গুড়ের বাতাসা, বনজ কুন্দফুল আর সস্তার ধূপ— ধিকিধিকি ধোঁয়ার আড়ালে ‘বনগাই মাতা’র পুজো।
মোকামার টালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রান্তিক গ্রামে এ পুজোর চলন বছর কয়েক আগেও নজরে পড়ত।
বিহারের হদ্দ দেহাতের গ্রামীণ মানুষ তাঁদের সম্বৎসরের ফসল বাঁচাতে আড়ম্বরহীন সে পুজো সেরে কপাল ঠুকতেন— ‘‘বনগাই’সে বাঁচা লে মালিক!’’
দেবতার থানে ফুল-বাতাসার পুজোয় যে কাজ হচ্ছে না, বছর দুয়েক ধরেই মালুম হচ্ছিল। গ্রামীণ মোকামার ‘বনগাই মাতা’ বা নীলগাই (ব্লু বুল) ঠেকাতে এ বার তাই বারুদ-বন্দুকের ব্যবহার শুরু করল বিহার সরকার।
বন বিভাগের এক কর্তা বলছেন, ‘‘এ ছাড়া আর উপায় ছিল না। মোকামার টালে বনগাইরা ঈশ্বরের ঊর্ধ্বে চলে গিয়েছিল!’’ শেষতক, হায়দরাবাদ থেকে ভাড়াটে শিকারি এনে গত দু’দিন ধরে শুরু হয়েছে নীলগাই নিধন। কেন্দ্রীয় বনমন্ত্রক সূত্রে জানা গিয়েছে, গত দু’দিনে মোকামার টালে অন্তত ২৬০টি নীলগাই মারা হয়েছে।
আর তা নিয়েই জোর কাজিয়া বেধেছে দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর।
মহিলা ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রী মেনকা গাঁধী পশুপ্রেমীদের কাছে পরিচিত মুখ। নীলগাই হত্যা নিয়ে কেন্দ্রীয় পরিবেশমন্ত্রী প্রকাশ জাভরেকরকে ঠেস দিয়ে বুধবারই তিনি জানিয়েছেন, এটা ঘোর অন্যায়। বলেছেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে হাতি, হিমাচলে বাঁদর, গোয়ায় ময়ূর, চন্দ্রপুরে বুনো শুয়োর মারার অনুমতি দিয়েছে পরিবেশমন্ত্রক।’’
বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে পাল্টা নালিশ ঠুকেছেন জাভড়েকর। বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব অবশ্য জাভরেকরের পাশেই। কেন্দ্রীয় কৃষি প্রতিমন্ত্রী সঞ্জীব বলিয়ানও বৃহস্পতিবার কলকাতায় বলেন, ‘‘বনের বাইরে বেরিয়ে ক্ষতি করলে এ ছাড়া আর উপায় কী?’’
এ ছাড়া সত্যিই কি আর কোনও উপায় ছিল? মোকামায় মাইলের পর মাইল জুড়ে গঙ্গার পলি পড়ে থাকা উর্বর চরে সারা বছরে ফলন হয় একবারই। সর্ষে-মুলো-কপির বিপুল ফলন। আর রয়েছে সম্বৎসরের সতেজ ঘাস। তার জেরেই মোকামার টাল জুড়ে সারা বছর দাপায় নীলগাইয়ের পাল।
বাহুবলী নয়, নদী পেরিয়ে রাতবিরেতে ফসল কেটে নিয়ে যাওয়া দুষ্কৃতীও নয়, মোকামার গ্রামীণ মানুষের মূল প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছিল নীলগাই। তাদের দাপটে রাতভর মশাল জ্বেলে পাহারা দিয়েও নিস্তার মেলেনি। বন দফতরের এক কর্তা জানান, গ্রামীণ মানুষ নীলগাইদের ‘গাইমাতা’ রূপে দেখতেই অভ্যস্ত। ‘‘কিন্তু বড় অভাবী ওঁরা। সারা বছরের ফলন রাতারাতি সাবাড় করে দিচ্ছে নীলগাই। কত আর সহ্য করবেন!’’
ক্রমশ আতঙ্ক হয়ে ওঠা নীলগাই নিয়ে স্থানীয় বন দফতর, জেলা প্রশাসনের কাছে দরবার করেছিলেন চাষিরা। বিষয়টা এক সময়ে পৌঁছয় পটনা হাইকোর্টে। জনস্বার্থ মামলায় চাষিরা জানিয়েছিলেন, টালের এই ফলনের উপরেই বেঁচে থাকেন তাঁরা। তার কানাকড়িও ঘরে না উঠলে বাঁচবেন কী করে?
২০১০ সালে ওই মামলার রায় দিতে গিয়ে ধন্দে পড়েছিলেন বিচারপতিরাও। কেন্দ্রীয় বন মন্ত্রককে এ ব্যাপারে ভাবনাচিন্তার পরামর্শ দিয়েছিলেন তাঁরা। ২০১৩ সালে ভোপালে একই রকম ফসলহানি সংক্রান্ত এক আলোচনায় উঠে আসে পটনা হাইকোর্টের রায়ের সেই প্রসঙ্গ। শেষে ২০১৫ সালে, বিপন্ন প্রাণীদের তালিকার কিঞ্চিৎ হেরফের করে নীলগাইকে ৩ থেকে ৫ নম্বর ‘শিডিউল’-এ সরানো হয়। অর্থাৎ, নীলগাই নিধনের প্রশ্নে রাশ আলগা করে বনমন্ত্রক।
মন্ত্রকের এক কর্তা জানান, মোকামায় ক্রমশ বেড়ে চলা সংখ্যা বিচার করে অন্তত দশ শতাংশ নীলগাই মারার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। জাভড়েকরের কথায়, ‘‘বিহারের ৩৯টি জেলায় আপাতত ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত নীলগাই হত্যার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।’’
গত ভোটে এখানে দাঁড়িয়ে হেরে গেলেও চাষিদের পাশে দাঁড়িয়ে নীলগাই নিধনের ছাড়পত্র জোগাড়ে বিস্তর দৌড়ঝাঁপ করেছেন জেডিইউ মুখপাত্র নীরজ সিংহ। তিনি বলছেন, ‘‘গঙ্গার ওই চরে বছরে একটাই চাষ হয়। নীলগাইয়ের খুরে সেটাই যদি তছনছ হয়ে যায়, মানুষগুলো বাঁচবে কী করে!’’ মেনকার উদ্দেশে তাঁর কটাক্ষ, ‘‘নীলগাই নিধন ছাড়া দ্বিতীয় কোনও উপায় থাকলে বাতলে দিন’না মেনকা দেবী!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy