করিনা কপূরের সঙ্গে যখন সইফ আলির বিয়ে হল, শর্মিলা ঠাকুরের বিয়ের ‘সারারা’টাই আপনি নতুন করে সাজিয়ে দিয়েছিলেন...
(হাসি) শর্মিলা আমার বন্ধু। ছেলের বিয়ের আগে একদিন কথায় কথায় বলল ওর বিয়ের পোশাকটা রিভাইভ করলে কেমন হয়? আট মাস লেগেছিল নতুন করে সাজাতে। কিন্তু করিনাকে সেটা পরে কী ভাল দেখিয়েছিল বলুন!
তা ঠিক। কিন্তু আপনার জীবনে এই রকম অদ্ভুত ঘটনা তো আরও আছে। যেমন ধরুন সুস্মিতা সেন মিস ইন্ডিয়া হওয়ার সময় জুরি বোর্ডে আপনিও ছিলেন। কত নম্বর দিয়েছিলেন ওঁকে?
( হা হা হা হা ) হায়েস্ট নম্বর। উজাড় করে নম্বর দিয়েছিলাম। আসলে সুস্মিতার মধ্যে বাঙালি বুদ্ধিমত্তার ছাপ আছে। যেহেতু শ্বশুরবাড়ি আমার কলকাতায়, বাঙালিদের বুদ্ধিমত্তাটা আমার ভারি ভাল লাগে।
শুধু শ্বশুরবাড়িই নয়, এই কলকাতা থেকেই আপনার টেক্সটাইল ডিজাইনিংয়ের কাজ শুরু....
একদম ঠিক কথা। মনে পড়ে রফি আহমেদ কিদওয়াই রোডে ষাটের দশকের শেষ দিকে একটা মনোহারী দোকানের এক পাশে শুরু হয়েছিল আমার ‘ঋতুস বুটিক।’ এখন কলকাতায় আমার দুটো স্টোর। সারা ভারতে পঁয়ত্রিশটা। আর বুটিক শব্দটা এখন ঘরে ঘরে। কিন্তু এত সব যে ঘটনা ঘটে গেল কোনওটাই প্ল্যান করে নয়। কিন্তু পুরোটাই একটা আবিষ্কার।
আবিষ্কার?
শিল্পের ইতিহাসের ছাত্রী ছিলাম। ভেবেছিলাম প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে কোনও জাদুঘরে কাজ করব। সেখান থেকে চলে এলাম ডিজাইনিংয়ে। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি হল কলকাতায়। দিল্লি থেকে এসে বাংলার গ্রামে গ্রামে ঘুরে দেখতাম হাতের কাজ, তাঁতের কাজ, কাপড়ের ওপর ছাপার কাজ কেমন চলছে। সবটাই ইতিহাসে আগ্রহ থেকে। শ্রীরামপুরের ডাচ কলোনিতে তখন সিল্কের ওপর হ্যান্ডব্লক প্রিন্ট হত। এই করতে করতে সারা পৃথিবীর হস্তশিল্প, বয়ন শিল্প নিয়ে আমার জগৎটা বড় হয়ে গেল। দুবাইয়ে এখন আমার স্টোর আছে। দেশ-বিদেশের সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার সুন্দরীরা আমার পোশাক পরেছেন। পঞ্চাশ বছর ধরে টেক্সটাইল ডিজাইনিংয়ে। তবু বলব টেক্সটাইল ডিজাইনার না বলে রিভাইভালিস্ট বললেই ভাল। আমি বিলুপ্তপ্রায় শিল্পকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছি। শুরু করেছিলাম শূন্য হাতে এই বাংলা থেকেই। তার পর অনেক স্ট্রাগল।
মনে হয় না, ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিটা ব্যাঙের ছাতার মতো যত্রতত্র যেমন তেমন ভাবে গজিয়ে উঠছে?
না। মনে হয় না। অনেক নতুন ধরনের ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠছে। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি সেই রকমই একটা। টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিতে হাতের কাজের দাম হচ্ছে। অনেক লোকের রুটিরুজি চলছে।
এই মহাযজ্ঞের পেছনে আপনার একটা বিরাট অবদান আছে, এটা কি মনে হয়?
একটা কথাই মনে হয়, এক সময় যেমন ট্র্যাডিশনকে ধরার চেষ্টা করেছি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গ্রামের তাঁতশিল্পী, ছাপা শিল্পী, নকশা শিল্পীদের খুব বিপর্যস্ত অবস্থা। যত দূর জানি দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে দীর্ঘদিন এই বাংলা থেকে নকশা নিয়ে গিয়ে সাহেবরা ইংল্যান্ডে ছাপার কাজ সারত মেশিনে। তার পর এ দেশে এনেই সেই সব মাল বিক্রি করত। আমাদের মতো প্রবীণ ডিজাইনারদের সাফল্য এইটুকুই যে নতুন প্রজন্মের ডিজাইনারদের আমরা মাটির সম্পদ আর শিল্প সম্পর্কে সচেতন করতে পেরেছি। ঠিক এই রকমটাই তো চেয়েছিলেন গাঁধীজি। যাঁর স্বপ্ন আমাকে প্রভাবিত করেছে।
সম্প্রতি পদ্মশ্রী পেয়েছেন। এটা কি অনেক দিন আগেই পাওয়া উচিত ছিল? পঞ্চাশ বছর ধরে কাজ করে চলা তো কম কথা নয়।
আগে কী করে পেতাম? টেক্সটাইল ডিজাইনিং তো পদ্মশ্রীর তালিকায় ছিল না। এটা তো একটা সৃজনশীল কাজ। চিত্রকলা, সঙ্গীতে যদি পদ্মশ্রী থাকে আমাদের কাজের একটা স্বীকৃতি থাকা উচিত। প্রত্যেকটা স্বীকৃতিরই আলাদা সম্মান আছে।
শ্বশুরবাড়ি কলকাতায় যখন এ শহরটার সঙ্গে আপনার সাংস্কৃতিক যোগাযোগ কেমন?
দেখুন আমি গড়িয়াহাটের মোড়েও ঘুরেছি। ফুলিয়ার গ্রামে তাঁতিদের সঙ্গে বসেও কাজ করেছি। এর চেয়ে আর কী বেশি বলব? সবটাই হয়েছে অবশ্যই আমার কাজের সূত্রে। ব্যবসার জন্য এক সময় আমার স্বামীকে দিল্লি চলে যেতে হল। আমিও গেলাম। কিন্তু মন পড়ে রইল কলকাতায়। সুযোগ থাকলে ফিরে আসতামএতটাই চেনা এই শহর, এখানকার মানুষজন, বাংলার প্রত্যন্ত সব গ্রামের মানুষ।
এখন তো আপনার কুতুর কালেকশনে (হাই এন্ড) খুব দামি দামি লহেঙ্গা চোলি, জারদৌজি শাড়ি, বেনারসি-জারদৌজির মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ পোশাক, আড়ি নকশার শাড়ি-কামিজ দেখা যায়। খুবই ঐতিহ্যময় ও সমসাময়িক। অভিজাত ক্রেতার জন্যই সেগুলো বানানো। কিন্তু তখন কী ধরনের নকশা করতেন? দামও কি এই রকমই চড়া ছিল?
তখন আমার শাড়ির দাম থাকত দুশো থেকে তিনশো টাকা। ভাবা যায়! শ্রীরামপুরের প্রিন্টারদের দিয়ে সিল্ক, ছাপাতাম। উলুবেড়িয়া-রানিহাটির শিল্পীদের দিয়ে করাতাম এমব্রয়ডারির কাজ। খুবই আপ মার্কেট কোয়ালিটির কাজ করতেন ওই সব শিল্পী।
কিন্তু দুশো তিনশো টাকা তো তখনও সাঙ্ঘাতিক দাম।
হ্যাঁ, ওই টাকায় কত লোকের সংসার চলত। কিন্তু আমার ভাবনা বা সৃষ্টি রিভাইভালের তো একটা দাম ধরতে হয়েছিল (হাসি)। যাই বলুন, এখনকার তুলনায় অনেক সস্তা ছিল তখনকার শাড়ির দাম।
এখন যে আপনার কাজ তার অনেকটা জুড়েই কিন্তু রয়েছে জারদৌজির ভূমিকা। বিয়ের শাড়ি। বা পার্টি ওয়্যার। যার দাম পঞ্চাশ হাজার থেকে তিন-চার লাখ। কখনও টাঙ্গাইল শাড়ি বা ধনেখালি শাড়ি নিয়ে কাজ করেননি তো!
হ্যান্ডলুম নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে থেকেই এখন খাদির শাড়ি বানানোর দিকে ঝুঁকেছি। কিন্তু হ্যান্ডলুম যে এ দেশের একটা বিরাট ইউ এস পি সেটা তো বুঝতে হবে সরকারি পদে যাঁরা দায়িত্বে আছেন তাঁদের। ওঁদের উদাসীনতা আমাকে উত্তেজিত করে, রাগিয়ে দেয়। সোজা কথা হ্যান্ডলুমকে সাধারণের অ্যাসপিরেশনের জায়গা করে তুলতে হবে। আমি সম্প্রতি যে সব খাদি-শাড়ি, স্টোরে রাখছি সেগুলো যদি কেউ খেয়াল করেন তা হলেই বুঝবেন জারদৌজি করা লহেঙ্গা বা বেনারসির চাইতে কোনও কিছুতেই কম নয় হ্যান্ডলুম। বয়স সত্তরের কোঠায় এখন। ডিজাইনিংয়ের পাশাপাশি ভাবি এই সব সমস্যা সমাধানের কথাও। এটাও তো একটা বড় কাজ। আগামী প্রজন্মের ডিজাইনারদের জন্য একটা যোগ্য পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করা।
রিতু কুমারের স্টোরে অল্পবয়েসি ছেলেমেয়েদের জন্য অতি সস্তায় পোশাক পাওয়া যায় এটা এখনও অনেকেরই কিন্তু অজানা।
সেই জন্যই অনলাইনে আমরা প্রচুর ছবি দিয়ে ডিসপ্লে করছি। অল্পবয়েসিদের জন্য নানা কাটের নানা ছাপার পোশাক আরও বেশি করে স্টোরে আসবে। ফ্যাশনটাকে নিয়ন্ত্রণ করে সব সময় অল্পবয়েসিরাই।
আমাদের দেশটা গ্রীষ্মপ্রধান। কী ধরনের পোশাক পরতে সাজেস্ট করবেন অল্পবয়েসিদের, যাতে স্টাইলও হয়, আরামও হয়।
ফ্লোরাল বা জ্যামিতিক ছাপার টিউনিক, স্কার্ট। শিফন, লিনেন, জুটের টপও হতে পারে। সুন্দর টিউব টপ রাত্রে চলবে। কিন্তু হালকা রঙের। ফ্লোয়িং পোশাক খুব ভাল দেখায় প্যাস্টেল শেডে। আর সব রকম সাজেই সাদা কিন্তু গ্রীষ্মের সবচেয়ে সুন্দর রং। সাদা একটা রং-ই। রংহীনতা নয়।
গ্রীষ্মকালে বিয়ে থাকলে কনের সাজের রং কী হবে?
আমি তো বলব লাল, গোলাপি, ম্যাজেন্টা, কমলা, মেরুন, হলুদ-লাল, লাল-সাদার কম্বিনেশন এই সবই বিয়ের কনের রং হওয়া উচিত। উজ্জ্বল লাল ঘেঁষা রং পরলেই ভাল। বাঙালি মেয়েরা যদি বেনারসি পরেন, লাল, মেরুন, রাস্টের শেডেই পরুন।
আপনার চিন্তা- ভাবনা এত ব্যাপ্ত কিন্তু বলিউডের ছবিতে কস্টিউম ডিজাইনার হিসেবে দেখা গেল না।
কারণ ওটা একটা আলাদা কাজ। ছবির কাজ করতে শুরু করলে চিত্রনাট্য থেকে সেট থেকে শু্যটিং কবে কোথায় সব জানতে হবে। হোলটাইম জব। সেটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সেই জন্যই সিনেমার দিকে নজর দিইনি। যা পেয়েছি তা যথেষ্ট। এমনিতেই ঐশ্বর্যা রাই, বিদ্যা বালন, প্রিয়ঙ্কা চোপড়ারা প্রত্যেকেই আমার ডিজাইনের পোশাক পরে। প্রিন্সেস ডায়না থেকে জেমিমা ওঁরাও আমার পোশাক পরেছেন। দেশবিদেশের স্বনামধন্য মহিলাদের কাছে যে প্রশংসা পেয়েছি তাই আমার কাছে অনেক পাওয়া। জীবনের খুব বড় প্রাপ্তি। আর একটা কথা। সিনেমার সাজ করার জন্য আলাদা একটা মানসিকতা লাগে। যেটা আমার খুব একটা আছে বলে মনে হয় না। শখে এক আধটা পছন্দসই ছবির কাজ করাই যেতে পারে। যদি চিত্রনাট্য পছন্দ হয়।
সিনেমার দিকে নজর না দিলেও সাহিত্যে আপনার খুব আগ্রহ। শোনা যায় জয়পুর লিটেরারি ফেস্টিভ্যালে আপনি একেবারে প্রথমের সারিতে বসে থাকেন।
( হাসি) তা থাকি। আমি বলতে পারেন ভোরাশিয়াস রিডার। যদিও আমার প্রিয় বিষয় শিল্পের ইতিহাস। গল্প-উপন্যাসও ভাল লাগে। যেমন আমার খুব প্রিয় অমিতাভ ঘোষের লেখা। (হাসি) এগেন বেঙ্গলি কানেকশন। বাংলা আমার জীবনে চিরকাল থেকে যাবে। আমার ওয়ার্কশপ বা ফ্যাশনের রান্নাঘর তো কলকাতাতেও আছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy