‘একেনবাবু’র চরিত্রে অনির্বাণ চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত।
বাঙালির গোয়েন্দাপ্রীতি নতুন কিছু নয়। ফেলুদা এবং ব্যোমকেশের জনপ্রিয়তা থাকবেই। তার মাঝেও তুলনায় অনেক পরে পর্দায় হাজির হয়ে একেন কিন্তু নিজস্ব অনুরাগী বৃত্ত তৈরি করে নিয়েছে। এবং কিছু ক্ষেত্রে বক্স অফিসের নিরিখে গোল দিচ্ছে ‘বড়’ গোয়েন্দাদেরও। আট থেকে আশি— একেন-ভক্তের সংখ্যা অগণিত। প্রশ্ন ওঠে, এই প্রজন্মের গোয়েন্দা হিসেবে সাম্প্রতিক অতীতে একেনের এই বিপুল জনপ্রিয়তার কারণ কী? উত্তর অন্বেষণের চেষ্টায় আনন্দবাজার অনলাইন।
শুরুটা করা যাক এমন এক জন মানুষকে দিয়ে, যিনি এখনও পর্যন্ত একেনের দু’টি ওয়েব সিরিজ় এবং দু’টি ছবি পরিচালনা করেছেন। জয়দীপ মুখোপাধ্যায় কিন্তু একেনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং তার ‘লুক’ বাকি গোয়েন্দাদের থেকে আলাদা হিসাবেই উল্লেখ করতে চাইছেন। তাঁর কথায়, ‘‘তথাকথিত বাঙালি গোয়েন্দাদের ধারালো ব্যক্তিত্বের থেকে একেন কিন্তু আলাদা। এমন এক জন মানুষ যিনি খুবই সাধারণ। যার সঙ্গে সহজেই নিজের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এরই সঙ্গে সেই মানুষটা আবার রহস্যের সমাধানও করেন।’’ মূলত কিশোর পাঠকদের কথা মাথায় রেখে লেখা হলেও একেনের কিছু গল্পে ‘হিংসা’র উল্লেখ রয়েছে। পর্দায় কিন্তু নির্মাতারা ঝুঁকি নেননি। সন্তর্পণে এড়িয়ে গিয়েছেন সেই পর্ব। পরিচালকের যুক্তি, ‘‘হিংসা এবং প্রাপ্তবয়স্কদের যে কোনও বিষয় দূরে রাখা হয়েছে বলে বড়দের পাশাপাশি ছোটরাও একেনকে পছন্দ করে।’’ এই প্রসঙ্গে একেনবাবুকে নিয়ে ছোটদের উন্মাদনার স্মৃতি উস্কে দিলেন পরিচালক। বললেন, ‘‘বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে আমরা পৌঁছতেই অনির্বাণকে ঘিরে বাচ্চাদের উৎসাহ নিজের চোখে দেখেছি। কেউ ওর কোলে উঠতে চাইছে, তো কেউ ওর সঙ্গে সেলফি তুলতে চাইছে।’’ কোনও নির্দিষ্ট একটি বৈশিষ্ট্য নয়। বরং অনেকগুলো ছোট ছোট বিষয় একটি চরিত্রে বুনে দেওয়ার মাধ্যমেই যে একেন বর্তমানে এতটা জনপ্রিয় হয়েছে, সে কথাও মনে করিয়ে দিলেন জয়দীপ।
১ বৈশাখে মুক্তি পেয়েছিল একেনের সাম্প্রতিক ছবি ‘দ্য একেন: রুদ্ধশ্বাস রাজস্থান’। এখনও বাংলার বেশ কিছু প্রেক্ষাগৃহে ছবিটি চলছে। মুক্তির এক মাসের মাথায় প্রযোজনা সংস্থার তরফে দাবি করা হয়, বক্স অফিসে ছবির ব্যবসা ছাড়িয়েছে ৩ কোটি টাকা। ওই একই সময়ে মুক্তি পেয়েছিল প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ‘শেষ পাতা’ এবং অঙ্কুশ-ঐন্দ্রিলা জুটির ছবি ‘লাভ ম্যারেজ’। এক সপ্তাহ পরে মুক্তি পায় জিৎ অভিনীত ‘চেঙ্গিজ়’। ইন্ডাস্ট্রির তথাকথিত ‘হেভিওয়েট’দের প্রতিযোগিতার মধ্যেও একেনের যাত্রা থেমে থাকেনি। কারণ কী? পরিচালকের মত, ‘‘প্রতিটা ছবির বিষয় এবং দর্শক আলাদা। অন্য ছবিগুলো কিন্তু গোয়েন্দা গল্প নয়। তাই তুলনা করাটাও ঠিক নয়।’’ অতিমারির পর মানুষ এখন যে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন, সেখানে একেন ‘টাটকা বাতাস’ হিসাবেই দর্শকের কাছে গৃহীত হয়েছে বলে মনে করছেন জয়দীপ।
পরিচালক-প্রযোজক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তাঁর ছবিতে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যাকে তুলে ধরেন। অবশ্য এখনও তিনি কোনও গোয়েন্দা ছবি পরিচালনা করেননি। তবে একেনের জনপ্রিয়তা নিয়ে তিনি অবগত। একেনকে পরিচালক এই প্রজন্মের গোয়েন্দা হিসাবে মনে করেন। বললেন, ‘‘প্রত্যেক প্রজন্মেই এক জন করে গোয়েন্দা আসে। আমরা ফেলুদা-ব্যোমকেশ পড়ে বড় হয়েছি। এখন একেন জনপ্রিয় হয়েছে। আবার ১০ বছর পরে অন্য কেউ আসবে।’’ সমাজের সাধারণ কোনও পরিচিত চরিত্রের সঙ্গে দর্শক সহজেই আত্মস্থ হতে পারেন বলে বিশ্বাস করেন শিবপ্রসাদ। উদাহরণস্বরূপ টেনে আনলেন তাঁর অভিনীত জনপ্রিয় ‘লাল্টু’ (‘হামি’ সিরিজ়ের) চরিত্রটিকে। বললেন, ‘‘লাল্টু চরিত্রে অভিনয় করে আমার সেটাই মনে হয়েছিল। পাশের বাড়ির চেনা মানুষটার মতো চরিত্র দেখলে দর্শকের সঙ্গে চরিত্রের যোগসূত্র তৈরির সুযোগ বেড়ে যায়। লাল্টু বা একেনের মতো চরিত্রগুলো তাই সহজেই মানুষের মনে জায়গা করে নিতে পেরেছে।’’
একেনের নির্মাতাদের প্রশংসা করার পাশাপাশি একেন নিয়ে দর্শকের উৎসাহর পিছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ উল্লেখ করলেন শিবপ্রসাদ। তাঁর মতে, ফেলুদা এবং ব্যোমকেশের ‘মৌলিকত্ব’ এখন আর নেই। ফলে দর্শকও কিছুটা ধাঁধায় পড়েন। শিবপ্রসাদ বললেন, ‘‘একই চরিত্রে দশ জন অভিনয় করলে সেটা কিন্তু ফ্র্যাঞ্চাইজ়ির ক্ষতি করে। এখনও পর্যন্ত একেনের ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। একেনের সাফল্যে অনির্বাণ অবশ্যই কি ফ্যাক্টর।’’
অরিন্দম শীল পরিচালিত ‘শবর’ একটি সফল ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি। পাশাপাশি পরিচালকের ব্যোমকেশ এবং মিতিন মাসিও দর্শকদের ভালবাসা পেয়েছে। শবরের মতোই সাহিত্য থেকে উঠে এসে পরবর্তী সময়ে বড় পর্দায় জনপ্রিয় হয়েছে একেন। অরিন্দম বললেন, ‘‘আসলে দর্শকগ্রাহ্য গোয়েন্দা তৈরি করতে পারলে তা জনপ্রিয় হবেই। একেনের ক্ষেত্রে চিত্রনাট্যকার এবং পরিচালককে সেই কৃতিত্ব দিতেই হবে।’’ বাঙালি দর্শক যে পর্দায় গোয়েন্দা গল্প দেখতে পছন্দ করেন তা একাধিক বার প্রমাণিত হয়েছে। বাজারে গোয়ন্দাদের ‘ভিড়’ নিয়েও রয়েছে বিস্তর মতপার্থক্য। এই প্রসঙ্গেই অরিন্দম প্রশ্ন তুললেন, ‘‘বাঙালি পরিচালকেরা কেন বেশি গোয়েন্দা ছবি তৈরি করছেন, তা নিয়ে সমালোচনা না করে বাঙালি দর্শক গোয়েন্দাদের কেন এত বেশি পছন্দ করেন, তা নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিত!’’
থ্রিলার পরিচালনায় ‘সিদ্ধহস্ত’ পরিচালক সায়ন্তন ঘোষালের মতে, বিগত একশো বছর ধরে বাংলা সাহিত্যে যত গোয়েন্দা বা অ্যাডভেঞ্চার গল্প লেখা হয়েছে, দেশের অন্য কোনও রাজ্যে সেটা হয়নি। বাঙালি দর্শক যে পর্দায় গোয়েন্দাদের দেখতে পছন্দ করেন সে কথা স্বীকার করে নিয়েই সায়ন্তন বললেন, ‘‘একেন সফল হয়েছে চরিত্রটার হাস্যরসের জন্য।’’ কারণ সায়ন্তন নিজে ‘গোরা’ (নামভূমিকায় ঋত্বিক চক্রবর্তী) সিরিজ়টি পরিচালনা করে দর্শকের কাছ থেকে বিপুল সাড়া পেয়েছেন। পরিচালক বললেন, ‘‘গোয়েন্দা হলেও তিনি আদৌ গুরুগম্ভীর নন— গোরা বা একেনের মধ্যে এই নতুনত্বটা দর্শকের কোথাও যেন বেশি আকর্ষণ করেছে।’’
বিভিন্ন সময়ে ফেলুদা বা ব্যোমকেশ চরিত্রে আবির চট্টোপাধ্যায়, অনির্বাণ ভট্টাচার্য এবং ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তকে দর্শক পেয়েছেন। আনন্দবাজার অনলাইনের তরফে একেন প্রসঙ্গে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা চেষ্টা করা হয়েছিল। তাঁরা কেউই অবশ্য এই বিষয়ে কোনও মতামত জানাতে চাননি। বাংলার বাইরেও একেন সমান জনপ্রিয়। হায়দরাবাদে তথ্য প্রযুক্তি কোম্পানিতে কর্মরত তন্ময় দাস একেনের সব ওয়েব সিরিজ় দেখে ফেলেছেন। একেনের প্রথম ছবিটিও তিনি ওটিটিতে দেখেছেন। বললেন, ‘‘আসলে আমি নিজে খুব ঘুরতে ভালবাসি। দার্জিলিং, রাজস্থান— এই জায়গাগুলোর সঙ্গে বাঙালির স্মৃতিমেদুরতা জড়িয়ে রয়েছে। তার সঙ্গে বাড়তি পাওনা, রহস্য সমাধানের আকর্ষণ। সব মিলিয়ে সারা দিন অফিসের পর একেনবাবু হালকা চালে মন ভাল করে দেয়।’’ এর পাশাপাশিই ‘জটায়ু’ চরিত্রটির প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন তন্ময়। তাঁর কথায়, ‘‘অনির্বাণের লুক এবং একেন চরিত্রটার হাস্যরস কোথাও যেন বাঙালিকে সন্তোষ দত্তের জটায়ুকে মনে পড়ায়। তাই আমার মনে হয় আরও বেশি করে দর্শক একেনের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেন।’’
যাঁকে নিয়ে এত আলোচনা, সেই একেনের চরিত্রাভিনেতা অনির্বাণ কী ভাবছেন? এখনও পর্যন্ত ছ’টি সিরিজ় এবং দু’টি ছবিতে একেন হিসাবে দর্শকের সামনে উপস্থিত হয়েছেন অনির্বাণ। তাঁর কথায়, ‘‘আরও একটা ফেলুদা বা ব্যোমকেশের মতো সিরিয়াস গোয়েন্দা হলে মনে হয় একেন এতটা জনপ্রিয় হত না।’’ রহস্য সমাধানের হালকা মেজাজ একেনের সাফল্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন অনির্বাণ। ‘‘চরিত্রটার মজাদার দিকগুলোর জন্য দর্শক একেন দেখেন। রহস্য সমাধান সেখানে উপরি পাওনা বলে আমার মনে হয়,’’ বললেন অনির্বাণ।
ছোটরা যে একেনবাবুর অনুরাগী সে বিষয়টাও অনির্বাণ জানেন। কিন্তু টাক মাথা মধ্যবয়সি এক জন গোয়েন্দাকে যে ছোটদের ভাল লাগবেই, তা নিশ্চিত ভাবে বলা কঠিন। ব্যতিক্রম একেনবাবু। বাস্তবে ছোটদের থেকে কী রকম প্রতিক্রিয়া আসে? অনির্বাণ হেসে বললেন, ‘‘অনেক অভিভাবকের থেকে শুনেছি যে তাঁদের ছেলেমেয়েরা নাকি অন্য কোনও বাংলা কনটেন্ট দেখে না। শুধুই একেনবাবু দেখে! এটা আমার কাছে বড় প্রাপ্তি। কিন্তু সেটা কী ভাবে সম্ভব হয়েছে আমার জানা নেই।’’
একেন চরিত্রে দর্শকের কাছে সাদরে গৃহীত হয়েছেন অনির্বাণ। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে অনির্বাণের প্রিয় গোয়েন্দা কে? অভিনেতা বললেন, ‘‘বলা কঠিন। কারণ ছোট বয়সে ফেলুদা এবং কাকাবাবুকে পেয়েছিলাম। একটু বড় হয়ে পেলাম ব্যোমকেশ এবং শার্লক হোম্সকে। তারও পরে পড়েছিলাম কিরীটী।’’
একেন প্রতিষ্ঠিত ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি। ভবিষ্যতে একেনকে পর্দায় হাজির করা কি অনেকটা চেনা মাঠের মতো? গোল আসবেই বলে একেন নিয়ে কি বাড়তি আত্মবিশ্বাস কাজ করে? জয়দীপ অবশ্য এই বক্তব্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হতে পারলেন না। তাঁর মতে, দর্শককে বেশি দিন ঠকানো সম্ভব নয়। বললেন, ‘‘দার্জিলিঙের পর রাজস্থানে একেনকে আরও বড় পরিসরে ভেবেছিলাম। পরবর্তী ছবিতেও নতুন কিছু হাজির করতে না পারলে দর্শক কিন্তু হতাশ হতে বাধ্য। আর সেটা একেনের ভবিষ্যৎ সফরের ক্ষেত্রে কোনও ভাবেই কাম্য নয়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy