সকাল সাড়ে দশটায় সুপ্রিম কোর্টের এজলাসে প্রধান বিচারপতি রায় পাঠের পরেই খবর ছড়িয়ে পড়ল, তিন তালাক নিয়ে শীর্ষ আদালত মোদী সরকারের দিকেই বল ঠেলে দিতে চলেছে। প্রধান বিচারপতি বললেন, তিন তালাক মুসলিমদের ব্যক্তি আইনের অংশ। ফলে তা মৌলিক অধিকারের মধ্যেই পড়ে। প্রয়োজনে কেন্দ্রই আইন করুক।
কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই নাটকীয় মোড়। বোঝা গেল, প্রধান বিচারপতি নিজেই এখানে সংখ্যালঘু বিচারপতিদের দলে। পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চে তিন জনই তিন তালাক রদ করার পক্ষে। আর সংখ্যাগরিষ্ঠের মত বলে সেটাই শীর্ষ আদালতের রায়!
তিন তালাকের সাংবিধানিক বৈধতা বিচারের জন্য পাঁচ ধর্মের পাঁচ বিচারপতিকে নিয়ে বেঞ্চ গঠন করা হয়েছিল। প্রধান বিচারপতি শিখ। বাকি চার জন হিন্দু, মুসলিম, পার্সি ও খ্রিস্টান। আদালতের গরমের ছুটির মধ্যেই ছ’দিন শুনানি হয়। আজ রায়ের সময় দেখা গেল, প্রধান বিচারপতি জগদীশ সিংহ খেহর ও বিচারপতি আব্দুল নাজির রায় দিয়েছেন, এক নিঃশ্বাসে তিন বার তালাক বলে বিবাহবিচ্ছেদের প্রথা সুন্নি মুসলিমদের মধ্যে ১৪০০ বছর ধরে চলছে। ধর্ম বিশ্বাসের বস্তু, যুক্তি মেনে চলে না। আদালত মুসলিমদের ব্যক্তি আইন খারিজ করে দিতে পারে না। উচিত পন্থা হলো, সংসদ এ বিষয়ে আইন তৈরি করুক।
আরও পড়ুন: বোরখার ফাঁকে জয়ীর চোখ
বিচারপতি কুরিয়েন জোসেফ এই যুক্তি মানেননি। তিনি নিজের রায়ে বলেন, ‘‘তিন তালাক ইসলামেরই অংশ, প্রধান বিচারপতির এই রায়ের সঙ্গে একমত হওয়া খুবই কঠিন।’’ তাঁর যুক্তি, তিন তালাক পবিত্র কোরানেরও বিরোধী। ফলে তা শরিয়তের অংশও হতে পারে না। এবং তা ধর্মাচরণের মৌলিক অধিকারের মধ্যেও পড়ে না। ধর্মে যা খারাপ, আইনের চোখেও তা খারাপ। সংবিধানে ধর্মাচরণের অধিকার দেওয়া রয়েছে ঠিকই। কিন্তু সেখানে সামাজিক শৃঙ্খলা, স্বাস্থ্য, নৈতিকতার মতো শর্তও রয়েছে। সব থেকে বড় কথা, তিন তালাকের সঙ্গে ধর্মীয় প্রথা বা বিশ্বাসের কোনও যোগাযোগ নেই। তাই একে সাংবিধানিক সুরক্ষা দেওয়ারও প্রশ্ন ওঠে না। বহু বছর ধরে চলছে বলেই তা বৈধ হয়ে যায় না।
তিন তালাক মামলা
• ২৩ এপ্রিল, ১৯৮৫:
শাহ বানো মামলায় সুপ্রিম কোর্ট বলল, তালাক-এ-বিদ্দতের অজুহাতে খোরপোষ দেওয়ার দায় এড়ানো যাবে না। পরের বছর সংসদে আইন এনে সেই নির্দেশ খারিজ করে রাজীব গাঁধী সরকার।
• ১০ অক্টোবর, ২০১৫:
তালাক-এ-বিদ্দত অবৈধ ঘোষণার আবেদন নিয়ে সায়রা বানু সুপ্রিম কোর্টে। পরে আরও চার আবেদনকারিণীর মামলা একত্র করা হয়। তিন তালাকের সঙ্গে জোড়ে নিকাহ হালালা এবং বহুবিবাহ রদের আবেদনও।
• ২৯ জুন, ২০১৬:
সাংবিধানিক কাঠামোর কষ্টিপাথরে তিন তালাকের বৈধতা খতিয়ে দেখা হবে, জানাল সুপ্রিম কোর্ট।
• ৭ অক্টোবর, ২০১৬:
এই প্রথম তিন তালাক প্রথার বিরুদ্ধে সওয়াল কেন্দ্রের। ধর্মনিরপেক্ষতা ও মহিলাদের সমানাধিকারের ভিত্তিতে তিন তালাক, নিকাহ হালালা এবং বহুবিবাহের ন্যায্যতা খতিয়ে দেখার আর্জি।
• ৯ ডিসেম্বর, ২০১৬:
ব্যক্তিগত অধিকার সংক্রান্ত আইন সংবিধানের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করতে পারে না, বলল ইলাহাবাদ হাইকোর্ট।
• ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬:
তিন তালাক, নিকাহ হালালা এবং বহুবিবাহের বৈধতা খতিয়ে দেখতে পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ গ়ড়ার সিদ্ধান্ত।
• ২৭ মার্চ, ২০১৭:
তিন তালাক প্রথা খতিয়ে দেখার এক্তিয়ার আদালতের নেই, সওয়াল মুসলিম পার্সোনাল ল’বোর্ডের।
•১১ মে, ২০১৭:
সাংবিধানিক বেঞ্চে শুনানি শুরু। নিকাহ হালালা বা বহুবিবাহ নয়, শুধু তালাক নিয়েই শুনানির নির্দেশ।
• ২২ অগস্ট, ২০১৭:
তিন তালাক প্রথা অসাংবিধানিক, রায় সুপ্রিম কোর্টের।
এর পর বিচারপতি রোহিনটন এফ নরিম্যান তাঁর ও বিচারপতি ইউ ইউ ললিতের রায় পড়ে যুক্তি দেন, ১৯৩৭ সালের মুসলিম পার্সোনাল ল’ বা শরিয়ত প্রয়োগ আইনে তিন তালাককে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ফলে তা দেশে চালু আইনের মধ্যেই পড়ে। সেই আইন সাংবিধানিক ভাবে বৈধ কি না, তারও পরীক্ষা দরকার। তিন তালাকের অপব্যবহারে যথেচ্ছাচার হতে পারে। তা সংবিধানে ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে প্রদত্ত সাম্যের অধিকারের বিরোধী। ২৫(১) অনুচ্ছেদে দেওয়া ধর্মাচরণের অধিকারেও সেটি সুরক্ষিত নয়।
প্রধান বিচারপতি ও বিচারপতি নাজিরের মত ছিল— সরকারকে ছ’মাস সময় দেওয়া হোক। তত দিন তালাক-এ-বিদ্দত বা তাৎক্ষণিক তালাকের উপরে স্থগিতাদেশ থাকুক। তাঁদের রায় ছিল, সরকার যখন আইন তৈরি করবে, তখন ব্যক্তি আইন বা শরিয়তে যে সব অগ্রগতি ঘটেছে, সেগুলোও খতিয়ে দেখবে। কিন্তু অন্য তিন বিচারপতি এই মুহূর্ত থেকেই তিল তালাক খারিজ করার পক্ষে রায় দেন। নরিম্যান যুক্তি দেন, তিন তালাক প্রথাকে পুরুষরা নিজেদের ইচ্ছেমতো কাজে লাগাচ্ছে।
সংখ্যাগরিষ্ঠের মত যে হেতু তিন তালাক রদ করে দেওয়ারই পক্ষে ছিল, তাই ৩৯৫ পৃষ্ঠার রায়ের শেষে বলা হয়, ৩:২ অনুপাতে সংখ্যাগরিষ্ঠের রায় মেনে তিন তালাক খারিজ করে দেওয়া হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ আইনজীবীদের মতে, বহু বছর পরে সাংবিধানিক বেঞ্চে ভিন্ন মতের ভিত্তিতে রায় হল। প্রধান বিচারপতি নিজেই সংখ্যালঘু বিচারপতিদের দলে, এমন ঘটনাও বহু দিন পরে ঘটল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy