ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল
আচ্ছা, একটা কথা বলুন, আপনি কখনও সুচিত্রা সেনের প্রেমে পড়েননি?
না।
কী বলছেন সৌমিত্রদা? আমাদের অফিসে কোনও কোনও দফতরে আজও সেই বিখ্যাত ছবিটা ঝোলে। ‘সাত পাকে বাঁধা’র প্রিমিয়ারে আপনার পাঞ্জাবি টেনে ছিঁড়ে দিচ্ছেন সুচিত্রা।
সে তো পার্টির একটা ঘটনা।
এ রকম একজন রূপবতী মহিলা শুভেচ্ছার আতিশয্যে আপনার পাঞ্জাবি ছিঁড়ে দিচ্ছেন। আর আপনি তাঁর প্রেমে পড়লেন না? হতে পারে?
(সামান্য নীরব) বললাম তো প্রেমে পড়িনি। আমি তো ওয়াহিদা রহমানেরও প্রেমে পড়িনি। সাবিত্রীর পড়িনি।
সুচিত্রার সৌন্দর্য তো অন্য পর্যায়ের ছিল।
ওয়াহিদা কি কম সুন্দরী না কি? কী দেখতে ছিলেন বলো তো! সাধারণ ভাবে আমি প্রেমে যে কোনও কোনও সময় পড়েছি, অস্বীকার করতে চাই না। কিন্তু সাবিত্রীর প্রেমে তো পড়িনি।
সাবিত্রী নিশ্চয়ই বাংলার সর্বকালের সেরা অভিনেত্রীদের একজন। কিন্তু আমরা যে চৌম্বকীয় আকর্ষণক্ষমতার কথা বলছি, সেখানে সুচিত্রা আর সাবিত্রী
এক হল?
তুমি যদি সেই আকর্ষণ আর চুম্বকের কথা বলো, আমি সব সময় উত্তমকুমারকে আগে রাখব। উত্তম একা ক্যারি করতেন ছবি। সুচিত্রা সেন ক’টা ছবি একা ক্যারি করেছেন, দেখাও তো! কী ক্যারিসমা বলো তো!
উত্তমদা আর তিনি: উগ্র সমর্থকদের চৌহদ্দি পেরিয়ে একান্তে
সুচিত্রার ক্যারিসমা ছিল না?
উত্তমের ক্যারিসমাটা শুধু এরস-নির্ভর নয়।
মানতে পারলাম না। এত বছর বাদেও সুচিত্রা কিন্তু মোহিনী মায়া।
(শ্লেষের সঙ্গে) ঠিক বলেছ। শুধু মোহিনী মায়া। এ বার আমায় বলো তো, উত্তমকুমার কি মোহন মায়া? তা তো নয়। লোকটা জাস্ট দাঁড়িয়ে একটু হাসবে, দর্শক হা হয়ে যাবে। ছোট একটা প্রেমের সিনকেও এমন শোভাময় করে দেবে যে পাশের বাড়ির ছেলে থেকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়— সবার মনে হবে প্রেম করলে এ ভাবে করব। জাস্ট হাসিটা।
সে তো সুচিত্রারও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানোটা সৌন্দর্যের ট্রেডমার্ক ছিল।
হ্যাঁ, দেখলেই মনে হত ফলস।
(ডিকেএস ক্লাবের বন্ধ ঘরে আমরা মুখোমুখি বসা। বাইরে এত ঠান্ডা যে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় টুপি পরে ক্লাবে ঢুকেছেন। এ বার ব্র্যান্ডি আর গরম জলের অর্ডার তাঁর জন্য।)
মনে করুন, উত্তমকুমার বেঁচে আছেন। সারাদিন খাটাখাটনির পর দু’জনে একসঙ্গে বসেছেন। আপনি আজকের মতোই অর্ডার করেছেন ব্র্যান্ডি। উনি কী অর্ডার করতেন?
উনি হুইস্কি খেতেন। হুইস্কিটাই সাধারণত ওঁকে খেতে দেখতাম। অথচ মজা হল, আমাকে ব্র্যান্ডি ধরিয়েছিলেন কিন্তু উনি। সেই ‘সধবার একাদশী’তে নিমচাঁদের একটা ডায়ালগ ছিল না, ‘‘ক্ল্যারেট ফর লেডিজ। শেরি ফর উইম্যান। ব্র্যান্ডি ফর হিরোজ।’’
উনি আপনাকে এমন একটা ড্রিঙ্ক ধরালেন, সেটা সারাজীবনের জন্য থেকে গেল। মানে যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা ছিল। অথচ শোনা যায়, আপনারা প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন!
কী হল জানো। উত্তমদাকে আগেই চিনতাম। ঘনিষ্ঠতা হয়নি। সেটা হয়ে গেল ‘ঝিন্দের বন্দী’র আউটডোর করতে গিয়ে আমরা দু’জন দারুণ মজে গেলাম। আমার ভগ্নিপতি ওঁর দশ-পনেরোজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের বৃত্তে ছিলেন। ওঁদের শনিবার-শনিবার একসঙ্গে আড্ডা বসত। একটা নিয়ম ছিল ওঁদের আড্ডায়, যে প্রতি শনিবার ছেলেদের সাদা পরে আসতে হবে। সাদা আদ্দির পাঞ্জাবি আর সাদা মাখন জিন্সের প্যান্ট। গায়ে সাদা সিল্কের শার্ট। আমার বোনের বিয়ের পর আমিও সেই আড্ডায় রেগুলার হয়ে গেলাম। দারুণ ফুরফুরে হত সেই আড্ডাগুলো। বসন্তদা থাকতেন, উত্তমদা থাকতেন।
শুভেচ্ছার আতিশয্য: ‘সাত পাকে বাঁধা’র পার্টিতে সৌমিত্রের পাঞ্জাবি ছিঁড়ে দিচ্ছেন সুচিত্রা
উত্তমকুমারও ড্রেস কোড মেনে সাদা পরতেন?
আরে, উত্তমদা তো আদ্দির পাঞ্জাবি আর মালকোঁচা মারা ধুতি পরে আসতেন। কী লাগত যে কী বলব! উফ! ওই রকম গ্ল্যামারাস লোক আমি আর দেখিনি।
আপনিও অসম্ভব রূপবান ছিলেন। প্রভুত মহিলা ফ্যান ফলোয়িং আপনারও ছিল। এমন কখনও হয়েছে যে, আপনার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে গিয়েও উড বি বান্ধবী শেষ মুহূর্তে উত্তমের দিকে চলে গেল?
না, না, (হাসি) একটা বয়সের তফাত তো আমাদের ছিল। প্রচণ্ড কম্পিটিশন ছিল। তা বলে বয়সের তফাতটা তো মানতে হবে।
সৌমিত্রদা, এটা বিশ্বাস করতে হবে যে বাঙালির চিরকালীন ভালবাসার দুই নায়ক। তাঁদের মধ্যে এত বন্ধুত্ব। তাঁরা কখনও একসঙ্গে মহিলা নিয়ে আলোচনা করেননি?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে তো প্রচুর হয়েছে। আমি ওঁর খুব পিছনে লাগতাম। ভীষণ, ভীষণ পিছনে লাগতাম মহিলা নিয়ে। একদিন তো উনি চেঁচাতে শুরু করলেন, এই কে আছিস, পুলুটাকে বার কর তো সেট থেকে।
কী বলে খেপাতেন?
বলতাম, দাদা হাতটা একটু দেখাও না। কী আছে হাতে যে এত সব আকর্ষিত হচ্ছে। উনি হাসতে হাসতে ডিরেক্টরকে বলতেন, একে বার করো। নইলে আমি মন দিয়ে শ্যুটিং করতে পারব না। কী জানো গৌতম, এই জিনিসগুলো তো কেউ জানে না। বাঙালি তার স্বভাবসুলভ প্রবণতা অনুযায়ী আমাদের লড়িয়ে দিয়েছিল। কংগ্রেস-সিপিএম, মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল, অতএব উত্তম-সৌমিত্র!
কিন্তু একটা টেনশন তো আপনাদের মধ্যে ছিল।
টেনশন ছিল না। কম্পিটিটিভনেস ছিল। সেটা তো এক দিক থেকে ভাল। বাঙালি যে এই চর্চাটা করত, সেটা এক দিক দিয়ে ভাল। জবরদস্ত কম্পিটিটিভনেস না থাকলে এগোনো যায় নাকি? কী বলো। পেশাদারি লড়াই যত থাক, ব্যক্তিগত সম্পর্কে সেটা চিড় ফেলেনি। উত্তমদা আর আমার একবারই মনোমালিন্য হয়েছিল। সেটাও তোমায় বলব।
আপনি বলতে চান বাঙালি যখন উত্তম-সৌমিত্র নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারপিট করে রক্তারক্তি বাধাত, তখন আপনারা রাতের আড্ডায় একজন হুইস্কি, অন্য জন ব্র্যান্ডি খেতেন?
একদম তাই। ‘ঝিন্দের বন্দী’র আউটডোরের পর থেকে ও যে আমায় আপন করে নিল, সেটা থেকেই গেল।
প্রথম আউটডোরে আপনাকে স্নেহ করা এক জিনিস। সে তো নবাগতকে লোকে করে থাকে। কিন্তু ময়ূরবাহন হয়ে আপনার চমকপ্রদ পারফরম্যান্সের পর সেটা বহাল ছিল?
ছিল। একটা কথা মনে রেখো। উত্তমদা কিন্তু নিজের জায়গাটা দারুণ আগলাত।
কোথায় মদ খেতেন দু’জনে বসে?
তখন জায়গা সত্যি খুব কম ছিল। গ্র্যান্ড, গ্রেট ইস্টার্ন, স্পেনসর্স।
স্পেনসর্স মানে ডালহৌসি পাড়ার সেই হোটেলটা, যার ওপর ভিত্তি করে শঙ্করের ‘চৌরঙ্গী’?
হ্যাঁ, সেই হোটেলটা।
ক্যালকাটা ক্লাব?
আমরা দু’জনে পরবর্তী কালে অনেক ক্লাবের মেম্বার হই। কিন্তু তখন কেউ ক্লাব মেম্বার ছিলাম না। ফলে ঘুরে ফিরে মদ খাওয়ার ওই ক’টা সীমিত জায়গা। উত্তমদা তখন এমন হয়েছে যে, আমাকে ডাকতে স্টুডিয়ো চলে এসেছে। আমি টেকনিসিয়ান্স স্টুডিয়োয়। উনি এক নম্বরে। হয়তো ফ্লোরেই চলে গেছি। উত্তমদা এসে ডাকাডাকি, ‘‘কীরে পুলু, সন্ধেবেলা কী করছিস রে? বসব কিন্তু।’’ প্রথমেই সেই সমস্যা, ভেতো বাঙালি ফ্যান যাতে ডিসটার্ব না করে এমন কোনও জায়গায় একান্তে যাতে বসা যায়। উত্তমদার প্রবলেম ঢের বেশি।
আমি তো তখন সবে শুরু করেছি। লোকে অত ভাল করে চেনে না। বা চিনলেও হামলে পড়ে না। কিন্তু উনি তো মধ্যগগনে।
সৌমিত্রদা, আপনার সঙ্গে কখনও কোনও লোক ঘোরে না। আপনি বরাবর একা। কিন্তু শোনা যায়, উত্তমকে ঘিরে থাকত চামচেরা। আপনি এদের সম্পর্কে সতর্ক করে দেননি?
অনেকে ছিল যারা ওঁকে ভুল বোঝাত। বলত, সৌমিত্র জানো তো তোমায় খুব হিংসে করে। কানপাতলাও ছিলেন কিছুটা। ভুল বোঝানোতে সময় সময় প্রভাবিত হয়ে পড়তেন।
এরা কারা?
ছিল নানান সব লোক। তারা কেউ কেউ জীবিত আছে আজকের দিনে। থাক, আর নামগুলো নিতে চাই না।
এই যে ওঁর সাংসারিক উথালপাথাল। এক দিকে গৌরী দেবী। অন্য দিকে সুপ্রিয়া। কত কাহিনি আছে রাতের পর রাত বিনিদ্র জীবনযাপন। তীব্র বাকবিতণ্ডা। আপনার সঙ্গে কখনও শেয়ার করেননি?
কিছু কিছু করেছে তো বটেই। উত্তমদা মাঝেমধ্যে খুব আপসেট হয়ে পড়তেন। আমি একটা পরামর্শও দিয়েছিলাম। থাক, সেগুলো এত বছর পর কাগজে খুলে বলতে চাই না। ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি। লিখবে না প্লিজ।
(কয়েক মিনিট টেপ বন্ধ। ইন্টারভিউ ফের চালু।)
একটা কথা বলুন, এখনকার দিনে দেব খুব জনপ্রিয়। সৌরভের তো কথাই নেই। কোথায় গিয়ে এঁদের সঙ্গে উত্তমের জনপ্রিয়তার তুলনা হয়?
এই প্রশ্নটা আমায় কোরো না।
কেন?
আমি এটার উত্তর দিতে চাই না। আমায় ভুল বুঝতে পারে। সেনসিটিভ প্রশ্ন।
আমি কিন্তু খুব ইনোসেন্টলি জিজ্ঞেস করছি। কোনও মারপ্যাঁচ নেই।
আমি জানি নেই। তবু একটু ইতস্তত করছিলাম। দ্যাখো সৌরভ হল একজন ইন্টারন্যাশনাল সেলিব্রিটি। বাঙালি মাত্রেই ওর ফ্যান। ও একটা ইন্সপিরেশেন! কিন্তু উত্তমদার ব্যাপারে একটা কথা মাথায় রেখো, মানুষটা গত ৩৬ বছর বেঁচে নেই। তুমি কি সেটা কখনও টের পাচ্ছ? একবার আমেরিকায় বঙ্গসম্মেলনে গিয়েছিলাম। নিউ ইয়র্ক ছিল বোধহয়। প্রশ্নোত্তর পর্ব চলেছে দর্শকদের সঙ্গে। কী একটা কথায় কথায় আমি বলেছি মহানায়ক। তখন এক ভদ্রলোক দর্শকাসন থেকে দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, ‘‘সৌমিত্রবাবু, এক্সকিউজ মি। আপনি একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেতা। আপনিও গড়পড়তা দর্শকের মতো বলছেন মহানায়ক!’’ আমি বললাম, ঠিকই বলেছি। একটা মানুষ মৃত্যুর তিন দশক বাদেও মহানায়ক হয়ে জ্বলজ্বল করছে, পৃথিবীর আর কোথাও কখনও এমন ঘটনা শুনেছেন? এ রকম আর একটা স্টার দেখাতে পারেন আমায়?
কিন্তু পারস্পরিক শ্রদ্ধা যতই থাকুক আপনাদের মধ্যে, আজকের দিনে একটা রাজনৈতিক বিভাজন অনিবার্য ছিল। আপনি বরাবরের বাম। উনি হয়তো আজকের দিনে তৃণমূল কংগ্রেস সমর্থন করতেন।
সেই বিভাজন তো তখনকার দিনেও ছিল। অভিনেতৃ সংঘ আর শিল্পী সংসদ।
আমি সেটা নয়, রাজনৈতিক বিভাজনের কথা বলছি। আজকের টালিগঞ্জে যা মারাত্মক।
না, না, তখনকার বিভাজনও আদর্শগতভাবে ডান আর বামে বিভক্ত ছিল। উত্তমদা আর আমি তখনই দু’দিকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম। দু’তরফে প্রচণ্ড অভিমান চলেছে। কেউ কারও মুখ দেখে না, এমন অবস্থা।
সুপ্রিয়া দেবী একবার সেই সময়কার ঘটনার কথা আনন্দবাজারের সাক্ষাৎকারে বলেও ছিলেন। স্টুডিয়োতে আপনি নাকি সামনে উত্তমকে দেখেও না চেনার ভান করেছিলেন। তখন উনি রেগে গিয়ে বলেন, ‘‘কীরে পুলু, চিনতে পারছিস না?’’
এগুলো সব বানিয়ে বলা কথা। যার চেয়েও সলিড কিছু আমি তোমায় বলতে পারি। আরও এক্সপ্লোসিভ। যখন উভয় পক্ষের মধ্যে এসব টেনশন চলেছে, তখন বসুশ্রীতে মন্টু বসুর সেই পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান। সে বার আমি ঢুকতে একটু দেরি করে ফেলেছি। ঢুকে দেখি, সিনিয়রেরা সবাই এসে গিয়েছেন। ভানুদা, জহরদা, উত্তমদা। তখন বসুশ্রীর ওই অনুষ্ঠানে একটা বাঙালি প্রথা চালু ছিল যে, সিনিয়রদের প্রণাম করে কোলাকুলি করতে হবে।
বাংলা নববর্ষে কোলাকুলি?
ইয়েস, কোলাকুলিটা তখন নববর্ষেও বাঙালি জীবনে ছিল। এখন ভ্যানিশ করে গিয়েছে। সিনিয়রদের পরপর প্রণাম করতে করতে মুখ তুলে দেখছি এ বার উত্তমদা। তখন বুকে প্রচণ্ড অভিমান আর তিক্ততা। ওঁর হাত দু’টো ধরে শুধু বললাম, শুভ নববর্ষ। প্রণাম করিনি। ওঁর ফর্সা মুখটা প্রায় লাল হয়ে গেল। বললেন, ‘‘বড় ভাই আমি। পায়ে হাত দিয়ে পেন্নাম করতে পারিস না!’’ আমার সব অভিমান মুহূর্তে গলে জল। আমি বসে পড়ে ওঁর পা দু’টো চেপে ধরলাম। দাদা, আমায় ক্ষমা করে দাও। আমার অন্যায় হয়েছে। আমি নিজের সপক্ষে আজ একটা কথাই বলতে পারি যে এক সেকেন্ডও নষ্ট করিনি। দ্রুত সারেন্ডার করি।
বসুশ্রীর ঘটনাও কিন্তু আপনার বামপন্থী দর্শন বদলাতে পারেনি।
তা পারেনি। কিন্তু আজকের পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে কী মনে হচ্ছে, বামপন্থা মারা গিয়েছে? সরি, প্রশ্নটা বদলাচ্ছি। পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকালে কী মনে হচ্ছে? আজ বামপন্থা মারা গেছে, নাকি ভুল লোকেরা তার নেতৃত্ব দিচ্ছে?
ভুল লোকেরা এ রাজ্যে নেতৃত্ব দিচ্ছে। ঘোরতর গোলমাল। ভুলভাল সব হচ্ছে।
এটা আপনি বলছেন, খুব আশ্চর্য হচ্ছি। আপনি তো আগের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
কিছু সময়ের জন্য। ১৯৯২-তে সত্যজিৎ রায় যে দিন মারা গেলেন, সে দিন প্রথম ভাল করে কথা হয়। তার আগে কিছু ছিল না।
রাজনীতি সচেতন একজন মানুষ হিসেবে কী মনে হয়? রাজ্যে বামপন্থীদের গন্ডগোলটা কোথায় হল?
দ্যাখো, সত্তর দশকের মাঝামাঝি অবধি আমি নিয়মিত রাজনীতির হিসেব রাখতাম। তারপর যোগাযোগটা ইচ্ছাকৃত কমিয়ে দিই। কারণ ওই রকম অ্যাক্টিভিস্ট অভিনেতা হওয়া তো সম্ভব নয়। কাজেই যেটা বলব, সেটা দূর থেকে বলা। বামফ্রন্ট রাজের প্রথম পনেরো-কুড়ি বছর তো ঠিকই ছিল। যা সব ভাল কাজ হয়েছে সব ওই সময়ে। শেষ দশ থেকে পনেরো বছর নেতৃত্ব প্রচুর ভুল কাজ করেছে। আমরা সবাই শুনেছি পাওয়ার করাপ্টস (দীর্ঘশ্বাস)। শেষ দিকে তাই হল।
মমতা এবং তৃণমূল?
একই। এই বয়সে এ সব বলা ঠিক হচ্ছে কি না জানি না। তবে শেষ দিককার বামফ্রন্ট যে সব দোষে দুষ্ট, এদের মধ্যে একই সব লক্ষণ দেখছি।
কলকাতাকে নীল-সাদায় মুড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত?
আমি সাঙ্ঘাতিক বিরোধী। এটা হচ্ছেটা কী? আমার কাছে কালচারাল শক। আই সোর। বিশ্বসংসারে এত রকম রং আছে সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলার জন্য। তুমি হঠাৎ তার থেকে দু’টো রং বেছে বাকিগুলোকে বহিষ্কার করবে কেন? তোমার যেখানে মনে হয় নীল-সাদা দিলে ভাল, সেখানে দাও না। কিন্তু এই রকম আইন করে দেবে কেন? আমার কাছে তো এটা ভীষণ ভীষণ পীড়াদায়ক।
সৌমিত্রদা, আপনি বলছেন বামফ্রন্টে বিশ্বাস হারিয়েছেন। তৃণমূল সম্বন্ধেও উচ্ছ্বসিত নন। বিজেপি আপনার পছন্দ হতে পারে না। তা হলে আপনি এ বছরের নির্বাচনে ভোটটা দেবেন কাকে?
(নীরব)
ফোর্থ অপশন অবশ্য একটা আছে। নান অব দ্য অ্যাবাভ। নোটা। আমি সেটাই প্রয়োগ করব। যদি পায়ে হেঁটে ভোট কেন্দ্রে যেতে পারি।
একবার জিজ্ঞেস করা হয়ে গিয়েছে, তবু আবার করছি। ‘বেলাশেষে’র ওই রকম সাফল্যের পর আপনি অবসরের কথা চিন্তাই করেননি এটা বিস্ময়ের।
বিস্ময়ের নয়। তোমায় বুঝতে হবে আমি কী চাই? আমার বেঁচে থাকার জাস্টিফিকেশন স্টারডম নয়, ভাল অভিনয়। যশ নিশ্চয়ই চাই। যশের আকাঙ্ক্ষা না-থাকলে এত লম্বা দৌড়তেই পারতাম না। যশ তো পেয়েওছি। জনপ্রিয়তা পেয়েছি প্রচুর। বিনয় না করেও বলি, উত্তমকুমার ছাড়া এত বড় স্টার আর হয়নি। তবু আমার বরাবরের লক্ষ্য থেকেছে স্টার বলতে যে সব প্রোটোটাইপ বোঝায়, সেই ইমেজারিকে জাস্ট উড়িয়ে দেওয়া। সব সময় আমি নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়েছি। নতুন সব চরিত্র করতে চেয়েছি। লোভীর মতো চেয়েছি আরও আরও আরও। কেন জানো? আমি স্টারডমের তথাকথিত ভূখণ্ড ছেড়ে নতুন ভূখণ্ড জয় করতে চেয়েছি।
অভিনয় ভূখণ্ডেরও নাগরিক হতে চেয়েছেন।
ঠিক তাই। আমি নিজের জন্য দু’টো বিশ্বে পা রাখতে চেয়েছি।
উত্তমকুমারের ক’টা বিশ্ব ছিল?
ওঁরটা এক জায়গাতে ছিল। দু’টোতে ছড়ায়নি। আমার এখনও মনে হয়, উত্তমদা কেন ওঁর এত বড় জনপ্রিয় অভিনয় ক্ষমতাকে চেপে জনপ্রিয়তাকে আঁকড়ে থাকলেন? উনি কিন্তু চাইলে নিজেকে আরও ভাঙতে পারতেন।
যুবরাজ ক্যান্সার লড়ে ক্রিকেট মাঠে ফেরার পর বলেছিলেন মৃত্যু যে জাস্ট পাশের স্টেশন এটা প্রথম জানলাম। আপনি ক্যান্সার লড়ছেন তিন-চার বছর ধরে। আপনারও তেমন অনুভূতি?
দ্যাখো আমারটা প্রস্টেট ক্যান্সার। আমার বয়সে এই ক্যানসার অনেক স্লো মুভিং। কিন্তু ক্যান্সার তো! মৃত্যুকে বোঝার ব্যাপারটা বাড়িয়ে দেয়। সারা জীবন ধরে তো মানুষ এটাই চেষ্টা চালায় যে মৃত্যুকে ভাল করে বুঝবে। আমি অবশ্য প্রাথমিক বিপন্নতা কাটিয়ে ঠিক করে ফেলি, আর যাই হোক মাথা নীচু করে অন্তত যেতে চাই না। কষ্ট হলে হবে। চেঁচিয়ে বলব ডাক্তারকে, মরফিন দিন আমাকে। কিন্তু ভয়ে ভেঙে পড়ব না।
এত সব শৃঙ্গ আরোহণ। এত লড়াই জেতা। সব কিছুর পর এই বয়সে এসে নিঃসঙ্গ লাগে না?
অবশ্যই লাগে। আই অ্যাম টেরিবলি লোনলি। তিন-চার দিন যখন কাজ থাকে না, সময় যেন হাঁ করে গিলতে আসে আমায়। কী করব এই সময় নিয়ে? পদ্য তো আমার দ্বারা লিখিত হয়। আমি লিখি না। হ্যাঁ, ছবি আঁকার চেষ্টা করি। ভাল না লাগলে সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারি। তার পর বই পড়তে পারি, যেটা আমার চিরকালীন নেশা। তার পর? আমার কোনও বন্ধু নেই। যে দু’জন আমার খুব ঘনিষ্ঠ, তাদের নাম বলছি না। একজনকে সেদিন ডাকলাম। বলল আসতে পারছি না। আমার বেয়াই এসেছে। শপিং যাচ্ছি। আরেকজনকে ফোন করলাম। সে-ও ব্যস্ত। লোক নেই তো ওয়েভলেংথ ম্যাচ করার মতো। পরিচালক সুমন ঘোষ আমার খুব স্নেহাস্পদ। কিন্তু সে তো থাকে ফ্লোরিডায়। তাকে তো আর ডেকে পাঠাতে পারি না।
মহিলারা আজও আপনার প্রেমে পড়ে। নিয়ত মুগ্ধ হয়। এদের উচ্ছ্বসিত প্রতিক্রিয়াগুলোই তো নিঃসঙ্গতার অ্যান্টিডোট হতে পারে।
ধুর, ওগুলো তাৎক্ষণিক। প্রেমে যে পড়ছে, তাকে আমি দেখছি কোথায়? তাকে জানছি কোথায়? আমার যা জীবনযাত্রার ধরন বা সাংসারিক দায়দায়িত্ব, তাতে আমার প্রতি অনুরক্তকে নিয়ে আমি তো শান্তিনিকেতনে উধাও হয়ে যেতে পারি না।
সৌমিত্রদা, মনে করুন ভারতবর্ষের সর্বকালের সেরা অভিনেতা বার করার জন্য ত্রয়ীর মধ্যে কম্পিটিশন হচ্ছে। আপনি একজন প্রতিযোগী। তা কোন দু’জনকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী বাছবেন?
আরে, এসব কী বলছ বলো তো? আমাকে কোথায় ঢোকাচ্ছ (হাসি)? বলছ তো, আমি নিজেই একজন কম্পিটিটর।
বলুন না। অনেস্টলি দেশের কোন দুই অভিনেতাকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেন?
অলটাইম বেস্ট যদি বলো, আমার কাছে সব সময় বলরাজ সাহনি।
সেকেন্ড নাম?
নাসির।
দিলীপকুমার নন?
না। দেখো অভিনয়ের শিল্পবোধ, তার সূক্ষ্মতা সেটা অন্য জিনিস। দিলীপের মতো চূড়ান্ত দক্ষতা হয়তো নাসিরের না থাকতে পারে। কিন্তু সিনেমাটা তো কোথাও গিয়ে একটা শিল্প। সেই শিল্পের ছোট ছোট টাচ-এ নাসির অসামান্য। এটা একবারও ভেবো না যে আমি দিলীপকুমারকে, বা ওঁদের যুগকে উড়িয়ে দিচ্ছি। ওঁদের ক্রিয়াকর্মের ভিত্তিতেই তো পরের প্রজন্মের সিনেমার অভিনয় এগিয়েছে। উত্তমদাকে যেমন ইতিহাস কখনও ভুলবে না। প্রেমিক উনি। পাশের বাড়ির ছেলে উনি। স্টার উনি। অসামান্য!
তবু কোথাও কি নতুন জন্মদিনের প্রাক্কালে অস্ফুটে মনে হয়, বড় ভাই ৮০০ মিটারে সোনা তুমি পেয়েছিলে। ম্যারাথনটা জিতলাম কিন্তু আমি।
তোমার প্রশ্নটা শুনে মনে পড়ল যে, আমি অনেক দিন আগে কোনও সাংবাদিকের লেখা পড়ে ছিলাম উত্তমদা মারা যাওয়ার পর। তিনি লিখেছেন এত বছর দু’টো ঘোড়া দৌড়চ্ছিল, এখন একটা দৌড়চ্ছে। আমি তখন বলেছিলাম, শিল্পীর ঘোড়দৌড়ে আমি বিশ্বাস করি না। আজও তাই বলছি। এটা লিখো যে, উত্তমদা বেঁচে থাকলে আজকের দিনে যথেষ্ট মানিয়ে থাকতেন।
এটা কিন্তু সৌমিত্রদা আপনার বিনয়। দীর্ঘকালীন স্থায়িত্ব আর নির্ভরযোগ্যতার ট্রফি তো কোথাও একটা তোলা থাকে। কোথাও যেন মনে হয় উনি ছিলেন সচিন! আপনি দ্রাবিড়! সচিন প্রভাবে এগিয়ে। কিন্তু যত দিন যায়, লোকে দ্রাবিড়ের মাহাত্ম্য আরও বুঝতে পারে। তাঁর নামের পাশে আরও সংখ্যা যোগ হয়।
আই আন্ডারস্ট্যান্ড হোয়াট ইউ আর সেয়িং। এটা হয়তো ঠিক যে চরিত্রাভিনয় মাপকাঠি হলে আমার মতো বহুমূখী কাজ উনি করেননি। অভিনয় আর জনপ্রিয়তা এই দু’টোর বৃত্তকে মেলানোর ব্যর্থ চেষ্টার পর শেষমেশ উনি জনপ্রিয়তা বেছে নেন। রাইচরণ করেছিলেন, কিন্তু তার পর কোথায়?
তা হলে তো ঠিকই বললাম। ৮০০ মিটার আর ম্যারাথন।
না, না, এটাতে আমার মতই নিও না। কে কোন ইভেন্টে সোনা জিতেছিল, সেটা মহাকাল নির্ধারণ করুক।
(শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy