আইসিইউ থেকে রোগীকে জেনারেল ওয়ার্ডে নেওয়ার জন্য ট্রলি মেলেনি শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। হেঁটে এগোতেই সেলাই ফেটে পেটের নাড়িভুড়ি বেরিয়ে যায়। দ্রুত অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেলেও বাঁচানো যায়নি ১৯ বছরের এলিজা বেগম মজুমদারের। সঙ্গে মাতৃহারা হয় ১২ দিনের সদ্যোজাত।
রোগীর পরিজনরা অভিযোগ তোলেন, কর্তব্যরত এক নার্সের গাফিলতিতে এলিজার মৃত্যু হয়েছে। তা নিয়ে ব্যাপক উত্তেজনা ছড়ায়। এনএসইউআইয়ের পক্ষ থেকে ওই নার্সকে চাকরি থেকে বরখাস্ত সহ উপযুক্ত শাস্তির দাবি করা হয়েছে। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সুপারিন্টেন্ডেন্ট এ এস বৈশ্য ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
এলিজা বেগমের ভাই মাফিক আহমেদ ও জাকির হোসেন জানিয়েছেন, ৪ এপ্রিল প্রসব-বেদনা শুরু হলে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। পর দিন অস্ত্রোপচার করে সন্তানের জন্ম দেন এলিজা। সন্তান সুস্থ থাকলেও সমস্যা দেখা দেয় মায়ের হৃদযন্ত্রে। এলিজাকে কার্ডিওলজি বিভাগে পাঠানো হয়। ডাক্তাররা দ্রুত তাকে আইসিইউয়ে নিয়ে যান। অবস্থার উন্নতি ঘটে। শুক্রবার পেটে অস্ত্রোপচারের সেলাইও কেটে দেওয়া হয়।
আজ আইসিইউ থেকে জেনারেল ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। মাফিজ জানান, ৪ এপ্রিল থেকে তাঁরা দু’ভাই ও ভগ্নীপতি মেডিক্যালে রয়েছেন। একটাই লক্ষ্য, এলিজার যেন কোনও সমস্যা না হয়। ডাক্তার-নার্স যখন যা বলেছেন, ব্যবস্থা করেছেন। এ দিন জেনারেল ওয়ার্ডে নিয়ে যেতে বলায় সব কিছু গুছিয়ে নিয়েছিলেন। তাঁর অভিযোগ, কর্তব্যরত এক নার্স এসে দ্রুত সেখান থেকে রোগীকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে বলেন। তাঁরা ট্রলির খোঁজ করি। নার্স জানিয়ে দেন, ট্রলি নেই। হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে হবে ওই তরুণীকে। মাত্র দু-দিন আগে সেলাই কাটার কথা শুনেও নার্স তা উপেক্ষা করেন। মাফিজের কথায়, ‘‘উনি বললেন, সেলাই কাটার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটানো যায়। দু’পা এগোতেই সেলাই খুলে যায় এলিজার। পেটের নাড়িভুড়ি বেরিয়ে আসে।’’
মাফিজ জানান, তখন হুঁশ হয় সবার। তড়িঘড়ি তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় অপারেশন থিয়েটারে। কিন্তু বাঁচানো যায়নি ১৯ বছরের এলিজাকে।
গত বছরই বিয়ে হয়েছিল মধুরবন্দের এলিজার। স্বামী একই এলাকার ফয়েজউদ্দিন মজুমদার। তিনিও স্ত্রী হারিয়ে ১২দিনের শিশুকে কী করে বাঁচিয়ে রাখবেন, সে নিয়ে চিন্তায়।
এনএসইউআই-র জেলা কমিটির উপসভাপতি রাজা লস্করের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধিদল এ দিন শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সুপার এ এস বৈশ্যের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁরা ওই নার্সের কঠোর শাস্তি দাবি করেন। তাঁকে দ্রুত চাকরি থেকে বরখাস্ত করার অনুরোধ জানান। আরও কেউ দোষী কি না তাও খুঁজে দেখতে বলেন। সে জন্য তিন দিনের সময় বেঁধে দিয়ে রাজা লস্কর, আলি আহমেদ হাজারিরা জানান, মানবিক কারণেই এ ব্যাপারে তাঁরা ছুটে এসেছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিষয়টিতে গুরুত্ব না দিলে তিন দিন পর তাঁরা আন্দোলনে নামবেন।
বৈশ্যবাবু ঘটনা নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। শুধু বলেন, ‘‘ঘটনাটি দুর্ভাগ্যজনক। আমরা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছি।’’ কোন পর্যায়ের তদন্ত হবে, কারা তাতে থাকবেন, সে সবও খোলসা করেননি তিনি।
এলিজার মৃত্যুর অন্য রোগীর পরিজনরাও মেডিক্যাল কলেজের নানা অব্যবস্থা নিয়ে সরব হন। তাঁরা অভিযোগ করেন, প্রসূতি বিভাগের অপারেশন থিয়েটারে প্রায়ই জল থাকে না। রোগীর পরিবারকে মিনারেল ওয়াটার কিনে দিতে হয়। ওষুধপথ্য তো কিনতেই হয়, হাতের গ্লাভসও এনে দিতে হয়। এক সদ্যোজাতের বাবা বললেন, ‘‘দু’দিন আগে শিশুর জন্য সন্ধেয় একটি ওষুধ লিখে দেওয়া হয়েছিল। এনে দিই। রাতে আবার একটি ওষুধ এনে দিতে বলেন। দেখি, একই ওষুধ। এ নিয়ে জিজ্ঞেস করতেই নার্স ধমকে বলেন, এখনই এটি এনে দিতে হবে। এনে দিলাম। পরদিন সকালে দেখি, একই ওষুধের দুটো ডোজ-ই বিছানায় পড়ে রয়েছে।’’
অনেকের অভিযোগ, মেডিক্যালে অধ্যক্ষ-সুপারের তেমন ভূমিকা নেই। বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষী থাকলেও আসলে সব কিছু বাইরের একদল দালালের হাতে। তারাই রক্ষীদের পরিচালনা করে, রোগীর আত্মীয়স্বজনের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করে। প্রেসক্রিপশন নিয়ে বেরোতেই হাত থেকে তা ছিনিয়ে নিয়ে নিজের পছন্দের দোকানে নিয়ে যাবে। রক্ত চাই কি থাকার ব্যবস্থা, এক বার রোগী ভর্তি হলে তাদের কথাতেই চলতে হয় পরিজনদের। আপত্তি করলেই নানা ধরনের বিপত্তি। মেডিক্যাল চত্বরে প্রায়ই গ্রামগঞ্জের লোকেদের শারীরিক নিগ্রহের শিকার হতে হয় বলে অভিযোগ। বেশ কিছু অপহরণ, শ্লীলতাহানির ঘটনাও ঘটেছে শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
এ সব ব্যাপারেও সুপারিন্টেন্ডেন্ট বৈশ্য মন্তব্য করতে চাননি।
পুলিশও বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষীদের দেখিয়ে দায় সারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy