বলিউডে বক্স অফিস সাফল্যের সংজ্ঞা কী? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
বিনোদনের দুনিয়া এক অদ্ভুত রঙ্গমঞ্চ। রায় মহাশয়ের গানের কথার রেশ ধরে বলাই যায়, এই দুনিয়ার যে দিকেই তাকাই, সবটুকু দেখে অবাক হতে হয়। এই রঙ্গমঞ্চে যেমন ডানা মেলে আধিপত্য বিস্তার করে কল্পনার জগৎ, তেমনই বাস্তবের রূঢ় চিত্রও প্রতিফলিত হয় ছত্রে ছত্রে। সাধারণ মানুষের অবসর সময়ে বিনোদনের ভূমিকা যতটা, একুশ শতকে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার শিল্পীর জীবিকা উপার্জনের পন্থাও এই বিনোদন মাধ্যমই। অভিনেতা, পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, গীতিকার থেকে শুরু করে ক্যামেরার নেপথ্যের অন্য কলাকুশলী— এঁদের নিত্যযাপন অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত বিনোদন-বাণিজ্যের সঙ্গে। যে হেতু দর্শক ও শ্রোতার কাছে শিল্পের আবেদন আপেক্ষিক, তাই তার সঙ্গে যুক্ত ব্যবসার পরিমাণও নির্ণীত হয় সাধারণ মানুষের কাছে সেই শিল্পের গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তিতে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে ছবি বানালেই তো হল না, সেই ছবির ব্যবসার অঙ্ক খরচের অঙ্ককে ছাপিয়ে না গেলে লাভ হবে কী করে! আর ব্যবসা করে যদি লাভই না হয়, তা হলে শিল্পীদের পেট চলবে কী করে! ব্যবসায় নেমে তাই লাভের লক্ষ্য আপসহীন। কিন্তু সেই ছবি যদি আদপেই পাতে দেওয়ার মতো না হয়? সে ক্ষেত্রে কী ভাবে খরচের টাকা তোলেন ছবির প্রযোজক? এই মুশকিল আসান করতেই অবতারণা হরেক রকমের বিপণন কৌশলের। কোনও ছবিকে করমুক্ত করে তার টিকিটের দাম কমিয়ে দেওয়া, বা ছবির টিকিট বিক্রির ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকমের আকর্ষণীয় ‘অফার’ দেওয়া— ছবির খরচ তুলতে ও লাভের অঙ্ক গুনতে আজকাল এমন পন্থাই অবলম্বন করছেন নির্মাতারা। তাতে কাজও হচ্ছে ভালই, তরতরিয়ে বাড়ছে ছবির ব্যবসার পরিমাণ। সাধারণ মানের একটা ছবির জন্য ‘এক সপ্তাহে একশো কোটি’ রোজগার আজকাল প্রায় জলভাত। তবে এই যে ছবির ব্যবসায় লাভের খতিয়ান, তা আদৌ ভরসাযোগ্য?
সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে লক্ষ্মণ উটেকর পরিচালিত ছবি ‘জ়রা হটকে জ়রা বাঁচকে’। ভিকি কৌশল ও সারা আলি খান অভিনীত এই ছবি মুক্তির এক সপ্তাহের মধ্যেই ব্যবসা করে ফেলেছে প্রায় ৩৮ কোটি টাকার। অথচ ছবি নিয়ে তেমন চর্চা নেই দর্শকের মধ্যে। সমালোচকদের তরফেও তেমন প্রশংসা অর্জন করতে পারেনি এই ছবি। এ দিকে ছবি রমরমিয়ে ব্যবসা করছে বক্স অফিসে। কী করে? প্রেক্ষাগৃহে দর্শক টানার জন্য ও ছবির টিকিট বিক্রি বাড়ানোর জন্য প্রথম সপ্তাহান্তে ‘একটি কিনলে একটি বিনামূল্যে’-র পন্থা অবলম্বন করেছিল ‘জ়রা হটকে জ়রা বাঁচকে’ ছবির বিপণন কুশলীরা। তাতেই হুড়মুড়িয়ে বিক্রি হয়েছে ছবির টিকিট। প্রথম সপ্তাহান্তে বিক্রি হয়েছে ছবির আড়াই লক্ষ টিকিট, তবে পুরোটাই বিনামূল্যে। সেই বিনামূল্যের টিকিটের দাম দিতে হয়েছে ছবির প্রযোজককেই। তাতে প্রযোজকের ঘর থেকে গিয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা। দ্বিতীয় সপ্তাহান্তেও ছবির টিকিট বিক্রির ক্ষেত্রে ‘একটি কিনলে একটি বিনামূল্যে’-এর পথেই হাঁটতে চলেছে ‘জ়রা হটকে জ়রা বাঁচকে’ ছবির নির্মাতারা। তাঁদের অনুমান, আগামী সপ্তাহান্তে বিনামূল্যে বিক্রি হওয়া টিকিটের সংখ্যা ছাড়িয়ে যেতে পারে তিন লক্ষ। সে ক্ষেত্রে প্রযোজকের ঘর থেকে যাবে প্রায় সাড়ে সাত কোটি টাকা। দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষে ছবির লাভের পরিসংখ্যানে কি ধরা থাকবে এই বিনামূল্যে বিক্রি হওয়া টিকিটের অঙ্কও? না কি ছবি নিয়ে চর্চা বাড়াতে লাভের অঙ্ক ফুলিয়ে-ফাঁপিয়েই দেখানো হবে ছবির তরফে?
‘জ়রা হটকে জ়রা বাঁচকে’-এর মতো টিকিট বিক্রির ক্ষেত্রে ‘একটি কিনলে একটি বিনামূল্যে’-র পন্থা অবলম্বন করতে চলেছে ‘গদর ২’ ছবিও। আগামী ১১ অগস্ট মুক্তি পেতে চলেছে সানি দেওল ও আমিশা পটেল অভিনীত এই ছবি। দর্শককে প্রেক্ষাগৃহে টানতে টিকিট বিক্রির ক্ষেত্রে ‘একটি কিনলে একটি বিনামূল্যে’-এর পথে হাঁটছেন এই ছবির নির্মাতারাও। শুধু তাই নয়, টিকিটের দাম ধার্য করা হয়েছে মাত্র ১৫০ টাকা। অর্থাৎ ‘একটি কিনলে একটি বিনামূল্যে’ পন্থায় টিকিটপিছু খরচ হচ্ছে মাত্র ৭৫ টাকা। তবে, শুধুমাত্র অনলাইনে টিকিট কিনলেই মিলবে এই সুযোগ। ‘গদর ২’ ছবির নির্মাতাদের আশা, যত বেশি দর্শক প্রেক্ষাগৃহে আসবেন ছবি দেখতে, ছবি নিয়ে চর্চা তত বেশি হবে। লোকমুখে প্রচারের উপর নির্ভর করেই ব্যবসা বাড়াতে আগ্রহী ছবির প্রযোজক।
আগামী সপ্তাহে ১৬ জুন মুক্তি পেতে চলেছে বহুলচর্চিত ছবি ‘আদিপুরুষ’। ওম রাউত পরিচালিত এই ছবিতে অভিনয় করেছেন দক্ষিণী তারকা প্রভাস ও বলিউড অভিনেত্রী কৃতী স্যানন। ছবি মুক্তির সপ্তাহ খানেক আগেই তেলঙ্গানায় বিনামূল্যে বিক্রি হয়েছে ‘আদিপুরুষ’-এর ১০ হাজার টিকিট। সৌজন্যে, ‘দ্য কাশ্মীর ফাইল্স’ ছবির অন্যতম প্রযোজক অভিষেক অগরওয়াল। তেলঙ্গানার দর্শকের উদ্দেশে ‘আদিপুরুষ’-এর ১০ হাজার টিকিট দান করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ছবির প্রতি নিজের সমর্থন থেকেই নাকি অভিষেকের এই সিদ্ধান্ত। তবে বিনামূল্যে এই টিকিট বরাদ্দ থাকছে স্রেফ রাজ্যের সরকারি স্কুলের পড়ুয়া, বৃদ্ধাশ্রম ও অনাথ আশ্রমের সদস্যদের জন্য। শুধু অভিষেকই নন, আর্থিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া বাচ্চাদের জন্য ১০ হাজার টিকিট কিনছেন বলিউড অভিনেতা রণবীর কপূরও। পাশাপাশি খবর, হায়দরাবাদে নাকি ‘একটি কিনলে একটি বিনামূল্যে’ পন্থায় হাঁটতে চলেছেন ‘আদিপুরুষ’ ছবির প্রদর্শক ও পরিবেশকরা। প্রায় ৫০০ কোটি টাকা খরচ করে তৈরি হয়েছে এই ছবি। ছবি মুক্তির আগেই বাজেটের প্রায় ৮৫ শতাংশ টাকা ঘরে তুলে নিয়েছেন প্রযোজক। ১১ জুন থেকে সবেমাত্র শুরু হয়েছে ছবির টিকিটের অগ্রিম বুকিং। তার আগেই স্যাটেলাইট স্বত্ব, ডিজিটাল স্বত্ব ইত্যদি বিক্রি করে প্রায় ২৪৭ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে ‘আদিপুরুষ’। তা ছাড়াও দক্ষিণ ভারতে ছবি মুক্তির ও তার ব্যবসার আনুমানিক পরিসংখ্যান থেকে ঘরে এসেছে প্রায় ১৮৫ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে মুক্তির সপ্তাহ খানেক আগেই প্রায় ৪৩২ কোটি টাকা উপার্জন করে ফেলেছে ‘আদিপুরুষ’। খরচ তুলতে বাকি মাত্র ৬৮ কোটি টাকা। সেই টাকা তুলে ফেললেই কি ‘হিট’ ছবির তকমা পেয়ে যাবে প্রভাস ও কৃতী স্যানন অভিনীত এই ছবি?
শুধু বলিউড ছবিই নয়, ‘একটি কিনলে একটি বিনামূল্যে’ পন্থায় সায় দিয়েছে হলিউডের ‘স্পাইডার-ম্যান: অ্যাক্রস দ্য স্পাইডার-ভার্স’ ছবিও। হিন্দি, তামিল, তেলুগু, মরাঠি, পঞ্জাবি, কন্নড়, মালয়ালমের মতো একাধিক ভারতীয় ভাষায় মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবি এক সপ্তাহে ভারতের বক্স অফিসে রোজগার করেছে প্রায় ২৮ কোটি টাকা।
শুধু টিকিটের উপর আকর্ষণীয় ছাড়ই যে ছবির ব্যবসার একমাত্র উপায়, তা নয়। দেশের একাধিক রাজ্যে করমুক্তির মাধ্যমেও রমরমিয়ে ব্যবসা করেছে বিভিন্ন ছবি। যেমন, হালের ‘দ্য কেরালা স্টোরি’। ছবির প্রচার ঝলক মুক্তির পর থেকে কম বিতর্ক হয়নি ছবি নিয়ে। তার মধ্যে বেশির ভাগ বিতর্কই নেতিবাচক। তবে তার বিরূপ প্রভাব পড়েনি বক্স অফিসে। বরং, মুক্তির পর থেকেই ভাল ফর্মে ব্যবসা করছে বাঙালি পরিচালক সুদীপ্ত সেন পরিচালিত এই ছবি। ১০০ ও ২০০ কোটির গণ্ডি ছাড়িয়ে এ বার ২৫০ কোটির দিকে এগোচ্ছে ‘দ্য কেরালা স্টোরি’র বক্স অফিস ব্যবসার অঙ্ক। বিশ্ব জুড়ে ইতিমধ্যেই ২৯০ কোটি টাকা উপার্জন করে ফেলেছে অদা শর্মা অভিনীত এই ছবি। ৫ মে মুক্তির পরে হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশে রাজ্য সরকারের তরফে করমুক্ত করে দেওয়া হয় এই ছবি। ছবির উপর রাজ্য সরকারের জিএসটি মূল্য না চাপায় বেশ কিছুটা কমে যায় ছবির টিকিটের দাম। টিকিটের দাম কমায় আরও বেশি সংখ্যক দর্শক প্রেক্ষাগৃহে ভিড় জমান ছবি দেখতে। ফলে, চড়চড় করে বাড়তে থাকে ছবির ব্যবসার অঙ্ক।
গত বছর প্রায় একই গ্রাফ ছিল বিবেক অগ্নিহোত্রী পরিচালিত ছবি ‘দ্য কাশ্মীর ফাইল্স’-এর। উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানা, গোয়া, গুজরাত, উত্তরাখণ্ড, বিহার, ত্রিপুরা ও কর্নাটকে করমুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল এই ছবিকে। দেশের বক্স অফিসেই হইহই করে ৩০০ কোটি টাকার ব্যবসা করেছিল এই বিতর্কিত ছবি। দুনিয়াজোড়া বক্স অফিসে মোট ব্যবসার অঙ্ক ছিল প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা। করমুক্তির ফলে যে স্রেফ টিকিটের মূল্যই কম হয়, তা নয়। দর্শকের মনে ধারণা জন্মায় যে, রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা সরকারও ছবি ছবির সঙ্গে জড়িত আদর্শকে সমর্থন করছেন। সেই ধারণা থেকে ছবি দেখার উৎসাহও কয়েক গুণ বেড়ে যায়। স্বাভাবিক ভাবে, বাড়তে থাকে ছবির ব্যবসার পরিমাণও।
২০২০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘ছপাক’। মেঘনা গুলজ়ার পরিচালিত ও দীপিকা পাড়ুকোন অভিনীত এই ছবি করমুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তীসগঢ়ে। অ্যাসিড হামলার ভুক্তভোগী লক্ষ্মী অগরওয়ালের জীবনাবলম্বনে তৈরি এই ছবি যদিও বক্স অফিস ব্যবসার দিক থেকে টেনেটুনে ৫৫ কোটি টাকার গণ্ডি পার করেছিল।
সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে তৈরি হয়েছিল ‘প্যাড ম্যান’, ‘টয়লেট: এক প্রেম কথা’র মতো ছবি। দু’টি ছবিতেই অভিনয় করেছিলেন অক্ষয় কুমার। ‘প্যাড ম্যান’কে রাজস্থানে ও ‘টয়লেট: এক প্রেম কথা’ ছবিকে উত্তরপ্রদেশে করমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছিল।
২০১৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ভিকি কৌশল অভিনীত ছবি ‘উরি: দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ ঝড় তুলেছিল বক্স অফিসে। ২০১৬ সালে উরিতে ঘটে যাওয়া ভারত-পাক সংঘর্ষের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল এই ছবি। পাশাপাশি, সেই সময় পুলওয়ামা সংঘর্ষ নিয়েও উত্তপ্ত ছিল গোটা দেশ। সেই প্রভাব সরাসরি পড়েছিল ‘উরি: দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’-এর বক্স অফিস ব্যবসার উপরে। উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথের সরকার করমুক্ত ঘোষণা করে আদিত্য ধর পরিচালিত এই ছবিকে।
এ ছাড়াও করমুক্তির আওতায় এসেছিল ‘এয়ারলিফ্ট’, ‘নীরজা’র মতো ছবিও।
করমুক্তি হোক বা অভিনব বিপণন কৌশল— প্রচার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছবির জনপ্রিয়তা বাড়ে বইকি। সেই জনপ্রিয়তার জেরে আরও চাঙ্গা হয় বক্স অফিস। তবে যে পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে কোনও ছবিকে ‘হিট’ বা ‘সুপারহিট’ বলে ঘোষণা করা হয়, তার নেপথ্যে কারসাজিও কম নয়। মায়ানগরী তথা বলিউডে এই ঘটনা ঘটছে আকছার। টলিউডের চিত্রটা ঠিক কী? টলিপাড়ার এক প্রথম সারির পরিবেশক অবশ্য এই বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ। তাঁর মতে, বলিউড একটা বড় বাজার হওয়ায় সেখানে প্রতিযোগিতা অনেক বেশি। তাই এক একটি ছবির প্রচার কৌশলও অভিনব। কিন্তু ছবির ব্যবসার পরিমাণ ঠিক কত, সেই অঙ্ক ঘোষণা করা সম্পূর্ণ ভাবে নির্ভর করে ছবির প্রযোজকের উপর। বাইরে থেকে সেই হিসাব করে ওঠা বেশ কঠিন কাজ। তা হলে, ছবির তুল্যমূল্য বিচার হবে কী ভাবে? দর্শকের রুচিই শেষ কথা, না সমালোচকের রায়? না কি চোখধাঁধানো বিপণন কৌশলের ভিড়েই চাপা পড়ে যাবে ছবির গুণগত মান? এখন সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সেটাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy