Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

জানুয়ারি কলিং

২০১৬—নতুন বছরের নতুন ক্যালেন্ডার আমাদের দরজায় সাজিয়ে দিল টাটকা একটা আস্ত বছরের বারোমাস্যা। আমাদের প্রার্থিব অনেক অনেক চাওয়া এবং পাওয়া। আমাদের আগামী, আমাদের ঘটমান ভবিষ্যৎ— শীতের মনকাড়া আমেজ মেখে জানুয়ারি কলিং। শীত তথা জানুয়ারি মানেই উৎসবের আতিশয্যে রঙে মজলিশে দেদার খুশি খুশি জম্পেশ একটা ব্যাপার।

মধুছন্দা মিত্র ঘোষ
শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:৩৭
Share: Save:

২০১৬—নতুন বছরের নতুন ক্যালেন্ডার আমাদের দরজায় সাজিয়ে দিল টাটকা একটা আস্ত বছরের বারোমাস্যা। আমাদের প্রার্থিব অনেক অনেক চাওয়া এবং পাওয়া। আমাদের আগামী, আমাদের ঘটমান ভবিষ্যৎ— শীতের মনকাড়া আমেজ মেখে জানুয়ারি কলিং। শীত তথা জানুয়ারি মানেই উৎসবের আতিশয্যে রঙে মজলিশে দেদার খুশি খুশি জম্পেশ একটা ব্যাপার। নতুন বছরের সূচনা মানেই তো সংকলন নেওয়ার দিন। বাঙালি নতুন বছরের পয়লাতে মনে মনে কত নতুন সংকল্প করে। যদিও সংকল্প রক্ষার ধারাবাহিকতার দায় তার নেই। সংকল্প পালন ও পোষণের মাহাত্ম্য এতটাই।

ক্যালেন্ডারে জানুয়ারি মানেই চড়ুইভাতি কিংবা বনভোজন চুটিয়ে। জানুয়ারি মানেই কয়েকটা ছুটি আর মস্তি। সে নতুন বছরের আনকোরা নতুন দিনটাই হোক কিংবা মনীষীদের জন্মদিন, জানুয়ারি জুড়ে সব কটা শনি-রবি, অন্যান্য ছুটির দিন, মকর সংক্রান্তি, প্রজাতন্ত্র দিবস—আনন্দ উৎসবের মহড়া চলবে সারাটা জানুয়ারি জুড়েই। এ সব ঠিকই আছে। এ সব আমাদের কাছে মোটেই নতুন কিছু নয়। কী করবে বাঙালি, ঠাকুমা-দিদিমারা নেই। জীবনযাত্রার ছাঁচটাও বদলে গিয়েছে। সময় নেই, চাপ, অকারণে আনন্দ নেই—কী করবে বাঙালি? ফলত নতুন বছরটাও কিন্তু বাঙালিয়ানার একটা অন্যতম দিন হয়ে উঠেছে।

এই পয়লা জানুয়ারি থেকে ক্যালেন্ডার নতুন একটা বছর শুরু হওয়া, ক্যালেন্ডার দিনক্ষণের হিসেব নিয়ে মতবাদও আছে। যেমন আমরা জানি যে প্রভু যিশুখ্রিস্টের জন্ম থেকে ইংরাজি সালের দিনক্ষণের হিসেব চলে আসছে। যিশুর জন্মের আগের সময় হল খ্রিষ্টপূর্ব এবং যিশুর জন্মের পর থেকে খ্রিস্টাব্দ বলা হয়ে থাকে। এই ক্যালেন্ডার সৃষ্টির পিছনে দুই জনের নাম ওতপ্রত ভাবে জড়িত। প্রথমজন হলেন, রোমের বিখ্যাত সম্রাট জুলিয়াস সিজার। এবং অপর জন হলেন পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি। বাংলার এই লৌকিক বছর হল ৩৬৫ দিন বা ১২ মাসে ১ বছর। বৈজ্ঞানিক মতে সূর্যকে প্রদক্ষীণ করতে পৃথিবীর সময় লাগে ৩৬৫ দিন, ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৭.৫ সেকেন্ড। ‘সৌর বছর’ বা ‘সোলার ইয়ার’ হিসাবে এই সম্পূর্ণ সময়টাকেই একটা সম্পূর্ণ বছরের হিসেব ধরা হয়। ভারতের বরাহমিহির তাঁর ‘সূর্যসিধান্ত’ গ্রন্থে আরও পরে ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে আর্যভট্ট ঠিক একই হিসেব দিয়ে গেছিলেন।

একেবারে প্রথম দিকে ধারণা ছিল পৃথিবীর সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে ৩৬৫ দিন সময় লাগে। খ্রিস্টপূর্ব ৪৬ সালে রোম সম্রাট জুলিয়াস সিজার আবিষ্কার করলেন যে ওটা হবে ৩৬৫ দিন ৬ ঘণ্টা। তখনই তিনি ঘোষণা করলেন, বছর ৩৬৫ দিনই হবে। বাকি ৬ ঘণ্টা প্রতিবছর ৪ বছর অন্তর ১ দিন যোগ হবে। অর্থাৎ ৬ গুন ৪ = ২৪ ঘণ্টা= ১ দিন। প্রতি ৪ বছর অন্তর যে বছরে ১টা দিন অধিক যুক্ত করতে হবে। এবং সেই বাড়তি দিনের মাসযুক্ত বছরকে লিপ ইয়ার বলা হবে। সম্রাটের নাম অনুসারে এই ক্যালেন্ডারের নাম হল ‘জুলিয়েন ক্যালেন্ডার’। এই ক্যালেন্ডারের হিসেব মত বছরে গড় দিন দাঁড়ালো ৩৬৫. ২৫ দিন।

এই হিসেব ভুল বলে প্রমাণিত হল, যখন সৌর বছর ৩৬৫ দিন, ৫ ঘণ্টা, ৪৮ মিনিট, ৪৭.৫ সেকেন্ড বলে প্রমাণিত হল। ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরির হিসেব অনুযায়ী ইংল্যান্ডে কিছুকাল ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারও চালু হয়। অতি প্রাচীন ভারতেও তিথি-নক্ষত্রের যোগ নিয়ে অনেক ভাবনা থাকলেও বর্ষারম্ভ নিয়ে একটা শক্তপোক্ত মত গড়ে ওঠেনি কখনও। পণ্ডিতরা বৈদিক ঋতু, আকাঙ্ক্ষা, আশীর্বাদ ব্যাপারটাকে একটা চিহ্ন হিসেবে ধরতেন। আর্যরা যেহেতু অতিশীতল দেশ ছেড়ে ভারতে এসেছিলেন, তাই আশীর্বাদ স্বরূপ বলতেন ‘শত হিম বেঁচে থাক’। ঋগ্বেদেও আছে, ‘শতং হিমা অশীয় ভেষজেভিঃ’। আবার একই কথা অর্থ বেদ এবং তৈত্তিরীয় সংহিতায়ও দেখতে পাওয়া যায়। ‘অতিক্রমামন্তো দুরিতা পদানি/শতং হিমাঃ সর্ববীরা মদেম।’ অর্থাৎ আমরা যারা বীর, তারা সমস্ত পাপ অতিক্রম করে একশো হিম কাটিয়ে দেব মহা আনন্দে। বেদের এই পংক্তিগুলিতে ‘শতং হিমঃ’ মানে ‘একশো শীত’। পণ্ডিতেরা বলতে লাগলেন, অত্যধিক শীতের দেশ থেকে এই যে শত বছর জীবিত থাকার ঘোষণা, তাতেই মনে হয় যেন আমরা প্রথম থেকেই বছর গণনা করতেন শীতকাল থেকেই। তবে সেই শীত ঠিক কোন মাস থেকে আরম্ভ তার কোনও নির্দিষ্ট হিসেব পাইনা আমরা বেদ থেকে।

শীত মানেই জয়নগরের মোয়া। গ্রামবাংলায় শীতকালের উপরিপাওনা, খেজুর গাছের রস থেকে তৈরি করা গুড়। সেই গুড়ের পোশাকি নাম নলেন গুড়। অনেকে আবার বলেন ঝোলা গুড়। সেই গুড় থেকেই তৈরি হয় সুস্বাদু পাটালি। টুকরো পাটালির স্বাদ ও গন্ধই আলাদা।

গ্রাম বাংলায় সদ্য মাঠ থেকে ধানের ছড়া তুলে তা কিছুটা রেখে দেওয়া হয়। নতুন ধান পবিত্র। তাতে লক্ষ্মীর বসত। আর জিরেন কাঠের প্রাপ্তি নলেন গুড়। মোয়ার রহস্য লুকিয়ে আছে এর বিশেষ ধরনের খইয়ের মধ্যে। সেটা হল কনকচূড় ধানের খই। দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগর, বহড়ু, মজিলপুর, নিমপীঠ ও তার আশপাশের অঞ্চলে এক ধরনের ধান উৎপন্ন হয়। সোনার মত রং আর মাথায় শুঁড়ের মতো একটা চূড়া। এলাকার মানুষ সেই ধানের নাম রাখেন কনকচূড় ধান। এই ধান থেকে এলাকার মানুষ খই ভাজেন। এই খই আর পাঁচটা ধানের খইয়ের থেকে একদম আলাদা। নলেন গুড়-এলাচ-গাওয়া ঘি-কাজু-কিসমিস-কনকচূড় খইয়ের অদ্ভুত জাদুকরিতে সৃষ্টি হয় শীত আভিজাত্যের আসলি চিজ। এই মোয়া শীতকে প্রকাশ করে।

মোয়া প্রস্তুতকারক ব্যবসায়ীরা ৫ অঘ্রাণ তারিখকে মোয়া বানানোর প্রথমদিন হিসেবে মাণ্যতা দিয়ে কাজ শুরু করেন। আবার অনেকে রাস পূর্ণিমার দিনকে শুভদিন ধরে কাজ শুরু করেন। খুব শীত না পড়লে মোয়া পাওয়া যাবে না। শীতেই পাওয়া যাবে নলেন গুড় আর কনকচূড় খই। জয়নগর, বহড়ু, মদিলপুর, নিমপীঠ এলাকার মোয়া ব্যবসায়ী তাঁদের প্রথম তৈরি মোয়াটি নিবেদন করেন এই অ়ঞ্চলের প্রণম্য দেবতা ধন্বন্তরী মাতা, জয়চণ্ডী মাতা ও রাধাবল্লভকে। তার পর টানা তিন মাস মত চলে মোয়ার ব্যবসা।

তবে এ কথাও সত্যি কৌলীন্য হারাচ্ছে জয়নগরের মোয়া। শীত পড়তে না পড়তেই গোটা কলকাতা ও শহরতলি জুড়ে যে মোয়ার ছড়াছড়ি সেগুলোকে জয়নগরের মানুষরা বলেন, ‘কেড়ো মোয়া’। আসল মোয়া কিন্তু বাজারে আসতে সময় লাগবে অনেক। শিউলি সম্প্রদায়ের হাতে তৈরি খেজুর গাছের জিরেন কাঠের রস থেকে নলেন গুড় তৈরি হয়ে সেটি কনকচূড় ধানের খইয়ের সঙ্গে রসায়ন তৈরি হচ্ছে না হচ্ছে, ততদিনে জয়নগরের মোয়ার মূল স্বাদ পাওয়া যাবে না। মোয়া তৈরিতে যে সমস্ত মূল কাঁচামাল লাগে, সেগুলির পরিবর্তে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী জয়নগরের মোয়ার নাম দিয়ে যা খুশি বানাচ্ছেন। এরা চিনির গাদ, এসেন্স, চায়ের লিকার, মরিশাল ধানের খই ও সামান্য গুড় ছিটিয়ে মোয়া তৈরি করেন। এই মোয়া খুবই শুকনো। সেখানে জয়নগরের মোয়া খুব নরম ও মুখে দিলে গলে যাবে। আরও একটা ব্যাপার জয়মোয়াতে ক্ষীর জাতীয় কিছু থাকে না। সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য কেড়ো মোয়ায় সাদা রঙের ক্ষীর ময়দার গুড়ো ছেটানো হয়।

জয়নগরের মোয়া নিয়ে অনেক গল্প হল। ইতিমধ্যে সামনেই আসছে পৌষসংক্রান্তি। প্রতি উৎসব পালনেরই নিজস্ব প্রথা আছে। পৌষ সংক্রান্তি মানেই পিঠেপুলি। বাঙালির পৌষসংক্রান্তির আয়োজনে নারকেল কোরা আর টাটকা খেজুর গুড়ের অনবদ্য রসায়নে পিঠের মৌতাত। শীত মানেই পিঠে পার্বণের মাস। বাঙালির গৃহস্থালিতে পিঠে তৈরির প্রস্তুতিও চলে জোরদার। নতুন ধানের চালের গুঁড়ো, ঘড়াভর্তি খেজুর গুড়ের মায়াবি তরল পাটালি—পৌশপার্বণ মানেই নবান্নের আহ্বান। সুগন্ধি আতপ চালের সঙ্গে খেজুর গুড়ের অকৃত্রিম চেনা কৌলিন্য। কত বাহারি নাম—গোকূল পিঠে, পাটিসাপটা, সিদ্ধ পুলি, রাঙা আলুর পুলি, ছানার পুলি, চুষি পিঠে, দুধ পুলি, রসবড়া, চৈতি পিঠে, ভাপা পিঠে, মুগডালের পিঠে, নারকেল পুলি পিঠে, নলেন গুড়ের পায়েস, মালপোয়া। বাঙালির রসনাকে প্রলুব্ধ করতে কত বৈচিত্র কত আয়োজন। খেয়েও তৃপ্তি, খাওয়াতেও।

আবার এ পার বাংলায় যেটি ‘পিঠে’ সেটি ওপার বাংলায় বলা হয় ‘পিঠা’। শীতের দোসর আমাদের কাছে ‘পিঠে’ মানেই মিষ্টি জাতীয় মুখরোচক পদ। কেজুর রস বা চিনির রস-দুধ-নারকেল কোরা দিয়ে প্রস্তুতি মিষ্টান্ন। অথচ ওপার বাংলায় নাকি মিষ্টি স্বাদ ছাড়াও কিছু পিঠে প্রস্তুত করা হয় নোনতা বা ঝাল জাতীয়। যেমন বরিশালের জনপ্রিয় পাকন পিঠা কিংবা মুগ পাকন পিঠা। এ ছাড়াও বাঙাল বাড়িতে কলার পিঠা, গোপাল পিঠা, ভাপা পিঠা, বিবিখানা পিঠা, নকশি পিঠা, আমকে পিঠা, চিঁড়ের পিঠা, খাঁজের পিঠা, ছিটা পিঠা, খেজুর পিঠা, ডিমের পান্তুয়া পিঠা ইত্যাদি হরেকরকম পিঠা প্রস্তুত হয়। ওখানে উল্লেখযোগ্য শুধুমাত্র নিরামিশ নয়—ডিম, শুঁটকি মাছ, অনান্য মাছ ও মাংস ও ওপার বাংলার পিঠা প্রস্তুতিতে দিব্যি ব্যবহার হয়।

কিছু সনাতনী পিঠের রেসিপি মুম্বই ক্রোড়পত্রের পাঠকবৃন্দের জন্য শেয়ার করা যাক:

সেদ্ধ পুলি

উপকরণ: ২ কাপ চাল গুঁড়ো, দেড় কাপ তাজা নারকেল কোরা, গরম জল সেদ্ধ করার জন্য, এক কাপ গুড়, সামান্য নুন।

পদ্ধতি: অনেকটা ইডলির মতো প্রস্তুতি। ময়দা নারকেল গুড় এক সঙ্গে মেখে হাতের তালুতে চ্যাপ্টা আকার দিয়ে ইডলি পাবে সাজিয়ে গরমজল-সহ আঁচে ভাল করে ফোটাতে হবে। মাঝে মাঝে ঢাকা খুলে দেখে নিতে হবে সেদ্ধ হয়েছে কিনা। যখন নরম অথচ হাতে বা চামচে লেগে যাবে না, তার মানে সেদ্ধ পুলি তৈরি। ঝোলাগুড়ের সঙ্গে অনবদ্য।

চিঁড়ের পিঠে

উপকরণ: ২ কাপ চিঁড়ে, ১ কাপ কোরা, দু’কাপ গুড়, ১ কাপ ময়দা, ভাজার ঘি।

পদ্ধতি: নারকেলের সঙ্গে গুড় মেখে ননস্টিক প্যানে মাখামাখা করে নিতে হবে। অন্য পাশে চিনি বা গুড়ের সিরাপ করে ঠান্ডা করে রাখতে হবে। এ বার চিঁড়ে গরম জলে ধুয়ে জল ঝরিয়ে মেখে নিতে হবে ঠেসে ঠেসে। মাখা মণ্ড থেকে একটা গোলা নিয়ে ভেতরে নারকেলের পুর দিয়ে গড়ে রাখতে হবে। এ বার ওই পুরভরা চিঁড়ের পিঠে ছাঁকা ঘি-তে লাল করে ভেজে চিনির রসে ফেলতে হবে। কিছু সময় রেখে পরিবেশন করতে হবে।

সরু চাকলি

উপকরণ: ১/২ কাপ চাল, আদা রস, ১ কাপ কলাইডাল, সামান্য মরিচ গুঁড়ো, পরিমাণ মতো নুন, ভাজার জন্য সাদা তেল।

পদ্ধতি: চাল ও ডাল আলাদা পাত্রে ২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। জল ছেঁকে এক সঙ্গে মিক্সিতে বেটে ঢাকা দিয়ে আরও ২ ঘণ্টা রেখে দিতে হবে। এর পর ওই মিশ্রণে আদার রস, নুন, মরিচ গুঁড়ো, এক চিমটে খাবার সোজা দিয়ে ভাল করে ফেটিয়ে আরও আধঘণ্টা রেখে দিতে হবে। ননস্টিক প্যানে সাদা তেল ছিটিয়ে একে একে ধোসার মত গোল করে এপিঠ ওপিঠ ভেজে তুলে রাখতে হবে। ঝোলা গুড়ের সঙ্গে জুবিয়ে সরু চাকলি—আহা!

জাফরানি পাটিসাপটা

উপকরণ: ১ কাপ আতপ চাল গুঁড়ো, ১/২ কাপ ময়দা, সুজি ২ চামচ, ১ কাপ দুধ, কেজুর গুড় ১ কাপ, নুন এক চিমটে। এ ছাড়া পুরের জন্য ১ কাপ ঘন দুধ, ১ কাপ খোয়া ক্ষীর, ১টা ছোট্ট দারচিনি গুঁড়ো, জাফরান দুধে ভেজানো, নারকেল কোরার বদলে ড্রাই ফ্রুট কুচি ও কনডেন্স মিল্ক আধ কাপ।

পদ্ধতি: সব উপকরণ এক সঙ্গে মিশ্রণ করে ১ ঘণ্টা রেখে দিতে হবে। তবে মিশ্রণটি যেন বেশ গাঢ় হয়। তলা ভারি পাত্রে পুরের মিশ্রণটি দিয়ে ঢিমে আঁচে নাড়তে হবে যতক্ষণ না পুরটা বেশ টেনে আসবে। এ বার ননস্টিক প্যানে ধোসার মতো ভেজে, মাঝখানে ক্ষীরের পুর দিয়ে পাটিসাপ্টার আকারে ভেজে নিতে হবে। পাটিসাপটা ঠান্ডা খেতেই ভাল লাগে।

গোকুল পিঠে

উপকরণ: ২ কাপ কুচনো খোয়া, ১ কাপ ময়দা, ২ টেবিল চামচ সুজি, ২ টেবিল চামচ দই, ২ টেবিল চামচ চিনি (মাখার সময়) ১ চা চামচ এলাচ গুঁড়ো, ২ কাপ গুড় অথবা চিনি, ভাজার জন্য ঘি।

পদ্ধতি: ননস্টিক প্যানে গুড় জল ও এলাচ গুড়ো মিশিয়ে ক্রমান্বয়ে নাড়তে হবে। ক্রমশ মিশ্রণটি মণ্ড হয়ে এলে ঠান্ডা করে, হাতের তালুতে তেল মেখে গোল গোল খোয়ার বল তৈরি করতে হয়। তার পর দই ও ময়দা মাখা মিশ্রণে খোয়ার বল ডুবিয়ে, ছাঁকা ঘি বা সাজা তেলে লাল ও কড়া করে ভেজে চিনির রসে ২০-২৫ মিনিট ডুবিয়ে তুলে নিলেই হয়ে গেল গোকুল পিঠে।

বাঙালির ঋতুযাপনে শীত মানেই বেরিয়ে পড়া। শীত খুশিয়ালিতে ছোট্ট সফর, কেক কফি, লংড্রাইভ, উইক এন্ড ট্রিপ। সেই ৫০ এর দশকেও শীতযাপন মানেই বাক্স প্যাটরা গুছিয়ে ট্রেনে পশ্চিমে পাড়ি ব্যাপারটাই ছিল। ওটাই পশ্চিমের হাওয়াবদল। আর পশ্চিম মানে নেহাতই যশিডি, গিরিডি, মধুপুর, দেওঘর, শিমলতলা, হাজারিবাগ, ম্যাকল্যাক্সিগঞ্জ ইত্যাদি। অনেক অভিজাত ব্যক্তিত্ব ও ব্যবসায়ী বাঙালি এই সব অ়ঞ্চলে বাড়িও বানিয়ে রেখেছিলেন। ছুটিছাটায় সেখানে সপরিবারে সেখানে টিলা পাহাড় নদী ঝরনার সঙ্গে কাটিয়ে আসতেন কিছুদিন।

এখন তো শীত মানেই সেলিব্রেশন অফিস পিকনিক। ডেইলি প্যাসেঞ্জার গ্রুপের পিকনিক, আবাসনের পিকনিক, ফেসবুক এর বিভিন্ন গ্রুপ অথবা স্কুল বা কলেজ জীবনের হারিয়ে যাওয়া ও হঠাৎ ফিরে পাওয়া গ্রুপ, লেডিস উইংস ক্লাব গ্রুপ এর সঙ্গে শীতের কুসুম রোদ্দুরে অন্যরকম দিন বা সন্ধে যাপন। অথচ এক প্রজন্ম আগেও পিকনিক বলতে ছিল হিমেল সন্ধেতে বা দুপুরে বন্ধুর বাড়ির ছাদে বা বাগানে ফিস্ট করা। ইটের উনুন বা স্টোভে ডিমের ঝোল আর ভাত। তার জন্য এক কৌটা চাল, কিছুটা তেল, দুটো আলু, একটা পেঁয়াজ, কয়েক কোয়া রসুন আদা, হলুদ নুন লঙ্কা, দুটো হাঁসের ডিম এনে জড়ো করা হল। ওই দিয়েই জমাটি ফিস্ট ও একগুচ্ছ উপচে পড়া আনন্দ।

তারও পরে বাড়ির প্রিয়জন, পাড়াতুতো পরিবার ও অন্যান্যদের সঙ্গে নীল আকাশের তলায় সারা দিনের আউটিং। বাস ভাড়া করে সবাই মিলে বাসে করে চেনা অচেনা জায়গায়, পাহাড়টিলা বা নদী আছে, পার্ক আছে, মহিলাদের ওয়াশরুম এর বন্দোবস্ত আছে এমন জায়গায় যৌথ রান্নাবাড়ি। বাসের মধ্যেই বিলি করা বাক্সে দু’পিস মাখন মাখা পাউরুটি, কলা, মোয়া, ডিম সিদ্ধ ও কমলালেবু। পিকনিকে গিয়ে বড়রা পই পই করে বলে দিতেন— বাচ্চারা খাবে, সেই মতো যেন ঝাল দেওয়া হয় রান্নায়। কিন্তু দেখা যেত অবেলায় ভাতের ঢেকচি নামলো। বাঁধাকপির তরকারিতে বলুদ বাটার কাঁচা গন্ধ। মাংস ভাল সেদ্ধ হয়নি। আর রান্নায় এত ঝাল যে টাগরা দিয়ে আগুনের ফুলকি ছুটছে। আমাদের বিশ্বায়িত বাঙালি জীবনে শীত বারংবার ফিরে ফিরে আসে। কিন্তু সেই আধ কাঁচা মাংসের ঝোল, হাপুস নয়নে রান্নার ঝাল, টম্যাটো খেজুর আমসত্ত্বের ট্যালানি চাটনি, ভাতটাও হয়তো আরও এক ঝলক বেশি ফোটার দরকার ছিল—অসম্পূর্ণ অথচ খুশিয়াল পিকনিকের ছোটবেলার নস্টালজিয়া কিন্তু মনের দেরাজে অম্লান হয়ে থাকে আজও।

শীত মানেই পৌষপার্বণ বা মকরসংক্রান্তির বনেদি ঐতিহ্য। একটা সার্বিক প্রবচন আছে ‘‘সব তীর্থ বারবার, গঙ্গাসাগর একবার’’। পুণ্যের রসদ পুরণের লক্ষে সাগরসঙ্গমে পৌষসমক্রান্তিতে পুণ্যস্নান। বঙ্গোপসাগর উপকূলে একসময়ে ধু ধু প্রান্তর শ্বেত দ্বীপই বর্তমানে সাগরদ্বীপ নামে পরিচিত। প্রাচীন নথিপত্র বলে যে এই ১৭০ বর্গকিমি এলাকা জনবসতিপূর্ণ অবস্থায় ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দে প্রবল জলোচ্ছ্বাসে বিলীন হয়ে যায়। এখন দক্ষিণ ২৪ পরগনার গঙ্গা ব-দ্বীপ ১০০ কিমি দূরত্বে কলকাতা থেকে। এখন এই সাগরদ্বীপে মোট ৪৩ গ্রাম ও ১৬০,০০০ মানুষের বসবাস। সবচেয়ে বড় গ্রামটির নাম গঙ্গাসাগর বা সাগরদ্বীপ। হিন্দুদের একটি পবিত্র তীর্থস্থান। কথিত আছে মেদিনীপুরের এক ধার্মিক রাজা খাঁদুরাম, দরিয়াপুর থেকে যাত্রী নিয়ে নৌকায় সাধু, সন্ন্যাসী ও তীর্থপিপুসাদুরে যাতায়াতের ব্যবস্থা করেন। তবে এখন তো প্রতিবছর পৌষসংক্রান্তিতে সাগরমেলায় সাধুসন্তদের ভিড় চোখে পড়ার মতো। আখরাগুলোতে সাধুদের ভিড় বাড়ে। নাগা সন্ন্যাসীদের ধুনি ছাই মেখে উদ্দাম অবাধ বিচরণ।

গঙ্গাসাগরের অন্যতম আকর্ষণ কপিলমুণির মন্দির। একদিন সাগর রাজার ঘোড়াদের দেবরাজ ইন্দ্র চুরি করে নিয়ে গেল। রাজা তার ৬০,০০০ পুত্রকে পাঠালেন সেই অশ্বদের খোঁজে। ইন্দ্র ঘোড়া-সহ লুকিয়ে ছিলেন কপিলমুণির আশ্রমের নাগালেই। রাজপুত্ররা কপিলমুণিকে চোর অপবাদ দিলে কপিলমুণি মিথ্যা কলঙ্কের দোষারোপের জন্য ৬০,০০০ পাজপুত্রকে ভস্ম করে পাতালে ফেলে দিলেন। সাগর রাজার কাতর অনুরোধে কপিল মুণি শর্ত দেন একমাত্র পার্বতী যদি মর্তে আসেন তা হলে সেই গঙ্গাজলের পদস্পর্শে রাজপুত্ররা জীবন ফিরে পাবেন। রাজা ভগীরথ শিবের জটা থেকে নির্গত পার্বতী তথা গঙ্গাকে মর্তে আনয়ন করেন। এবং রাজপুত্রেরা মোক্ষলাভ করেন। এবং গঙ্গা মর্তেই থেকে যান। মকরসংক্রান্তির পুণ্যতীথিতে গঙ্গার মর্তে আগমনের পুণ্যলগ্ন ধরা হয় এবং কুম্ভমেলা হয় প্রতি বারো বছর অন্তর। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় খ্রিস্ট্রিয় ৪৩৭ অব্দে নদূর গতি পরিবর্তনের কারণেই সমগ্র মন্দিরটি সমুদ্রের গ্রাসে বিলীন হয়ে যায়। বর্তমান মন্দিরটি আদি মন্দির থেকে ২ কিমি দূরে স্থলভাগের ওপর অবস্থিত। মোহান্ত রামদাস মহারাজ বর্তমান মন্দিরটি পুনর্নিমাণ করেন। পরম্পরা মেনে এখনও দিনে পাঁচবার পুজো হয় কপিলমুণি মন্দিরে।

পাকনা পিঠে (ওপার বাংলার)

উপকরণ: পাকা কলা ১টা, চাল গুঁড়ো ১ কাপ, ময়দা ১/৪ কাপ, চিনি স্বাদ অনুযায়ী, এক চিমটে বেকিং পাউডার, সামান্য নুন ও সাদা তেল ভাজার জন্য।

পদ্ধতি: শুকনো পাত্রে ময়দা, চাল গুঁড়ো, নুন ও বেকিং পাইডার দিয়ে ভাল করে মিশিয়ে নিতে হবে। কলা ভাল করে চটকে মিহি করে ওই ময়দার মিশ্রণে আন্দাজ মতো জল দিয়ে মেখে আধঘণ্টা ভিজে কাপড় মুড়ে রেখে দিতে হবে। কিছু পরে ওই মণ্ড থেকে ছোট ছোট লেচি কেটে তেল মাখানো বোর্ডে বা চাকিতে রেখে আঙুলের সাহায্যে চ্যাপটা পাঁপড়ের মতো আকার দিয়ে ছাঁকা তেলে ভেজে তুলে নিতে হবে। এই পিঠে গরম গরম খেতে ভাল লাগে। ঠান্ডা হলে শক্ত হয়ে যেতে পারে।

নলেন গুড়ের পায়েস

উপকরণ: গোবিন্দভোগ চাল ১ মুঠো ধুয়ে আধ ঘণ্টা ভেজানো, ঘন সরওলা দুধ ১ লিটার, তেজপাতা ২টা, সবুজ এলাচগুঁড়ো ছোট ১ চামচ, কাজু ও কিসমিস ১ কাপ, নলেন গুড় পরিমাণ ও স্বাদ মতো। দু’চামচ গাওয়া ঘি।

পদ্ধতি: ভারি পাত্রে গাওয়া ঘি ও তেজপাতা দিয়ে কাজু ও চাল ভেজা সামান্য নেড়ে দুধ দিয়ে ভাল করে ঢিমে আঁচে ফোটাতে হবে। মাঝে মাঝে হাতা দিয়ে নাড়াতে হবে যেন কখনওই তলা ধরে না যায়। বেশ ঘন হয়ে চাল সুসিদ্ধ ও সুগন্ধ বার হলে, আঁচ থেকে নামিয়ে রুম টেম্পারেচারে ঠান্ডা হতে দিতে হবে। ভাল মত ঠান্ডা হয়ে এলে এ বার পায়েসের ভেতর নলেন গুড় ও ভিজিয়ে রাখা কিসমিস দিয়ে ভাল করে মিশিয়ে নিতে হবে। গরম পায়েসে নলেন গুড় দিলে অনেক সময় দুধ কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

দুধপুলি

উপরকরণ: ১ কাপ নারকেল কোরা, গুড় ১ কাপ, আমন্ড বাদাম কুচো ২ টেবিল চামচ, আতপ চাল গুঁড়ো ১ কাপ, জল-১ কাপ, আধ চা চামচ ছোট এলাচ গুঁড়ো, সামান্য নুন, ঘন দুধ ১ লিটার।

পদ্ধতি: ফোটানো ঘন দুধ ঠান্ডা করে পাশে রেখে দিতে হবে। অন্য পাত্রে নারকেল কোরা ও গুড় দিয়ে মাঝারি আঁচে রেখে ক্রমাগত নেড়ে শুকনো করে নিতে হবে। গরম জলে আতপ চাল, এক চিমটে নুন দিয়ে মসৃণ করে মাখতে হবে। এ বার ওই মিশ্রণ থেকে কুড়ি বাইশটা ছোট ছোট লেচি কেটে লুচির মতো বেলে, ভেতরে নারকেলমাখা পুর ভরে অর্ধচন্দ্রাকারে পুলির পিঠের দুই প্রান্ত আটকে নিতে হবে। ঠান্ডা দুধে পাটালি ভাল করে মিশিয়ে রাখতে হবে। পুলিগুলো ভাপিয়ে সেদ্ধ করে নিয়ে দুধের মধ্যে ফেলে রেফ্রিজেরাটে ঠান্ডা করে দুই দিন খাওয়া যেতে পারে।

মুগ পাকন পিঠে

উপকরণ: চাল গুঁড়ো ১ কাপ, মুগ ডাল ভেজানো ১ কাপ, ময়দা ১ কাপ, সবুজ এলাচ গুঁড়ো, চিনি ১ কাপ, চিনির রস, ১ চিমটে নুন স্বাদ মতো, ভাজার জন্য সাদা তেল।

পদ্ধতি: ভেজানো ডাল ননস্টিক কড়াইয়ে তিন কাপ জলে সেদ্ধ করে নিতে হবে। ডাল সুসিদ্ধ না হলে আরও একটু জল দিয়ে সুসিদ্ধ ও নরম হলে এবং জল পুরোপুরি শুকিয়ে এলে, এতে ময়দা ও চালগুঁড়ো দিয়ে আরও খানিকক্ষণ ক্রমাগত নাড়াতে হবে। এক চিমটে নুন ও এলাচ গুঁড়োও মিশিয়ে দিয়ে ভাল করে নরম মণ্ড তৈরি হলে, নামিয়ে ঠান্ডা করে নিতে হবে। এ বার ওই মণ্ড থেকে ছোট লেচি কেটে ছোট পাশবালিশের মতো গড়ে ছাঁকা তেলে ভেজে আগে থাকতে তৈরি চিনির রসে ২ ঘণ্টা রেখে, রস ঝরিয়ে ঠান্ডা হলে এয়ারটাইট বাক্সে রেখে কয়েক দিন পর্যন্ত রেখে খাওয়া যেতে পারে।

অন্য বিষয়গুলি:

2016 winter pithe madhuchchanda mitra ghosh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE