রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সেই নির্দেশ।
প্রথম চার দিনে জমা হয়েছিল দেদার। সেই টাকার পাহাড় নিয়েই এখন দিশেহারা রাজ্যের ১৭টি জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক। ৫০০-১০০০ টাকার নোটে তাদের হাতে জমে গিয়েছে ৫০০ কোটি টাকার বেশি! কিন্তু রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নিষেধাজ্ঞার জেরে সরকারি-বেসরকারি কোনও ব্যাঙ্কই সেই নোট নিতে নারাজ। ফলে জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কগুলোর ভাঁড়ার এখন বাতিল নোটে ভরপুর হয়ে গিয়েছে!
এই বাতিল নোট নিয়ে তাঁরা কী করবেন, তা ভেবেই অস্থির সমবায় ব্যাঙ্কের কর্তারা। কারণ কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত পুরনো পাঁচশো-হাজারের নোট ব্যাঙ্কে জমা করতে পারবেন গ্রাহকরা। সেই নোট জমা দিলে তাঁদের নতুন ১০০, ৫০০ বা ২০০০–এর নোট পাওয়ার কথা। আর গ্রাহকদের থেকে জমা নেওয়া বাতিল নোট রিজার্ভ ব্যাঙ্কে জমা দেওয়ার কথা ব্যাঙ্কগুলির।
সেই নিয়ম মেনেই গত ১০ থেকে ১৩ নভেম্বর, প্রথম চার দিন প্রায় হাজার কোটি টাকা জমা নেয় ১৭টি জেলা কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের ৩০০ শাখা। রাজ্যে পাঁচ হাজারের বেশি প্রাথমিক সমবায় সমিতির মারফত জমা পড়ে সিংহভাগ টাকা।
প্রথম দিকে তা জমাও নিয়ে নেয় বিভিন্ন ব্যাঙ্ক। যেমন, হুগলি জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কে চার দিনে জমা হয়েছিল ১২৪ কোটি টাকা। একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কে সেই টাকার পুরোটাই ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে তারা। আবার উল্টো চিত্র নদিয়া জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কে। সেখানে ১৫০ কোটি টাকার বেশি জমা পড়লেও মাত্র ১০ কোটি টাকা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ঘরে পাঠানোর ব্যবস্থা করা গিয়েছে বলে সমবায় দফতর সূত্রের দাবি। একই অবস্থা অন্যান্য ব্যাঙ্কেও।
কেন এমন পরিস্থিতি হল?
রাজ্য সমবায় ব্যাঙ্কের এক কর্তা জানাচ্ছেন, ১৪ নভেম্বর রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এক নির্দেশে বলে দিয়েছে, জেলা সমবায় ব্যাঙ্কগুলিতে ৫০০-১০০০ নোট জমা করতে পারবেন না গ্রাহকরা। একই ভাবে জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কে জমা হওয়া বাতিল নোটের বান্ডিলও জমা নেওয়া হবে না। পরবর্তী কালে আরও একটি নির্দেশে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক জানিয়ে দেয়, জেলা সমবায় ব্যাঙ্কগুলিতে জমে থাকা বাতিল নোট কোনও ব্যাঙ্কই জমা নিতে পারবে না। যার ফলে বিপদ বেড়েছে সমবায় ব্যাঙ্কগুলির। ১৫ নভেম্বর থেকে বিভিন্ন সমবায় ব্যাঙ্কের ৩০০ শাখায় পুরনো নোট নেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু ততক্ষণে হিসেব কষে দেখা যাচ্ছে, ব্যাঙ্কগুলির হাতে রয়ে গিয়েছে ৫০০ কোটিরও বেশি।
কেন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এমন ফরমান জারি করল?
সরকারি সূত্রের খবর, ৫০০-১০০০ নোট বাতিলের আসল উদ্দেশ্য ছিল কালো টাকা খুঁজে বের করা। কিন্তু কালোর কারবারিরা সরকারি নজর এড়িয়ে তাঁদের টাকা ব্যাঙ্কে ঢোকানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। দেশে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক রিপোর্ট পায়, প্রাথমিক সমবায় সমিতিগুলির মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের নগদ জমা পড়ছে। অর্থ মন্ত্রকের ফিনান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট (এফআইইউ) খবর পায়, বেশ কিছু সন্দেহজনক লেনদেনের। এর পরই জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কগুলিতে বাতিল নোটের লেনদেন বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারণ, প্রত্যন্ত গ্রামের প্রাথমিক সমবায় সমিতিগুলিতে জমা হওয়া টাকা শেষ পর্যন্ত আসছিল জেলা সমবায় ব্যাঙ্কেই। অথচ গ্রামের সমবায় সমিতিগুলি কোর ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের মধ্যে নেই। ফলে এই সব সমিতির মোটা টাকার লেনদেন নিয়ে সন্দেহ হয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের।
রাজ্য সমবায় ব্যাঙ্কের কর্তারা অবশ্য জানাচ্ছেন, কোনও অ্যাকাউন্টে ১ কোটি টাকার লেনদেন হলেই সঙ্গে সঙ্গে তা রিজার্ভ ব্যাঙ্কে জানানোর কথা। সে সব রুটিন মেনেই জানানো হয়েছে। আর সমবায় সমিতিগুলি কোর ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের অন্তর্ভুক্ত না হলেও তারা জাবেদা খাতা রাখে। তাতেই কে কত টাকা জমা দিল, তা জানা সম্ভব। ফলে সন্দেহের বশে সমবায় ব্যাঙ্কের লেনদেনে বেড়ি পড়ানোয় আসলে রাজ্যের ৩৪ লক্ষ মানুষ বিপদে পড়েছেন। তাঁরা সমবায় ব্যাঙ্কের গ্রাহক হয়েও টাকা বদল করতে বা জমা করতে পারছেন না। পাশাপাশি যে ৫০০ কোটি টাকা জমা পড়ে রয়েছে, সেগুলির ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তিত সমবায় কর্তারা।
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সূত্রের দাবি, আপাতত ওই টাকা নিয়ে কিছুই ভাবা হচ্ছে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হোক, তার পর সমবায়ে জমা টাকার যাচাই শুরু হবে। সিদ্ধান্ত হবে সব কিছু খতিয়ে দেখেই।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এমন মনোভাবে রাজ্য সমবায় ব্যাঙ্ক কর্তাদের কপালের ভাঁজ গভীর হয়েছে। এক শীর্ষ কর্তার দাবি, ‘‘এই টাকা জমা করেই তো নতুন নোট পাওয়ার কথা। তা হলে নতুন নোটই বা পাব কী করে?’’ বীরভূমে কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের সিইও অজয় গিরি বলেন, ‘‘নোট অচল হওয়ার পরে আমাদের সব ক’টি শাখা মিলিয়ে কত টাকা ঋণ ও আমানত বাবদ জমা হয়েছে, রাজ্য কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক সেই হিসেব চেয়েছে। আমরা সেই তথ্য পাঠিয়েও দিয়েছি।
কিন্তু রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এমন কোনও নির্দেশিকার কথা এখনও পর্যন্ত জানি না। এমনিতেই আমরা চরম দুর্দশায় রয়েছি। এমনটা হলে সব দিক থেকেই ডুবে যাব।’’ সমবায় ব্যাঙ্কের এক শীর্ষ কর্তার উদ্বেগ, ‘‘জানেন, সুন্দরবনের একটি ব্যাঙ্কের ভল্টে এখন ৪ কোটি টাকা জমে রয়েছে। ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত তো ওই টাকা বাজারে চলবে। কী যে হবে, বুঝতে পারছি না। যদি ডাকাতি হয়!’’
বাতিল নোটের পাহাড়
ব্যাঙ্ক জমে রয়েছে*
• নদিয়া কেন্দ্রীয় সমবায় ১৫০.০০
• মালদহ কেন্দ্রীয় সমবায় ১০০.০০
• মেদিনীপুর বিদ্যাসাগর কেন্দ্রীয় সমবায় ৫৫.০০
• বর্ধমান কেন্দ্রীয় সমবায় ৪২.০০
• হাওড়া কেন্দ্রীয় সমবায় ৩৮.০০
• পূঃ মেদিনীপুর বলাগেরিয়া কেন্দ্রীয় সমবায় ০৯.০০
*কোটি টাকা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy