সে কালের সঙ্গে এ কালের যোগ। শীর্ষাসনে জওহরলাল নেহরু, পদ্মাসনে নরেন্দ্র মোদী। — ফাইল চিত্র।
যোগের আগে বিয়োগ।
প্রায় সকলের ধারণা, যোগ অভ্রান্ত ভাবে ভারতীয়। যোগের বিশ্বজয়ে এক আত্মতৃপ্তি আছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের স্বীকৃতিতে আগামী কাল প্রথম বিশ্ব যোগদিবস পালন যেন তাই বিশ্বকাপ জেতার পর ধোনিকে স্বীকৃতি দেওয়া।
সমস্যা যোগ শব্দটি নিয়ে। নানা মুনির নানা মত। কখনও যোগ কাজের কৌশল, কখনও বা সাধনা। এক অর্থের সঙ্গে অন্যটির যোগ নেই, যদিও সম্পর্ক স্থাপনের একটা চেষ্টা হয়ে থাকে।
যোগ শব্দটি তিন রকম অর্থে ব্যবহৃত হয়। প্রথম, যোগ সূত্র। পতঞ্জলির এই দর্শনটি গিনেস বুকে একটি কারণেই স্থান পেতে পারে, সেখানে শুধুমাত্র তিনটি ক্রিয়াপদ ব্যবহৃত। এই দাঁতভাঙা চেষ্টা এমন দুরূহ যে পরবর্তী সাত-আটশো বছর ধরে তা পণ্ডিতদেরও বোধের বাইরে চলে গেল। পতঞ্জলির সৌভাগ্য, বিবেকানন্দ ‘রাজযোগ’-এ সেই পতঞ্জলি-সূত্রের ভাষ্য লিখে, তাকে আরও বিশদে ফের মানুষের সামনে নিয়ে এলেন।
দুই, অলৌকিক যোগ। যোগবলে বা মন্ত্র পাঠ করে যোগী নাকি অতীন্দ্রিয় শক্তির অধিকারী হয়ে শূন্যে ভাসবেন, জলে হেঁটে যাবেন।
তিন, শারীরিক যোগ। এটি হঠযোগ, তান্ত্রিক যোগ ও প্রাণায়ামের এক রকম মিশ্রণ।
এই শারীরিক যোগই আগামী রবিবার পতঞ্জলি, বিবেকানন্দের দেশে ‘টু মিনিট্স ইয়োগা’র সন্ধান দেবে। নয়াদিল্লির রাজপথে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ৩৫ মিনিটে পদ্মাসন, গোমুখাসন, পবনমুক্তাসন ইত্যাদি ১৫টি আসন করে দেখাবেন প্রায় ৪৫ হাজার ছাত্রছাত্রী, সেনা অফিসার ও কূটনীতিক। নেহরু স্টেডিয়ামে পাঁচ হাজার মানুষের সামনে স্টেজ রিহার্সাল দেখিয়েছেন বাবা রামদেব, ‘‘পবনমুক্তাসন ভাল ভাবে করুন। গ্যাস, অম্বলের সমস্যা থাকবে না।...এই আসনটা কিন্তু হাঁটুর জন্য। আমাদের ট্রেড মিল দরকার নেই। আমাকে এক দিনও জিমে যেতে হয়নি। যোগই ঈশ্বর।’’
যোগ এবং আয়ুর্বেদ বিষয়ক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শ্রীপদ নায়েক এগিয়েছেন আরও এক ধাপ, ‘‘যোগের ফলে সরকারি কর্মীরা আরও দক্ষ হবেন, দুর্নীতি কমবে।’’ পতঞ্জলি তাঁর বইয়ের দ্বিতীয় সূত্রেই বলেছিলেন, ‘যোগশ্চিত্তবৃত্তিনিরোধঃ।’ চিত্ত নিরুদ্ধ করার বদলে আজকাল বাত, অম্বল, হাঁটু ব্যথা, মায় সামাজিক দুর্নীতির বিরুদ্ধেও অস্ত্র যোগ। আগামী কাল তাই বিশ্ব যোগদিবসের বদলে বিশ্ব হঠযোগদিবস বললে আরও সঠিক হত।
ত্রয়োদশ শতকে সম্ভবত দত্তাত্রেয় প্রথম হঠযোগ শব্দটি ব্যবহার করেন। নাথ যোগীরা তার আগে থেকেই এই বিষয়ে লেখালেখি করেছেন। তবে হঠযোগ শব্দটি দত্তাত্রেয়র আগে কেউ ব্যবহার করেছেন বলে মনে হয় না।
এঁদের লেখা পড়লে বোঝা যায়, আজ আমরা যে সব নামে শরীর-যোগের আসনগুলি করি, তার বেশ কয়েকটি তাঁদের থেকেই এসেছে। যদিও মিলগুলি নামেই। যোগী বলতে সাধারণত বোঝানো হয় তাঁদের, যাঁরা অলৌকিক শক্তির সাধনা করেন। কবি কবিতা লেখেন, অভিনেতা অভিনয় করেন। কিন্তু যিনিই যোগ করেন, তিনিই যোগী নন। সমস্যা হল এখানেই। রামদেবের মতো যাঁরা যোগ শিক্ষক, তাঁরা ‘যোগাচার্য’ বলে অভিহিত হতে পারেন, কিন্তু যোগী কখনওই বলা যায় না।
অলৌকিক শক্তির সাধনাতে আধুনিক বাঙালির বৌদ্ধিক অনীহা। হুতোম তাঁর নকশায় তাই ভূকৈলাসের যোগীকে নিয়ে ‘যোগা অ্যাফরিজম্স অব পতঞ্জলি’ বইয়ের ভূমিকায় সে কথাই স্পষ্ট করে দেন, ‘ব্যক্তিগত ভাবে আমি যোগী নই। যোগের দর্শনেও উৎসুক নই। সচেতন ভাবেই প্রথাগত ভারতীয় ঐতিহ্যের বাইরে বেরিয়ে পশ্চিমি দর্শনের সঙ্গে যোগের আলাপ আলোচনার জন্য এই বই।’ রামকৃষ্ণ হঠযোগের সমালোচক। গুরুর থেকে শিক্ষা পেয়েই বিবেকানন্দ পরে তাঁর রাজযোগের ব্যাখ্যায় প্রথম বিয়োগে আসবেন: ‘যোগশিক্ষায় যাহা কিছু গুহ্য, রহস্যময় আমাদের বর্জন করিতে হইবে।’ তবে রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ দু’ জনেই কুণ্ডলিনী ও চক্র জাগানোর তান্ত্রিক যোগের বিরুদ্ধে কেন কিছু বলেননি, উত্তর নেই। বিভিন্ন যোগ সম্পর্কে আজ যে স্বচ্ছতা এসেছে, সে দিন ছিল না।
উনিশ শতকের ভারতীয় মনীষীরা হিন্দু সমাজের বিভিন্ন কু-প্রথা দূর করতে পশ্চিমি উদারতা, জ্ঞান, সামাজিক প্রথা অনুসরণ করেন। সতীদাহ বিলোপ, স্ত্রী-শিক্ষা প্রসারের মতো সংস্কারের ক্ষেত্রে রামমোহন রায় এবং বিদ্যাসাগর যা করেছিলেন, তা আসলে বিদেশের সামাজিক প্রথাকে হিন্দু সমাজের মূল ধারায় নিয়ে আসা। সংস্কৃত শিক্ষাকে সনাতনী টোলের চৌহদ্দির বাইরে পাশ্চাত্য ধাঁচের কলেজ শিক্ষার সিলেবাসেও এনেছিলেন বিদ্যাসাগর।
পরবর্তীকালে বিবেকানন্দের হাত ধরে রামকৃষ্ণ মঠ যে ভাবে শিক্ষাবিস্তার ও সেবামূলক কাজের ‘মিশন’ হয়ে ওঠে, তার পিছনেও কাজ করেছে পশ্চিমি ভাবধারা। স্বামীজি নিজেই বলেছেন, রামকৃষ্ণ মিশন হল বৌদ্ধ মঠ ও ক্রিশ্চান মিশনের মিলিত রূপ। একই সঙ্গে বিদেশিরাও ভারতীয় ঐতিহ্য নিয়ে আগ্রহী হয়েছেন। নিয়েছেন প্রাচীন ভারতের শাস্ত্রজ্ঞান। সে ভাবেই আমেরিকায় মাদাম ব্লাভাৎস্কির থিওসফিক্যাল সোসাইটির পত্তন। সেখানে (হঠ)যোগ শেখানো হয়। পরে আমেরিকায় পৌঁছে বিবেকানন্দ তৈরি করেন বেদান্ত সোসাইটি। ভারতীয় ধ্যান পরিবেশনার ধারা শুরু হল অভারতীয়দের জন্য।
মহাজ্ঞানী মহাজন যে পথে করেন গমন! পরবর্তীকালে আয়েঙ্গার এবং বিহার স্কুলের যোগ-শিক্ষকেরা বিদেশে নিয়ে যান ভারতীয় যোগ। সেখানে তা রীতিমতো কদরও পায়। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল দু’রকম। এক, বিদেশে অর্থ উপার্জন করে তা দিয়ে দেশে আশ্রম গড়ে তোলা। দুই, বিদেশের কাছে ভারতীয় যোগের গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠিত করা। আগে ভারতীয়দের কাছে এই যোগ খুব গ্রহণযোগ্য ছিল না। কিন্তু আই এস আই ছাপের মতো বিদেশে সাফল্যের তকমা পেয়ে তা ভারতের কাছেও সহজে গ্রহণযোগ্য হল। যেন মালদহের আমের চারা ক্যালিফোর্নিয়ায় নিয়ে গিয়ে সেখান থেকে আম ফলিয়ে তা ভারতে এল এবং বিদেশের গন্ধ মাখা সেই আম কাঁটা-চামচ দিয়ে পশ্চিমি কেতায় খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলল মানুষ। আয়েঙ্গার স্কুল, বিহার স্কুল সকলে আজ যে যোগ শেখায়, এক অর্থে বিদেশই তার জনক।
ভারতে কিছু দিন আগেও যোগ ছিল মূলত পাশ্চাত্য ধ্যানধারণায় অভ্যস্ত ‘এলিট’দের মধ্যে সীমিত। যেমন, জওহরলাল নেহরুর যোগাভ্যাস ছিল, শীর্ষাসন করতেন। করতেন তাঁর কন্যা ইন্দিরাও। কিন্তু রাজেন্দ্রপ্রসাদ করতেন না।
যে যোগ আমরা আজ করি তার সঙ্গে দত্তাত্রেয় বা গোরখনাথের সম্পর্ক কত দূর বলা শক্ত। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছে উনিশ শতকের পর, বিদেশির মন জয়ের পর। এই মন জয় করতে গিয়ে তার রূপ অনেকটাই বদলেছে। টিভিতে রামদেবের যোগশিক্ষা দান নিয়ে এসেছে যোগের গণতন্ত্রীকরণ। যেমন, গাঁধীজি রাজনীতিকে নিয়ে গিয়েছিলেন আমজনতার মধ্যে, রামদেবও সে রকম যোগকে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন।
আগামী কাল যা হবে, তার সঙ্গে প্রাচীন ভারতের সম্পর্ক খোঁজা বাতুলতা। যোগের ভারতীয় ধারণা উনিশ শতকে বিদেশে গিয়ে পরিশোধিত পরিমার্জিত পরিশীলিত হয়ে দেশে ফেরত আসছে।
ঘর ওয়াপসি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy