ভোট এগিয়ে আসছে বলেই কি দেশে 'প্রোপাগান্ডা' ছবির সংখ্যা বাড়ছে? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সিনেমা শুধু তিনটি জিনিসের জন্য চলে— এন্টারটেনমেন্ট, এন্টারটেনমেন্ট, এন্টারটেনমেন্ট...। ‘দ্য ডার্টি পিকচার’ ছবিতে বিদ্যা বালনের সেই সংলাপ সত্যি হলেও পুরো সত্যি নয়। বিনোদন সিনেমার মূল কথা হলেও অনেক সময়েই তা চলে তিনটি জিনিসের জন্য— রাজনীতি, রাজনীতি, রাজনীতি।
তবে সমাজশিক্ষার ক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকা নেয় সিনেমা। রামকৃষ্ণ যেমন বলেছিলেন, ‘‘থ্যাটারে লোকশিক্ষে হয়।’’ সিনেমা দিয়েও লোকশিক্ষার অজুহাতে ভোট টানার তাগিদ কম নয়। যে তাগিদ থেকেই জন্ম হয় ‘প্রোপাগান্ডা’ ছবির। আসলে যা বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। অর্থাৎ, যে ছবি প্রদর্শনের মাধ্যমে নির্মাতাদের বিশেষ কোনও মতাদর্শ প্রচারের লক্ষ্য থাকে।
গত কয়েক বছরে দেশে শিল্পক্ষেত্রে বার বার রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠেছে। পাশাপাশি দাবি উঠেছে, বিশেষ রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য সিনেমাকে ব্যবহার করার প্রবণতাও বেড়েছে। গত বছর বিবেক অগ্নিহোত্রী পরিচালিত ‘দ্য কাশ্মীর ফাইল্স’ নিয়ে বিস্তর জলঘোলা হয়েছে। সম্প্রতি পরিচালক সুদীপ্ত সেন পরিচালিত ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ নিয়ে বিতর্ক এখনও চলছে। হালে এই আলোচনায় জায়গা করে নিয়েছে ‘দ্য বেঙ্গল ডায়েরি’ ছবিটি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের আমলে এ রাজ্যের রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিস্থিতি ক্রমশ ‘অস্থির’ হয়ে উঠেছে বলেই সনোজ মিশ্র পরিচালিত ছবিটির ট্রেলারে দাবি করা হয়েছে। আবার হালেই প্রকাশ্যে এসেছে ‘গোধরা’ নামের একটি ছবির টিজ়ার। ছবির পরিচালক এম কে শিবাক্ষ দাবি করেছেন, ২০০২ সালের গোধরাকাণ্ড কোনও ষড়যন্ত্রের ফল কি না, তা তিনি এই ছবিতে তুলে ধরেছেন। কেউ বলছেন উল্লিখিত ছবিগুলি ‘সত্য ঘটনা’ অবলম্বনে তৈরি হয়েছে। অপর পক্ষ ছবিগুলিকে ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ বলে দাগিয়ে দিতে চাইছেন। কিন্তু এই ধরনের ছবি ঠিক নির্বাচনের আবহে তৈরি হয় কেন?
২০২৪ সালে দেশে লোকসভা ভোট। লক্ষণীয়, পশ্চিমবঙ্গ এবং কেরল এখনও কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপির দখলে আসেনি। আসন্ন ভোটের কথা চিন্তা করেই কি এই ধরনের ছবি তৈরিতে বেশি করে মদত দিচ্ছেন বিজেপি সমর্থকেরা? পাশাপাশি প্রশ্ন উঠছে, এই ধরনের ছবি কি কোনও নির্দিষ্ট দলের প্রতি জনমানসের একাংশের আস্থা অর্জনে সাহায্য করতে পারে?
‘প্রোপাগান্ডা’ ছবি কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের শাসনকালের ফসল নয় মনে করেন চলচ্চিত্র গবেষক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। এই ধরনের ছবির দীর্ঘ ইতিহাসের কথা স্মরণ করিয়ে তিনি বলেন, ‘‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে এই ধরনের একাধিক উদাহরণ রয়েছে। ১৯৩২ সালে ইটালিতে পৃথিবীর প্রথম চলচ্চিত্র উৎসেবের (ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব) পিছনেও মুসোলিনির প্রত্যক্ষ উৎসাহ ছিল। কারণ, ইতিহাস বলছে, সেই সময় আন্তর্জাতিক মঞ্চে দেশ হিসাবে ইটালি তার ভাল দিকগুলোকে তুলে ধরতে চাইছিল।’’
কিন্তু এই ধরনের ছবি কি সত্যিই মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে? আরও একটি উদাহরণ তুলে ধরলেন সঞ্জয়। বললেন, ‘‘জার্মান পরিচালক লেনি রিফেনস্টল তাঁর ‘ট্রায়াম্ফ অফ দ্য উইল’ (১৯৩৫) ছবিতে হিটলারের ষষ্ঠ কংগ্রেসের অনুপুঙ্খ বিবরণ তুলে ধরেছিলেন। সেই ছবি দেখলে তো হিটলারকে এক জন সর্বাধিনায়ক এবং পরিত্রাতা হিসাবেই মনে হবে!’’ সঞ্জয় নিজে ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ ছবিটি দেখেছেন। তা জানিয়ে সঞ্জয় বললেন, ‘‘অতীতে এই ধরনের ছবি যাঁরা তৈরি করেছেন, তাঁদের বিপথগামী প্রতিভা মনে হতে পারে। কিন্তু এখনকার ছবিগুলো তৈরির ক্ষেত্রে যে দক্ষতা দরকার, তা নির্মাতাদের মধ্যে নেই। ‘দ্য কেরালা স্টোরি’র পরিচালক একদমই ছবির বিষয়বস্তু নিয়ে আত্মবিশ্বাসী নন।’’
‘দ্য কেরালা স্টোরি’ ছবিটিকে ৮ মে রাজ্যে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পর শুরু হয়েছিল বিতর্ক। পরে অবশ্য সুপ্রিম কোর্ট সেই নিষেধাজ্ঞায় স্থগিতাদেশ দেয়। এই ছবি পুরোপুরি রাজনৈতিক বলেই মনে করেন অভিনেতা তথা বারাসতের তৃণমূল বিধায়ক চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘‘আমরা তো ছবিটাকে আটকানোর চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আদালতের নির্দেশে সেটা শেষ পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখা গেল না। পুরো খেলাটাই নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে খেলা হচ্ছে। সংসদ ভবনের উদ্বোধনে দেশের রাষ্ট্রপতিকে আমন্ত্রণ জানানো হয় না! ওরা যে আর কী কী করবে, তা ভেবেই আমি অবাক হই।’’
অনেকেই দাবি করেন, ‘প্রোপাগান্ডা’ ছবি তৈরির জন্যও ‘পৃষ্ঠপোষক’রা হাজির হন। কখনও সেখানে পরিচালক প্রচারের স্বার্থে মদতপুষ্ট ছবিটি তৈরি করতে রাজি হন। আবার কখনও ব্যক্তিগত দর্শনের কারণেও এই ধরনের ছবি তৈরি করে থাকেন। তবে দুই ক্ষেত্রেই ছবিতে ‘সত্য’ তুলে ধরার প্রক্রিয়া ব্রাত্য হয়ে যায় বলে মনে করেন পরিচালক অনিকেত চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘বিজেপি বা আরএসএস কিন্তু কাউকে ডেকে ছবি তৈরি করার নির্দেশ দেবে না। দলের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে টাকা বিনিয়োগ হয়।’’ আবার এই রকম মতও উঠে আসছে যে, অনেক সময় প্রযোজকের কোনও অন্যায় বা দুর্নীতি ঢাকার বিনিময়ে তাঁর উপরে এই ধরনের ছবি তৈরির জন্য চাপ সৃষ্টি করা হয়। কখনও আবার ছবিমুক্তির পরে, ছবিকে হাতিয়ার করলে লাভ হতে পারে জেনেও রাজনৈতিক দল সেই ছবির সমর্থনে প্রচারে নামে। অনিকেতের বক্তব্যে হতাশা স্পষ্ট হয়, ‘‘গোপাল পাঁঠাকে ‘নায়ক’ হিসেবে তুলে ধরতে নাকি বিবেক অগ্নিহোত্রী ছবি তৈরি করবেন বলে শুনেছি! পরিচালক হিসেবে এই ধরনের চিন্তাভাবনা আমি কল্পনাও করতে পারব না।’’
সম্প্রতি, বীর সাভারকরের বায়োপিক নিয়েও বিতর্ক দানা বেঁধেছে। নির্মাতাদের দাবি, নেতাজি, ভগৎ সিংহ এবং ক্ষুদিরাম বসুর মতো স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অনুপ্রাণিত করেছিলেন সাভারকর। এই প্রসঙ্গে অনিকেতের সাফ কথা, ‘‘গান্ধী হত্যার অন্যতম কাণ্ডারিকে নায়ক দেখিয়ে ছবি তৈরি হচ্ছে! অথচ গান্ধীকে কারা খুন করলেন তা নিয়ে দীর্ঘ দিনের গবেষণার উপর নির্ভর করে ছবি তৈরি করতে চাইছি, কিন্তু কেউ প্রযোজনা করতে রাজি হচ্ছেন না।’’ একই সঙ্গে অনিকেত বলেন, ‘‘অতীতে মানুষকে সচেতন করতে একাধিক বাণিজ্যিক ছবি তৈরি হয়েছে। সেই সব ছবি আজও মানুষ মনে রেখেছেন।’’ কখনও কখনও ভাল ছবির পিছনে সরকারি সমর্থনও লক্ষ করা গিয়েছে। অনিকেত স্মরণ করালেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু নিজে এক সময় ভাল ছবি তৈরির জন্য দেশের মুখ্যমন্ত্রীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। ফলস্বরূপ সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’র পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বিধানচন্দ্র রায়।’’
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনকে মাথায় রেখেই কি বিজেপি এই ছবি তৈরির ‘খেলা’য় মেতেছে? অভিযোগ অস্বীকার করে রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘আসলে, সব ঘটনাকেই এখন বিভাজনের রাজনীতিতে রাঙিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা নেহাত কাকতালীয় বিষয়। সব কিছুকে যাঁরা নির্বাচনকেন্দ্রিক দৃষ্টভঙ্গি থেকে দেখেন, সেটা তাঁদের দুর্বলতা।’’ এই প্রসঙ্গেই শমীক পাল্টা যুক্তি দিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ‘দ্য তাস্খন্দ ফাইল্স’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছবি হওয়া সত্ত্বেও সেই ছবি নিয়ে খুব বেশি চর্চা হয়নি। ওই ছবিটা কিন্তু একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের কাছে বিপজ্জনক।’’ উল্লেখ না করলেও শমীক যে কংগ্রেসকেই লক্ষ্য করেছেন, তা স্পষ্ট। প্রসঙ্গত, ‘দ্য তাস্খন্দ ফাইল্স’ ছবিটি নির্মিত হয় ২০১৯ সালে। দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুরহস্য নিয়ে ছবিটি তৈরি করেন বিবেক অগ্নিহোত্রী। অভিনয় করেছিলেন নাসিরুদ্দিন শাহ, মিঠুন চক্রবর্তী, পঙ্কজ ত্রিপাঠীরা। যদিও ছবিটি সে ভাবে বাণিজ্যিক সাফল্য পায়নি। তা সত্ত্বেও দু’টি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিল।
‘প্রোপাগান্ডা’ ছবি হিসাবে চলতি বছরে যে ছবি নিয়ে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বিতর্ক দানা বেঁধেছে, সেই ‘দ্য কেরালা স্টোরি’র পরিচালক সুদীপ্ত সেন বিষয়টা নিয়ে কী ভাবছেন? পরিচালক আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘রাজনৈতিক কোনও উদ্দেশ্যসাধন করতে আমি ছবিটা তৈরি করিনি। আমার ছবি কোনও রাজনৈতিক দলকে সুবিধা দিতে পারে, সে কথাও আমি বিশ্বাস করি না।’’
সুদীপ্তের ছবিতে দাবি করা হয়েছে, কেরলের হিন্দু মহিলাদের একাংশকে বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করে ‘আইসিস’-এ যোগ দিতে বাধ্য করা হয়েছে। পরিচালক বললেন, ‘‘আমার ছবিতে তো আমি জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক প্রশ্ন তুলেছি। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেছি।’’ কিন্তু তাঁর ছবির পক্ষে বিজেপি কথা বলেছে। সুদীপ্তের যুক্তি, ‘‘শুধু বিজেপি কেন, আমার মতে কংগ্রেস-সহ সব রাজনৈতিক দলেরই এই ছবিটা নিয়ে কথা বলা উচিত। কারণ ছবিটা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বার্তা দেয়।’’
আট বছর আগে এই ছবির জন্য তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করেন সুদীপ্ত। ২০১৮ সালে প্রযোজক তাঁর ছবিটি করতে রাজি হন। সুদীপ্ত বলেন, ‘‘আমি তো তখন জানতাম না ছবি কবে মুক্তি পাবে। আমাদের দেশে প্রতি মাসেই কোথাও না কোথাও ভোট হয়। তার মানে কি ছবি রিলিজ় করব না!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy