Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
মুম্বই মনতাজ

তোমাকে প্রণাম

গোয়ালপাড়ার রাস্তায় হাঁটছিলেন মানুষটি। ঢিলেঢালা জাব্বা-জোব্বা পরা। হাত জোড়া করে পেছনে রাখা। আপন মনে হেঁটে চলেছেন। সঙ্গে সঙ্গে গানের বাণী ভাবছেন। নতুন গান। নতুন সুর আওড়াচ্ছেন মনে মনেই। হঠাৎ কোনও অভাবনীয় সুর গুনগুনিয়ে যেন বেজে উঠল বাণীর সঙ্গে, অন্তরের গভীর থেকে। বাহ্। এটি তো ভাল সুর! মনে মনে দু’তিন বার আউড়ে নিয়ে ওঁর বেশ পছন্দ হল। অকস্মাৎ কাউকে বা কিছু আপন করে পেয়ে গেলে বা আবিষ্কার করলে সঙ্গে সঙ্গে প্রথমেই ভয় হয়—হারিয়ে না যায়। কী করি, কী করি? কোথায় রাখি তারে? কার কাছে জমা রাখা যায়? ভাবতে ভাবতে স্বাভাবিক ভাবেই মনে পড়ে গেল ভাইপোর কথা। যাই। দৌড়ে চলে যাই ওর কাছে। ওকে শুনিয়ে দিলেই ব্যস, নিশ্চিন্ত। ও একেবারে স্বরলিপি তুলে রাখবে।গোয়ালপাড়ার রাস্তায় হাঁটছিলেন মানুষটি। ঢিলেঢালা জাব্বা-জোব্বা পরা। হাত জোড়া করে পেছনে রাখা। আপন মনে হেঁটে চলেছেন। সঙ্গে সঙ্গে গানের বাণী ভাবছেন। নতুন গান। নতুন সুর আওড়াচ্ছেন মনে মনেই। হঠাৎ কোনও অভাবনীয় সুর গুনগুনিয়ে যেন বেজে উঠল বাণীর সঙ্গে, অন্তরের গভীর থেকে। বাহ্। এটি তো ভাল সুর! মনে মনে দু’তিন বার আউড়ে নিয়ে ওঁর বেশ পছন্দ হল। অকস্মাৎ কাউকে বা কিছু আপন করে পেয়ে গেলে বা আবিষ্কার করলে সঙ্গে সঙ্গে প্রথমেই ভয় হয়—হারিয়ে না যায়। কী করি, কী করি? কোথায় রাখি তারে? কার কাছে জমা রাখা যায়? ভাবতে ভাবতে স্বাভাবিক ভাবেই মনে পড়ে গেল ভাইপোর কথা। যাই। দৌড়ে চলে যাই ওর কাছে। ওকে শুনিয়ে দিলেই ব্যস, নিশ্চিন্ত। ও একেবারে স্বরলিপি তুলে রাখবে।

মিলন মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৫ ০১:০০
Share: Save:

যেমন ভাবা, তেমনই কাজ। দ্রুত পায়ে প্রায় ছুটেই চললেন মানুষটি তাঁর ভাইপোর কাছে। দিনু তো বলতে গেলে কাছেই থাকে!

গোধূলির রাঙা আলো আকাশ ছেয়ে ছিল। এ বারে সহসা যেন হারিয়ে গেল গগনপারের অকূল অন্ধকারে। দিগ্বিদিক আলোড়িত করে উঠল ঝড়ের হাওয়া। ছমছমিয়ে রাত নেমে এল চারপাশ নিকষ কালো করে। ভুবনডাঙ্গার মাঠের ধুলি-ধূসরিত আলো-অন্ধকারে সামান্য দূরেও দৃষ্টি চলে না। তারই মধ্যে নিত্যদিনের চেনা পথ বেয়ে দ্রুত হেঁটে চলেছেন ভাবুকটি। ভাবনার ভিতরে বারবার নতুন গানের সদ্য ফোঁটা কলিটি ঘুরে ঘুরেই আসছে। মনের কোণে সুরের বাঁধনটি সযত্নে বয়ে নিয়ে ছুটছেন সৃষ্টির তাড়নায়। দিনুর হাতে একবার সঁপে দিলে নিশ্চিন্ত হতে পারবেন। নানান ভাবনার ভিড়ে হারিয়ে যাবার কোনও ভয় থাকবে না আর।

শুকনো পাতা উড়ছে এলোপাথারি। দিশাহীন দামাল হাওয়ার মাতাল ছোটাছুটির মধ্যেই আন্দাজে সেই আলো-অন্ধকারে দ্রুত পায়ে এগোচ্ছেন মানুষটি। হঠাৎ বাধা পড়ল পিছু টানে। কে যেন তাঁর ঢিলেঢালা আলখাল্লার প্রান্ত ধরে আছে পিছন থেকে। কে? এমন ছন্নছাড়া আবহাওয়ায় সামান্য শিউরে উঠেই পেছন ফিরে দেখলেন, কে? ছোট্টো একটি নিষ্পাপ ফুলের গাছ। এই অস্ফুট আবছায়ায় যেন ভারি মিনতি ভরা কণ্ঠে মানুষটিকে জিগ্যেস করছে,

‘‘আমার কথা তুমি লিখবে না তোমার কবিতায়? বড়ই অকিঞ্চিৎকর আমি পৃথিবীর অজস্র ফুলের বাগানে। তবু তো প্রকৃতি তাঁর কোলে ঠাঁই দিয়েছেন আমায়—আমি কি কোথাও থাকব না তোমার কাব্যে?’’

হ্যাঁ। আছে বৈকি? সেই মালতী-করবী-মল্লিকা, দোদুল্যমান মাধবীলতার আলো করা সভায়, অতি নগণ্য ফুল আকন্দকেও ঠিক মনে রেখেছেন কবি। আমাদের অন্তরের মানুষ রবীন্দ্রনাথ। অন্তরে-বাহিরে, সুখে-দুঃখে, ফুটফুটে জ্যোৎস্নায়, তপের তাপময় নিদাঘ দ্বিপ্রহরে অথবা অঝোরঝরণ বর্ষায়—সকল সময়ে প্রায় ঈশ্বর বা চিরকালের অবতারের মতন অতি নিকটেই দাঁড়িয়ে আছেন আমাদেরই জন্য কোনও-না-কোনও উপহার নিয়ে। যেমন, শান্তিনিকেতনের এক সন্ধ্যায় ওপরে কথিত ঘটনাটি ঘটেছিল, সেই আবছা অন্ধকারে অমন ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যেও দিনেন্দ্রনাথের কাছে ছুটতে ছুটতে যাবার সময় পথের প্রান্তে অপেক্ষমান একটি নগণ্য আকন্দ গাছের সঙ্গে তাঁর হঠাৎ আলাপ।

তাকেও ভোলেননি কবি। মনে মনে তাকে দেওয়া কথাও তিনি রেখেছেন—কবিতার অক্ষরে অক্ষরে। দিনলিপির মতনই লিখে উপহার দিয়ে গেছেন আমাদের ও তার ‘আকন্দ’ গাছটিকে। কবিতাটি প্রায় সকলেরই জানা। তবু রবীন্দ্রনাথ পুরনো হন না বলেই প্রসঙ্গক্রমে পুনরায় বলা যায়:


সঙ্গে লেখকের আঁকায় কবি।

‘সন্ধ্যাকালে সোনার খেয়া পাড়ি যখন দিল গগন-পারে,

অকূল অন্ধকারে,

ছমছমিয়ে এল রাতি ভুবনডাঙ্গার মাঠে

একলা আমি গোয়ালপাড়ায় বাটে।

নূতন-ফোঁটা গানের কুড়ি দেব বলে দিনুর হাতে আনি

মনে নিয়ে সুরের গুনগুনানি

চলেছিলেম। এমন সময় যেন সে কোন পরীর কণ্ঠখানি

বাতাসেতে বাজিয়ে ছিল বিনা ভাষার বাণী।

বললে আমায়, দাঁড়াও ক্ষণেক তরে

ওগো পথিক, তোমার লাগি চেয়ে আছি যুগ যুগান্তরে

আমায় নেবে চিনে

সেই সুলগন এল এত দিনে।

পথের ধারে দাঁড়িয়ে আমি, মনে গোপন আশা

কবির ছন্দে বাঁধব আমার বাসা

দেখা হল, চেনা হল সাঁঝের আঁধারিতে,

বলে এলেম, ‘‘তোমার আসন কাব্যে দেব পেতে’’।......

.....সভার দুয়ার হল বন্ধ

সব পিছে রইল আকন্দ।’

এই ঠাকুরের কোনও সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা করবার যোগ্যতা আমার এ জন্মে হবে না। তবে, ব্যক্তিগত ভাল লাগার ভিতর এই কবিতাটি অসাধারণ কোনও উচ্চতায় ঠাঁই পেতে পারেনি অন্যান্য হাজার সৃষ্টির সুবিশাল উদ্যানে। তবু, অকিঞ্চিৎকর বিষয়ও তাঁর ভাল লেগেছে যদিও তিনি অন্য কোনও সৃষ্ট সুর মনে রেখে রেখে দ্রুত হাঁটছিলেন—পাছে, অন্য কোনও ভাবনার বাতাসে সেই গানটি হারিয়ে না যায়। ঝোড়ো বাতাস, শুকনো পাতা উড়ছে, ধুলোর উথালিপাথালি ছোটাছুটির মধ্যে নিজেও দ্রুত দৌড়োচ্ছেন বিশষ ‘ভাবনা’টিকে নিয়ে,—

এমন অসাব্যস্ত অবস্থায় প্রকৃতির এক নগণ্য সৃষ্টি ‘আকন্দ’ অনাহুত, অবাঞ্ছিত হলেও, বিশ্বকবি তাকে সযত্নে ঠাঁই দিয়েছেন মনের কোণে। তার আবদারও তিনি অগ্রাহ্য করেননি বিরক্তি ভরে। বরং তাকে দেওয়া কথা রেখে তার আসনও পেতে দিয়েছেন তাঁর কাব্যে। অসামান্য মানুষ ব্যতীত এ ঘটনা এমন সুন্দর পরিসমাপ্তিতে পৌঁছত না। হারিয়ে যেত নানান ভাল-লাগা, নানান ব্যস্ততার জীবনে।

আর একটি দুর্ভাগ্যময় কাণ্ড হত এবং এমন বিপুল ধনভাণ্ডার মোটেই পেতুম না আমরা কবির জন্ম যদি ঘটত এ কালে। ভাবুন, একবিংশ শতকের প্রথম দশক পেরিয়ে এসেছি আমরা। আজকের দিনের যে কোনও এক দিন সূর্যের আলো নিতে আসছে। শান্তিনিকেতনের পথে পায়চারি করছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। হুবহু সেই ঝোড়ো হাওয়ার ‘সন্ধে’। শান্তিনিকেতনের পথে পায়চারি করতে করতে সুরের সঙ্গে বাণী মিলিয়ে ‘গানের কুঁড়ি’-টি পেয়ে গেলেন বনে। ভারী পছন্দ হল তাঁর। দামাল বাতাসের মধ্যে ‘দিনুর হাতে’ সেই সুর-বাণী পৌঁছবার জন্যে ছুটতেই হল না মোটেই। লম্বা সেই বিখ্যাত ঢিলেঢালা আলখাল্লার পকেট থেকে আজকের মহা-যন্ত্র (তথা যন্ত্রণা) মোবাইলটি বের করে আনলেন। টুক করে নম্বর টিপে কানে লাগিয়ে কথা বললেন বিশ্ববন্দিত মানুষটি। ব্যস! গেল সব হারিয়ে। না হল দেখা তাঁর ‘আকন্দ’র সঙ্গে। না পেলুম আমরা তাঁর লেখা কবিতাটি।

এ তো গেল শুধু একটি সম্ভাবনা। এর পরেও থাকছে। যেমন, আমরা যারা কিঞ্চিৎ লেখালিখির মধ্যে থাকি—আমরা কি জানি না, একটি লেখা মোটামুটি আপন পছন্দ মতন ‘দাঁড়’ করাতে গেলে কত কাটাকুটি, কত পৃষ্ঠা কাগজ যে ছুড়ে ফেলে দিতে হয়, তার হিসেব আমরা রাখি না। আর, রবীন্দ্রনাথ! তিনিও তো তাঁর হাতে লেখা এক একটি গান বা কবিতা লিখতে গিয়ে অজস্র পরিবর্তন করেছেন—পছন্দ হচ্ছে না বলে। সেই কাটাকুটি করতে করতে যা শেষ অবধি তাঁর পছন্দ হয়েছে, তাকেই আমরা মুদ্রিত রূপে দেখতে পেয়ে ধন্য হয়েছি। আর, ওঁর হস্তাক্ষরে লেখা পাণ্ডুলিপির কপিতেও তাঁর অন্য পরিচয়ের রূপ ফুটে উঠেছে। সুন্দরের পূজারী কবিগুরু তাঁর শব্দ-অক্ষর কাটা-ছেড়াগুলিকে চিত্রকল্প করে সাজিয়ে রেখেছেন। কাব্য-শিল্পের সুন্দর সম্মিলন।

হ্যাঁ, যা বলছিলুম। যত লেখা আমরা মুদ্রিত বা পাণ্ডুলিপি হিসেবে পেয়েছি, সেগুলি তো কাটাকুটি বা বাতিল পৃষ্ঠাদের বাদ দিয়ে। যা লিখে গেছেন, আমরা পেয়েছি, তা ছাড়াও কত শত যে পৃষ্ঠা বাতিল করেছেন তার হিসেব রেখেছে কে? ভেবে দেখুন, একটি লেখা জুতসই করে লিখতেই আমরা হিমশিম খাই। আর, রবিঠাকুরের প্রকাশিত, অপ্রকাশিত, মুদ্রিত বা হস্তাক্ষরের পাণ্ডুলিপি ছাড়াও যে কি পরিমাণ লেখা লিখে গিয়েছেন, ভাবলে, অ্যাতো প্রকাণ্ড, যেন অন্তবিহীন কবি-জীবনের প্রতি আপনা আপনিই বিস্ময়ে, শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যায়।

একজন মহা মানুষের এক জীবনের লেখা, আমার ক্ষুদ্র ধারণায়, মনে হয়—যে কোনও মানুষ বা পাঠক একক জীবনে পড়ে শেষ করতে পারেন কি? এবং গর্ব করে বলতে পারেন কি, ‘‘আমি আগাগোড়া সমস্ত ‘রবীন্দ্রনাথ’ পড়ে শেষ করেছি’’! মনে হয় না। জানি না। শুনিনি।

সব শেষে বলব, একটি গোপন কথা। আজ যদি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মাতেন বা জীবিত থাকতেন তাহলে তাঁর হাজার স্বহস্তে লেখা পত্রাবলি আমরা পেতুম কি? লেখালিখির বদলে ‘কমিউনিকেশন’ করতেন টেলিফোনের মাধ্যমে! ‘ইন্টারনেট’ও আমাদের সঙ্গে আমাদের আপন কবির সম্পর্কের মধ্যে মস্ত অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।

কবিগুরুকে এবং তাঁর সকল সৃষ্টিকে প্রণাম জানিয়ে একটি স্বীকারোক্তি করব। অমন প্রকাণ্ড মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার ইচ্ছা ভরপুর থাকলেও, বেশি কথা বলতে মোটেই ভরসা পাই না। কারণ, তাহলে প্রকাশ হয়ে পড়বে যে, রবিঠাকুরের বিষয়ে আমি কত কম জানি! হে কবি, এই নগণ্য-ক্ষুদ্র তোমার সেই ‘আকন্দ’র মতো মানুষকে ক্ষমা করে দিও। প্রণাম।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE