দেশে বিজেপি এখন জাতীয় বিকল্প। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গেও প্রধান বিকল্প হয়ে দাঁড়াচ্ছে তারা। লোকসভা নির্বাচন অনেকটা প্র্যাকটিস ম্যাচ। এর পর আছে কলকাতা পুর নির্বাচন। তার পর বিধানসভা ভোট। এই দুই নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ জয় করার পথে দাবার ঘুটি সাজাতে ব্যস্ত দল। (যে কারণে নরেন্দ্র মোদী ইতিমধ্যেই তিন বার এসেছেন রাজ্যে। আসবেন আরও দু’দফা) যদিও এত দিন ধরে বিজেপি-র কাছে পশ্চিমবঙ্গের তেমন কোনও গুরুত্ব ছিল না। কিন্তু সেই অবস্থা ক্রমেই পাল্টাচ্ছে।
আমদাবাদে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে বসে আনন্দবাজার পত্রিকাকে দেওয়া এক সবিস্তার সাক্ষাৎকারে পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে বিজেপি-র সেই বদলে যাওয়া কৌশল ব্যাখ্যা করেছেন দলের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদী। আশা করছেন, পশ্চিমবঙ্গে ‘মিরাক্ল’ হবে। এবং তৃণমূলের নৌকা ডুববে।
তবে এত সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গ এবং তৃণমূলকে আলাদা করে দেখতে আগ্রহী নরেন্দ্র মোদী। তিনি বলেছেন, রাজ্যের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে আর্থিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টা তিনি করবেন। রাজ্যের ঋণ মকুব করবেন কি না, সেটা সরাসরি বলতে এখনও নারাজ। তবে জট ছাড়াতে ‘সব রকম’ সাহায্য করবেন। নরেন্দ্র মোদীর বক্তব্য, ঋণ মকুব নয়, শিল্পায়নই রাজ্যের আর্থিক সমস্যার আসল সমাধান। মোদী বলেছেন, টাটাদের ছোট গাড়ির কারখানা পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে গুজরাতে আসায় মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি খুশি হয়েছিলেন। তবে প্রধানমন্ত্রী হলে সিঙ্গুরের সঙ্কট মোচনে কেন্দ্র মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিতে পারে, এমন ভাবনা তাঁর রয়েছে।
বামেদের জন্যই রাজ্যের বারোটা বেজেছে, এমনটাই মোদী মনে করেন। তারা এত দিন ধরে খালি বলে এসেছে, ‘নেহি চলেগা, নেহি চলেগা’। পশ্চিমবঙ্গে তাই কিছুই চলে না। দেশের পূর্বাংশ দুর্বল, আর পশ্চিমাংশ সবল। দেশ শক্তিশালী হবে কী করে— প্রশ্ন মোদীর। তাঁর সমাধান, “উন্নয়নের জন্য চাই শিল্পায়ন। বড় শিল্প, ভারী শিল্প। তার থেকেই চাকরি হবে। এবং সেটাই পশ্চিমবঙ্গের নকশা পাল্টে দিতে পারে।” কিন্তু একই সঙ্গে তাঁর সাবধানবাণী: “শিল্পায়ন মানে কৃষকদের উপরে স্টিম রোলার চালানো নয়। শিল্প এবং কৃষির মধ্যে গোলমাল বাধিয়েছিল সিপিএম। আসলে একটি আর একটির পরিপূরক, বলেছেন মোদী।
হরিদাস পাল কে বলুন তো!
জয়ন্ত ঘোষাল: মোদ্দা কথা নিয়ে আরম্ভ করি। চিটফান্ড?
নরেন্দ্র মোদী: (অট্টহাস্য) নাথিং পার্সোনাল। মমতা সম্পর্কে কোনও ব্যক্তিগত বিরূপতা নেই। কিন্তু সারদার দুর্নীতি নিয়ে আজ ঘরে ঘরে প্রশ্ন। মাত্র তিন বছর ক্ষমতায় থাকার পর কেন এত অভিযোগ? মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে এ সব প্রশ্নের জবাব তো দিতেই হবে। তা না করে উনি রেগে যাচ্ছেন। প্রশ্ন তোলা, বিশেষত ভোটের সময় প্রতিপক্ষ তো প্রশ্ন তুলবেই। এটা তো স্বাভাবিক। বলা হয়েছিল আমি নাকি আদানিকে সুযোগ সুবিধা দিয়েছি। এই অভিযোগ শুনে আমি কি কংগ্রেস নেতাদের বিরুদ্ধে পুলিশ পাঠাব? আমি তা করিনি। সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিটি অভিযোগের জবাব দিয়েছি। দুধ কা দুধ, পানি কা পানি। এখন মানুষ জেনে গিয়েছে, সত্য কী।
ছবির দাম। কতটা দুধ, কতটা পানি?
মানে...
ছবি বিক্রি নিয়ে কি আপনি ভুল তথ্য দিয়েছেন?
হতেই পারেন মমতা এক জন বড় শিল্পী। কিন্তু মানুষেরও তো জানতে চাওয়ার অধিকার আছে। অত টাকা দিয়ে ওই ছবি কে কিনলেন? সেটাই শুধু জানতে চেয়েছিলাম। জবাব কিন্তু আজও পাইনি। এক কোটি না পাঁচ কোটি— কত টাকায় বিক্রি হয়েছে, সেটা তো উনিই বলতে পারবেন। তা কোন ছবি কত টাকায় এবং কারা কিনলেন তা জানতে চাওয়ার কোনও অধিকার থাকবে না? উনি রেগে যাচ্ছেন, কিন্তু জবাব দিচ্ছেন না।
রাহুল সিংহ শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন...
দাবি যথার্থ। সত্য উন্মোচিত হোক।
আগে কিন্তু আপনিই মমতার প্রশংসা করতেন। বলেছিলেন, মায়াবতী-মুলায়ম সিবিআই নিয়ে আপস করেন। মমতা করেন না। বলেছিলেন, রাজ্যের উন্নয়ন নিয়ে তিনি সংগ্রামী।
এ কথা তো আজও বলছি। রাজ্যের উন্নয়ন নিয়ে মমতা যে ভাবে কেন্দ্রের সঙ্গে লড়াই করেছেন সেটা অভিনন্দনযোগ্য। দেখুন কোনও এক ব্যক্তির মূল্যায়ন যখন করবেন, তখন হয় তিনি ভাল, নয় তিনি খারাপ— এ ভাবে করেন কেন? কালো ও সাদার মধ্যে ধূসর রং থাকে।
দুষ্টু লোকেরা বলে, আপনি ভেবেছিলেন মমতা এনডিএ-তে যোগ দেবেন। এখন বুঝেছেন তিনি আসবেন না। তাই অবস্থান পরিবর্তন।
না, তা নয়। আমি কোনও দিনই আশা করিনি যে উনি এনডিএ-তে যোগ দেবেন। আর ভোটের সময় বিজেপি তার নিজের জোরে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে চাইবে, এটাই তো স্বাভাবিক। তাই ভোটের আগে শাসক দলের বিরুদ্ধে মুখে কুলুপ এঁটে থাকব, এটা কি যুদ্ধের কৌশল হতে পারে?
মমতা-বিরোধিতা করায় কি সিপিএমের লাভ হবে না? বিজেপি ভোট পাবে, কিন্তু আসন পাবে না।
৩৪ বছর ধরে ক্ষমতায় থেকে সিপিএম রাজ্যকে রসাতলে পাঠিয়েছে। কংগ্রেস অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়েছে। সারা দেশে বিজেপি এখন জাতীয় বিকল্প। পশ্চিমবঙ্গেও প্রধান বিকল্প হয়ে দাঁড়াচ্ছে বিজেপি। বিজেপি তার নিজের লক্ষ্যে এগোবে, সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? দু’বছর পর বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে আছে কলকাতা পুর নির্বাচন। আর তো ক’টা দিন। দেখবেন পশ্চিমবঙ্গেও ‘মিরাক্ল’ হবে। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের নৌকাও এ বার ডুবছে।
আপনাকে ওঁরা ‘ঘাতক’ বলেছেন।
এ প্রশ্নের জবাব আর কী দেব? এটা একটা মাইন্ডসেট। কিছু লোক মনে করে, এ সব বলে বোধহয় কোনও একটি সম্প্রদায়ের ভোট পেতে সুবিধা হয়। আমি তো সেই ২০০২ সাল থেকে এই অপবাদ শুনে আসছি। আর গুজরাতের সংখ্যালঘু ভাই-বোনেরাও আমাকে ভোট দিচ্ছেন।
উন্নয়ন...
হ্যাঁ। আসলে উন্নয়নের প্রশ্নে জবাব দিতে না পেরে, দুর্নীতির প্রশ্নকে লুকোতে এটা হল সহজতম রাস্তা। যখন আক্রমণ হল আত্মরক্ষার উপায়, তখন তার কোনও জবাব নেই।
কিন্তু...
আগে আপনি একটা কথা বলুন। এই হরিদাস পাল ব্যাপারটা কী?
হরিদাস পাল?
দেখলাম আমাকে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, হরিদাস। কেউ বললেন, হরিদাস পাল। হরিদাস তো একটা লোকের নাম।
এটা আসলে একটা কল্পিত নাম। যে কোনও লোকেরই নাম হতে পারে।
তা হলে হরিদাস পালের মতো আমিও একটা সাধারণ মানুষ।
হরিদাস পাল মানে উনি বলতে চেয়েছেন, এক নামগোত্রহীন ব্যক্তি। অর্থাৎ সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। কংগ্রেস দলের মতো সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক।
(হেসে) আমি কিন্তু মমতাকে কোনও ব্যক্তিগত আক্রমণ করিনি। এখনও করছি না। উন্নয়নের প্রশ্নে সহযোগিতার হাত বাড়াব। বামেরা শুধু বলে এসেছেন, ‘নেহি চলেগা’, ‘নেহি চলেগা’। ফলে রাজ্যের বারোটা বেজেছে। এক সময় কলকাতা ছিল রাজধানী। ঊনবিংশ শতকে রেনেসাঁসের উৎস। রাজধানী এখন দিল্লিতে। কলকাতা থেকে পুঁজি বিদায় নিয়েছে। অতীতে বামেরা কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়েছে। বঞ্চনার ধুয়ো তুলেছেন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীও। আমরা কিন্তু রাজ্যের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করব।
ঋণ মকুব করে দেবেন?
আগে আমাকে ভাল করে বুঝতে হবে। এটুকু আপাতত বলতে পারি, জট ছাড়াতে আমি সব রকম সাহায্য করব। তবে ঋণ মকুব সমাধান, না শিল্পায়নই আসল সমাধান— এ সব নিয়ে রাজ্য ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞের সঙ্গে অনেক কথা বলতে হবে। গাড়ির কারখানা সিঙ্গুর থেকে গুজরাতে আসায় মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আমি খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু এখন ভাবছি সিঙ্গুরের সঙ্কট মোচনে কেন্দ্র মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে।
ওড়িশা...
দক্ষিণ কোরিয়া চাইলেও ওড়িশার পস্কোর জট ছাড়ানো যাচ্ছে না। রাজ্যের প্রকল্প হলেও শিল্পায়ন এবং উন্নয়নের স্বার্থে মনমোহন সিংহের উচিত ছিল, সমাধানের জন্য সক্রিয় ভূমিকা নেওয়া। এটি তাঁরা করেননি।
আপনার কোনও সুনির্দিষ্ট প্ল্যান?
নিশ্চয়ই। যেমন হিমালয়ের রাজ্যগুলির জন্য একটি পরিকল্পনার কথা ভাবা হচ্ছে, তেমনই পূর্বাঞ্চলের অবহেলিত রাজ্যগুলির জন্যও বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতে পারে। দেখুন, মানুষের যদি ডান হাত শক্তিশালী অথচ বাঁ হাতটি দুর্বল হয়, তা হলে তিনি এক জন সমর্থ মানুষ হতে পারেন না। দেশটিও সে রকম। পূর্বাঞ্চল দুর্বল, পশ্চিমাঞ্চল সবল। ভারত শক্তিশালী হবে কী করে? উন্নয়নের জন্য চাই শিল্পায়ন। বড় শিল্প, ভারী শিল্প, তার থেকেই চাকরি হবে। এবং সেটাই রাজ্যের নকশা বদলে দিতে পারে। ভর্তুকি পুরনো সঙ্কট মোচন করতে পারে। সমস্যার সমাধান হতে পারে একমাত্র উৎপাদনের মাধ্যমে। তবে শিল্পায়ন মানে কৃষকদের উপর স্টিম রোলার চালানো নয়। শিল্প এবং কৃষির মধ্যে গোলমাল বাধিয়েছিল সিপিএম। পশ্চিমবঙ্গ এখনও তার ভয় থেকে মুক্ত হতে পারেনি। আসলে একটি আর একটির পরিপূরক।
অন্য প্রসঙ্গ। দলের দাবি এবং সরকারের দাবি— এর মধ্যে সামঞ্জস্য আসবে কী করে?
দলতন্ত্র অনেক সময় মেধাতন্ত্রকে শেষ করে দেয়। বিজেপি একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল। সরকার পরিচালনায় সেই দলের ভূমিকা থাকবে। কিন্তু দলতন্ত্র থাকবে না। দেশ চালাবে সংবিধান।
শুধু তৃণমূল নয়, আপনার দলেও তো অনেকে উল্টোপাল্টা কথা বলছেন। গেরুয়া অনুব্রত মণ্ডল কি নেই?
আমি কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। যাঁরা উল্টোপাল্টা কথা বলছেন, যদি তা অবাঞ্ছিত হয়, তবে আমি সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের ভুল স্বীকার করতে বলেছি। নির্বাচন কমিশন যা নির্দেশ দিয়েছে, সেটা সব সময় মান্য করা হয়েছে। এমনকী অমিত শাহও কমিশনের কাছে দুঃখপ্রকাশ করেছেন।
অনুপ্রবেশকারীদের হুমকি দিয়েছেন। বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক চান না?
বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই। কিন্তু পৃথিবীর কোনও সভ্য দেশ অনুপ্রবেশকারীদের ভোটব্যাঙ্ক বানায় না। দীর্ঘদিনের কংগ্রেস শাসনে এটি হয়েছে। অনুপ্রবেশকারী শুধু রাজ্য নয়, দেশের অর্থনীতিকে বিপন্ন করে। অনুপ্রবেশকে মেনে নেওয়ার পূর্ব শর্তে বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক করতে হবে কেন? বাংলাদেশের আর্থিক উন্নয়নে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক, সব দিক থেকে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা হবে। তা বলে অনুপ্রবেশকারীদের, যাঁরা বিদেশি নাগরিক তাঁদের রেশন কার্ড দিয়ে ভোটার তালিকায় নাম তোলা, সেটি হতে দেওয়া চলবে না।
পাকিস্তান?
পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তি প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। প্রতিটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গেই ভারত সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়। কিন্তু সুসম্পর্কের ভিত্তি বাস্তবকে অস্বীকার করে আত্মসমর্পণ নয়। বাজপেয়ী সরকারের লাহৌর বাস কূটনীতির ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ থাকবে। কিন্তু দাউদ ইব্রাহিমকে নিয়েও প্রশ্ন তুলতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy