Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

যে বিয়ে রূপকথাকেও হার মানায়…

এ জন্যই হয়তো বলে ‘ম্যারেজেস আর মেড ইন হেভেন’— বিয়ের আসল ঘটক সবার অলক্ষ্যে বসে গাঁটছড়ায় গিঁট বাঁধেন! এক দিকে, দুর্ঘটনায় দুই হাত হারানো কটন কলেজের ছাত্রী। অন্য দিকে, ১৯ বছর অজ্ঞাতবাসে থেকে ভারতের বিরুদ্ধে লড়াই চালানো আলফার প্রতিষ্ঠাতা উপ-সভাপতি।

বিয়ের পিঁড়িতে প্রদীপ গগৈ, জুলি বরুয়া। শুক্রবার। ছবি: উজ্জ্বল দেব।

বিয়ের পিঁড়িতে প্রদীপ গগৈ, জুলি বরুয়া। শুক্রবার। ছবি: উজ্জ্বল দেব।

রাজীবাক্ষ রক্ষিত
গুয়াহাটি শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০১৫ ০০:৫২
Share: Save:

এ জন্যই হয়তো বলে ‘ম্যারেজেস আর মেড ইন হেভেন’— বিয়ের আসল ঘটক সবার অলক্ষ্যে বসে গাঁটছড়ায় গিঁট বাঁধেন!

এক দিকে, দুর্ঘটনায় দুই হাত হারানো কটন কলেজের ছাত্রী। অন্য দিকে, ১৯ বছর অজ্ঞাতবাসে থেকে ভারতের বিরুদ্ধে লড়াই চালানো আলফার প্রতিষ্ঠাতা উপ-সভাপতি। এক জন দীর্ঘ লড়াইয়ের পর নকল হাতের সাহায্যে লেখিকা ও সরকারি চাকুরে। অন্য জন ১২ বছর কারাবাসের পরে ২০১০ সালে মুক্তি পেয়ে বসেছেন শান্তি আলোচনায়।

দু’জনের বয়সের ফারাক দুই দশকের। আপাত দৃষ্টিতে এমন পাত্র-পাত্রীর চার হাত এক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না বললেই চলে। কিন্তু, দীর্ঘদিনের আলাপ আর নির্ভরতার রাস্তা ধরেই এল প্রেম। শেষ পর্যন্ত গত কাল প্রদীপ গগৈয়ের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধলেন জুলি বরুয়া।

অসমের লখিমপুর জেলার ঢকুয়াখানার দুলিয়াগাঁয়ের বাসিন্দা ক্ষীরেন্দ্র বরুয়ার মেয়ে জুলি। ২০০৬ সালের ১৩ মে লালুক এলাকায় এক দুর্ঘটনায় তিনি দু’টি হাতই হারান। দাঁতে দাঁত চেপে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার লড়াই শুরু করে কটন কলেজের মাস কমিউনিকেশনের ছাত্রী। জুলির চিকিৎসায় এগিয়ে আসে ছাত্র সংগঠন আসু। তারা ওই তরুণীকে দিল্লিতে নিয়ে যায়। জোগাড় করা হয় সাড়ে ৬ লক্ষ টাকা। জার্মান সংস্থার তৈরি আধুনিক হাত লাগানো হয়। মোটর লাগানো নকল ডান হাত প্রায় সব রকম কাজই করতে সক্ষম। কিন্তু, বাঁ দিকের নকল হাত কোনও কাজ করতে পারে না।

গত বছর অসমের উদ্ভাবক উদ্ধব ভরালি জুলির জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি করে দেন খাদ্যগ্রহণের স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র। পড়শোনা শেষ করার পাশাপাশি জুলি দুটি বইও লেখেন—বিজয়িনী, ক্রিস্টি ব্রাউন ও মোই। জুলিকে নিয়েও লেখা হয় বই। তিনি বর্তমানে রাজ্য তথ্য ও প্রচার দফতরে কর্মরত। তাঁর লড়াইয়ে গল্প অনেককেই অনুপ্রাণিত করে।

অন্য দিকে ১৯৭৯ সালে অরবিন্দ রাজখোয়া, অনুপ চেতিয়া, পরেশ বরুয়াদের সঙ্গে আলফা গড়েন বেতাবাড়ি মাহুতগাঁওয়ের বাসিন্দা প্রদীপ গগৈ। আতার পর থেকে তিনি ঘরমুখো হননি। দীর্ঘদিন বাংলাদেশ, মায়ানমার, ভুটানের গোপন শিবিরে বসে ভারত বিরোধী লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার পর ১৯৯৮ সালে কলকাতায় তিনি ধরা পড়েন। সেই থেকে প্রদীপবাবু জেলে বন্দি ছিলেন। জামিন পান ২০১০ সালে। এরপর আলফা সভাপতি অরবিন্দ রাজখোয়ার নেতৃত্বে ভারত সরকার ও আলফার মধ্যে শান্তি আলোচনা শুরু হয়। তাতে সামিল হন গগৈও। আলফার কেন্দ্রীয় কমিটির সিংহভাগ শান্তি আলোচনায় যোগ দিলেও সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেতিয়া এখনও বাংলাদেশের জেলে আছেন। আলফা স্বাধীন গড়ে পরেশ বরুয়া জানিয়ে দিয়েছেন তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন।

জুলি জানান, প্রথম বার হাসপাতালেই প্রদীপবাবুকে দেখেন তিনি। প্রথম দর্শনেই প্রেম? প্রশ্ন শুনেই জুলি বলেন, ‘‘তখন তো আলফা নেতা শুনেই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। বাড়িতেও বিয়ের প্রস্তাব আসছিল। কিন্তু, কাউকে পছন্দ হচ্ছিল না। দুই হাত খোয়ানোর পর নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চিন্তাটাই মুখ্য ছিল। সহানুভূতি দরকার ছিল না।’’ নববধূ জানান, প্রদীপবাবু তাঁর পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। পরিবারের সদস্যের মতোই হয়ে উঠেছিলেন। তিনি ছিলেন জুলিদেবীর অভিভাবকের মতোই। তাঁর উপরে অনেকটা নির্ভরশীল হয়ে পড়েন জুলি। বিহুর আগে প্রদীববাবু নিজেই বিয়ের প্রস্তাব দেন। তাঁর বাড়ির লোকও জুলি দেবীর বাড়িতে প্রস্তাব দেয়। ভাবনাচিন্তার পর জুলির পরিবার বিয়েতে সম্মতি দেয়। লখিমপুরের ডুলিয়াগাঁওতে হওয়া দুই ‘লড়াকু’ বর-কনের বিয়েতে নিতবরের ভূমিকায় ছিলেন আলফার অর্থ সচিব চিত্রবন হাজরিকা। বিয়ে সেরে খুশি প্রদীববাবু বলেন, ‘‘জুলির সৃজনশীলতায় উৎসাহ দেওয়াটাই আমার বড় কাজ। জুলি সাহাসিনী। তাই মনে হল, ওঁর লড়াইয়ে সারা জীবন সঙ্গ দেওয়া গেলে ভাল হয়।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE