Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

এক হননকালের মধ্যে বাস করছি যেন

৭০ বছর কেটে গেল! অথচ, আমাদের ‘পলিটিক্যাল সোসাইটি’ মানুষের বেঁচে থাকার ন্যূনতম চাহিদা পূরণ করতে পারল না। লিখছেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত৭০ বছর কেটে গেল! অথচ, আমাদের ‘পলিটিক্যাল সোসাইটি’ মানুষের বেঁচে থাকার ন্যূনতম চাহিদা পূরণ করতে পারল না। লিখছেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত

এ কোন স্বাধীনতা এল?—ফাইল চিত্র।

এ কোন স্বাধীনতা এল?—ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০১৭ ১৪:২৮
Share: Save:

শ্যামবাজার স্ট্রিটে আমাদের ‘নান্দীকার’-এর মহলা-বাড়ির বাইরের ঘরের জানলাটা বেশ যেন আমার পৃথিবী! কত কিছু যে দেখা যায়, শেখাও যায় কত কিছু। এই সে দিন, ঝিরিঝিরি বৃষ্টির দুপুরে বাইরের রাস্তা দিয়ে ছাতা মাথায় হেঁটে যাওয়া লোকগুলোকে দেখে হঠাৎ মনে হল, আচ্ছা, ওরা কতটা স্বাধীন? এই যে আমি, বসে আছি এই টেবিলের সামনে, ফোন ধরছি, নানা লোকজন নানা কথা বলছেন, শুনছি...বলছি...মতামত দিচ্ছি...আচ্ছা, আমিই বা কতটা স্বাধীন? আমার কি কোনও দিন স্বাধীনতার কোনও অভাব হয়েছে? না, হয়নি তো! স্কুল-কলেজে নিয়মিত না গিয়েও পড়াশোনাটা করেছি, পরীক্ষা দিয়েছি, অভাবের সংসার হলেও জীবনধারণের ন্যূনতম জিনিসপত্র পেয়ে গেছি, কোনও দিন কোনও অভাব ঘটেনি।

আরও পড়ুন: দেখুন স্বাধীনতার প্রথম সকালের সেই দুর্লভ মুহূর্তগুলো

ছেলেবেলা কেটেছে ‘নান্দীকার’-এর এই বাড়ির দোতলার বারান্দায়, আক্ষরিক অর্থেই। ওই আড়াই ফুটের বারান্দায় রাতে শুয়ে থাকতাম। ওটা ছিল আমার স্বাধীনতার বারান্দা, বা বলা ভাল বারান্দায় স্বাধীনতা। কোনও কোনও রাতে হঠাৎ টের পেলাম, দড়াম করে কারও পা পড়ল আমার গায়ের উপর। চমকে উঠতাম। কারণ, শুতাম তো একাই! সেখানে গায়ে পা! ধড়মড় করে ঘুম ভেঙে উঠে দেখতাম, পাশে কোনও লোক শুয়ে। ঘুমের ঘোরে গায়ে পা তুলে দিয়েছে। পরে মনে পড়ত, এ নিশ্চয় সেজদার কোনও ‘কমরেড’! রাতে নিজের বাড়িতে না ফিরে আমাদের এখানেই ‘শেল্টার’ নিয়েছে। সেজদা আগে চাকরি করত রয়্যাল ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্সে। পরে সে সব ছেড়ে কমিউনিস্ট পার্টি, তখনকার অবিভক্ত সিপিআই। দাদারও তো সেটা ছিল এক ধরনের স্বাধীনতার লড়াই! চোখে সমাজ বদলের স্বপ্ন! মনে পড়ে, ’৪৬-এর দাঙ্গার সময় এক দিন আমাদের বাড়িতে এক যুবক এলেন আমার অধ্যাপক মেজদার সঙ্গে। দাঙ্গা লেগে গেল বলে তিনি কয়েক দিন আমাদের বাড়িতেই থেকে গেলেন। তাঁর প্রাণ বাঁচাতে দাদা তাঁকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। মা বললেন, ‘‘তোমরা ওকে ‘মণিদা’ বলে ডাকবে।’’ বাইরের লোকের কাছে তিনি যাতে বিপন্ন বোধ না করেন। পরে জেনেছিলাম, তিনি ছিলেন মুসলিম। হায় রে স্বাধীনতা!

তবে, এই বাতাবরণে মানুষ হয়েছি বলেই কারও কোনও কাজে লাগতে পারলে ভাল লাগত। আনন্দ হত। স্বার্থপরতা ছিল না। অথচ, এখন কেন জানি না মনে হয়, এক হননকালের মধ্যে বাস করছি! জীবনসায়াহ্নে এসে মনে হয়, এই স্বাধীনতাই কি চেয়েছিলাম? আসলে কী স্বাধীনতা আমি চাই? আমার তো অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আছে। যে মানের জীবনযাত্রা তাতে চলে যায়। পেনশন যা পাই তাতে হয়ে যায়, কতই বা চাহিদা থাকে জীবনের? কিন্তু, এই বাড়ির সামনের ফুটপাথে কোনও লোককে শুয়ে থাকতে দেখলে মনে হয়, কী পেলাম এত দিনে? সম্পদের সমবণ্টন হলে ভাল হত, এটা আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু তা যে সুদূর ভবিষ্যতেও সম্ভব নয়, তা-ও জানি। তবে, একটিমাত্র পরিবার একা একশো তলা বাড়িতে থাকবে, তার জন্য পৃথিবীর তাবৎ সুখ মজুত থাকবে আর বাকি অসংখ্য মানুষ এ ভাবে ধুঁকতে ধুঁকতে মরবে— এই অসাম্য আমার কাছে ঘৃণ্য লাগে। আমি বরং ‘পিপলস কোর্ট’-এর উপরেই এ ব্যাপারে ভরসা করব।

আরও পড়ুন: ফিরে দেখা স্বাধীনতা, আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে

মঞ্চও আমার কাছে কিন্তু স্বাধীনতার স্বাদ! ভিন্ন ভাষায়, ভিন্ন সুরে সে কথা বলে। নাটকের মাধ্যমে, কোনও চরিত্র পরিস্ফুটনের মাধ্যমে স্বাধীনতার স্বাদ পাই। সত্যি বলতে কি, মঞ্চে বন্ধুদের সঙ্গে দারুণ স্বাধীনতা পেয়েছি। স্বাধীনতা অনেকটাই মানুষের মনের উপরে নির্ভর করে। মানুষ যদি স্বাধীনতাকে মূল্যবান বলে মনে করে, তা হলে সে তার মূল্য দেয়। শঙ্খ ঘোষকে আমার খুবই স্বাধীন মানুষ বলে মনে হয়। কী সহজেই না তিনি বলতে পারেন, ‘আমার প্রতিবাদ করার স্বাধীনতা আছে।’ এই সব চূড়ান্ত উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও আমরা কেন যে এত খারাপ হয়ে যাই!

আরও পড়ুন: যেখানে খুশি যাইতে পারি

স্বাধীনতা এল। তার পর ৭০ বছর কেটেও গেল! অথচ, আমাদের ‘পলিটিক্যাল সোসাইটি’ মানুষের বেঁচে থাকার ন্যূনতম চাহিদা পূরণ করতে পারল না। দরিদ্র তার মাপকাঠিতেই বাঁধা রইল, ধনীরা কেউ কেউ আরও ধনী হয়ে সত্তর তলা, আশি তলা, একশো তলায় বাস করতে লাগল! কোনও কোনও রাজনীতিক হয়তো বলবেন, তাঁদেরও তো সত্তর তলা, আশি তলা, একশো তলায় বাস করার স্বাধীনতা আছে! কিন্তু গোটা ব্যাপার দেখে ভেতরে ভেতরে একটা সুপ্ত ইচ্ছে জানান দিচ্ছে, ‘তাসের দেশ’-এর সেই রাজপুত্তুররা কোথায় গেল?

পুনশ্চ: পাঠককুলকে স্মরণ করাই, এই লেখাটিকে পাগলের প্রলাপ বা শিশুর কলতান বলে ভাবার অধিকারও তাঁদের আছে!

অলঙ্করণ: সুমন চৌধুরী।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE