানে চলে যাচ্ছেন। কী এমন হল অরবিন্দ কেজরীবালের? এত অশান্তিতে কেন তিনি?
আসলে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে প্রায় সরাসরি সংঘাত শুরু হয়েছে তাঁর। দিল্লির সরকারকে তথা আম আদমি পার্টিকে নাস্তানাবুদ করে দিচ্ছে কেন্দ্র। রোজ কোনও না কোনও বিপদের খবর আসছে। হয় তাঁর কোনও বিধায়ক গ্রেফতার হচ্ছেন, না হয় কোনও ঘনিষ্ঠ আমলা আইনের জালে জড়াচ্ছেন, না হয় কোনও মন্ত্রী সিবিআই বা ইডি-র হানার মুখে পড়ছেন। যে সব সরকারি দফতরের ক্ষেত্রে কেন্দ্র-রাজ্য সমন্বয় দরকার, সে সব ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার অসহযোগিতার পথে হাঁটতে শুরু করেছে। আর্থিক সমস্যা কেজরীবালের সরকারের নেই। দিল্লি ছোট রাজ্য ঠিকই। কিন্তু জনসংখ্যায় উচ্চবিত্তের হার বেশি থাকায় এবং মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ বেশি হওয়ায়, দিল্লি সরকারের রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বিপুল। অর্থনৈতিক দিক থেকে কেন্দ্রের উপর তেমন ভাবে নির্ভরশীল নয় কেজরীবালের সরকারে। কিন্তু প্রশাসন চালাতে গিয়ে প্রতি পদে হোঁচট খাচ্ছেন তিনি। দিল্লির পুলিশ কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণাধীন। সেই পুলিশও কেজরীবাল সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতার রাস্তায় হাঁটছে। পুলিশকে নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে, অনেক প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত কার্যকর করাই যে শক্ত, তা দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। তাই পুলিশের নিয়ন্ত্রণ রাজ্য সরকারের হাতে ছেড়ে দেওয়ার দাবিও তুলেছেন তিনি। রাজধানীর সবচেয়ে হাই প্রোফাইল এলাকা লুটিয়েন’স দিল্লিকে (যে এলাকায় রাষ্ট্রপতি ভবন, নর্থ ব্লক, সাউথ ব্লক, সংসদ ভবন সমেত সব গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে) কেন্দ্রীয় পুলিশের হাতে রেখে, বাকি অংশের পুলিশি ব্যবস্থা দিল্লি সরকারের হাতে তুলে দেওয়ার দাবিও কেজরীবাল জানিয়েছেন। কেন্দ্র তাতেও রাজি নয়।
সব মিলিয়ে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী পদে বসা ইস্তক এত নাজেহাল অবস্থার মধ্যে কখনও পড়েননি তিনি। চাপের মুখে টেনশন বেড়েছে। মানসিক স্থিতি বিঘ্নিত হচ্ছে। তা থেকে নানা শারীরিক সমস্যাও হচ্ছে। এমনিতে ঠান্ডা লাগার ধাত কেজরীবালের তো রয়েছেই। বাতানুকূল ঘরে দীর্ঘ ক্ষণ থাকতে হলে তিনি সোয়েটার গায়ে দেন। এখন বর্ষার মরসুম চলায় ঠান্ডা লাগার সমস্যা আরও জাঁকিয়ে বসছে। দীর্ঘ দিনের হাঁপানির সমস্যাটাও বেড়ে গিয়েছে। শরীর এতই দুর্বল যে রোজ সকালে নিজের বাসভবনে ঘণ্টা তিনেকের আম দরবারও তিনি ঠিকমতো বসাতে পারছেন না। সাধারণ মানুষের সঙ্গে দেখা করতে পারছেন না। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী মনে করছেন, এত রকম সমস্যার জাল ছিঁড়তে বিপাসনা-ই একমাত্র পথ।
আরও পড়ুন...
জলে, যানজটে হাঁসফাঁস করছে গুরগাঁও
বেঙ্গালুরুর বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠানে দশ দিন ঠিক কী করবেন কেজরীবাল? সূত্রের খবর, ২ অগস্ট থেকে যে দশ দিন তিনি বিপাসনার মধ্যে থাকবেন, সেই দশ দিন তিনি কারও সঙ্গে কথা বলবেন না। মুখে কাপড় বেঁধে থাকবেন। ধ্যান, উপাসনা ও শরীরচর্চা করবেন। বিশেষ পদ্ধতিতে চিকিৎসাও চলবে।
তবে সুস্থ হতে যাওয়া কি শুধুমাত্র আরও চাঙ্গা হয়ে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রিত্বে ফেরার জন্য? দিল্লির রাজনৈতিক শিবিরে কিন্তু গুঞ্জনটা একটু অন্য রকম। পশ্চিম দিগন্তে যে ‘সূর্যোদয়’টা দেখতে পাচ্ছেন কেজরীবাল, বিপাসনা-য় মগ্ন হতে যাওয়া কিন্তু সেই ‘সূর্যোদয়’-এর কথা মাথায় রেখেও। পশ্চিম দিগন্তে এই সূর্যোদয়টা কী? আপ-এর অন্দরে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, দিল্লির পশ্চিমের রাজ্য পঞ্জাব নিয়ে খুব আশাবাদী কেজরীবাল। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে সে রাজ্যে আপ-এর ফল চমকে দিয়েছিল। পঞ্জাবে বিধানসভা নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, আপ-এর হাওয়াও তত জোরদার হচ্ছে। লড়াইটা ক্রমশ অকালি বনাম আপ-এ পর্যবসিত হচ্ছে। কংগ্রেস-বিজেপি ক্রমেই জমি হারাচ্ছে পঞ্জাবে। সূত্রের খবর, পঞ্জাবের নির্বাচনে যদি আপ জয়ী হয়, তা হলে দিল্লি ছেড়ে কেজরীবাল পঞ্জাবে চলে যাবেন সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে। সেই কারণেই পঞ্জাবে আম আদমি পার্টির তরফে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে এখনও কারও নাম ঘোষণা করা হয়নি। নভজ্যোৎ সিংহ সিধু কেজরীবালের দলে যোগ দিতে চলেছেন বলে জোর জল্পনা রয়েছে। সিধু বিজেপি থেকে এবং রাজ্যসভার সাংসদ পদ থেকে ইস্তফাও দিয়ে দিয়েছেন। সিধুর স্ত্রী নভজ্যোত কউর-ও বিজেপি ছেড়ে আপ-এ যোগ দিচ্ছেন বলে খবর। প্রথমে শোনা গিয়েছিল, সিধু আপ-এর তরফে পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হবেন। কিন্তু তা হচ্ছে না। সিধুকে আপ-এর প্রচারের প্রধান মুখ করা হতে পারে, পরবর্তী কালে তাঁকে রাজ্যসভায় পাঠানো হতে পারে, তাঁর স্ত্রীকে মন্ত্রী করা হতে পারে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে তাঁকে তুলে ধরা হচ্ছে না। কারণ, প্রকাশ্যে না বললেও, কেজরীবাল নিজে পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করছেন। প্রতি মাসেই তিনি পঞ্জাব যাচ্ছেন। সংগঠন বাড়াচ্ছেন। মাথা ঠুকে এসেছেন স্বর্ণমন্দিরেও। বিপাসনা থেকে ফিরে পঞ্জাবের প্রচারাভিযানে আরও জোরকদমে ঝাঁপিয়ে পড়ার পরিকল্পনাও রয়েছে তাঁর। অন্য দিক থেকে দেখলে, নতুন উদ্যমে পঞ্জাবের জন্য ঝাঁপাতে হলেও দশ দিনের এই বিপাসনাটা খুব জরুরি কেজরীবালের জন্য।
দশ দিনের জন্য মণীশ সিসৌদিয়াকে দায়িত্ব দিয়ে যাওয়াও নাকি ওই ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখেই। কেজরীবাল পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে চলে গেলে, দিল্লির রাজ্যপাট তিনি মণীশ সিসৌদিয়ার উপরেই নাকি ছেড়ে যেতে চান। তাই নিজের সাময়িক অনুপস্থিতির সময়টাতে সিসৌদিয়াকেই দায়িত্বটা দিয়ে যাচ্ছেন। পরখ করে নিতে চান, তাঁর উপমুখ্যমন্ত্রী কেমন সামলাচ্ছেন সরকারটাকে। পরখ করে নিতে চান, সিসৌদিয়ার নেতৃত্ব নিয়ে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় দলে ও প্রশাসনে।
অতএব, ২ অগস্ট থেকে দশটা দিন খুব গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে কেজরীবালের জীবনে। এক বিপাসনায় অনেক পাখি মারতে চাইছেন তিনি। যদি সফল হন, কেজরীবালের এই বিপাসনা তা হলে ছাপ ফেলতে চলেছে উত্তর ভারতের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy