পুনরুজ্জীবন: ‘কল্পনা’ ছবির একটি দৃশ্য। ছবি শিবেন্দ্র সিংহ দুঙ্গারপুরের সংগ্রহ থেকে।
সূত্রপাতটা হয়েছিল ইতালির বোলোনিয়া শহরে। একটি চলচ্চিত্র উৎসবে গিয়ে মার্টিন স্করসেসির ফিল্ম ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা হল। ওঁরা বললেন, রবিশঙ্কর নিজে স্করসেসিকে অনুরোধ করেছেন উদয়শঙ্করের ‘কল্পনা’ ছবিটি পুনরুজ্জীবনের (রেস্টোরেশন) জন্য। কিন্তু কপিরাইটের ঝামেলায় নেগেটিভ পাওয়া যাচ্ছে না।
পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের প্রাক্তনী শিবেন্দ্র সিংহ দুঙ্গারপুর সে সময়ে ভারতে চলচ্চিত্র সংরক্ষণবিদ্যার পথিকৃৎ, জাতীয় ফিল্ম আর্কাইভের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পি কে নায়ারকে নিয়ে তথ্যচিত্র বানাচ্ছিলেন। শিবেন্দ্র জানতেন, উদয়শঙ্কর ওই ছবিটিতে আরও কিছু পরিবর্তন করেছিলেন। পরিবর্তিত ছবিটির একটি প্রিন্ট এবং একটি নেগেটিভ তিনি ১৯৭০ সালে নায়ারকে দিয়েছিলেন। শিবেন্দ্রই তখন নায়ারকে রাজি করিয়ে সেই নেগেটিভ স্করসেসির কাছে পৌঁছে দেন। বোলোনিয়ার একটি ল্যাবেই ‘কল্পনা’র পুনরুজ্জীবন হয়। ২০১২-র কান উৎসবে দেখানো হয় সেই ছবি।
কিন্তু কপিরাইট সমস্যার কারণেই সেই ‘কল্পনা’ আজও এ দেশে সর্বসাধারণ্যে দেখানো যায়নি। নভেম্বর মাসে কলকাতা কিন্তু সেই সুযোগ পেতে চলেছে।
কী ভাবে? বেশ কিছু দিন ধরেই শিবেন্দ্র দেশের নানা শহরে ফিল্ম সংরক্ষণ ও রেস্টোরেশনের কর্মশালা করছেন। পি কে নায়ারের আশীর্বাদ আর স্করসেসির সহযোগিতা নিয়ে মুম্বইয়ে তিনি তৈরি করেছেন নিজের ফিল্ম সংরক্ষণ সংস্থা, ফিল্ম হেরিটেজ ফাউন্ডেশন। সম্প্রতি মুম্বইয়ে সেই কর্মশালাতেই ঘুরে গিয়েছেন চিত্রপরিচালক ক্রিস্টোফার নোলান। পরের কর্মশালা কলকাতায়। সেখানে অ্যাকাডেমি অব মোশন পিকচার্স, জর্জ ইস্টম্যান মিউজিয়াম, ক্রাইটেরিয়ন ফিল্মস এবং ব্রিটিশ ইম্পিরিয়াল ওয়ার মিউজিয়ামের কর্তাদের আসার কথা। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব ফিল্ম আর্কাইভস (ফিয়াফ)-এর শংসাপত্রপ্রাপ্ত এই কর্মশালার ফাঁকেই দেখানো হবে ‘কল্পনা’ও।
শিবেন্দ্র সিংহ দুঙ্গারপুর
মঙ্গলবার কলকাতায় বসে শিবেন্দ্র নিজেই খবরটা জানিয়ে বললেন, ‘‘কলকাতারই ফিল্ম সংরক্ষণে সবচেয়ে বেশি নজর দেওয়া উচিত! কলকাতা তো জানে, কী ভাবে হীরালাল সেনের সব ছবি পুড়ে গিয়ে একটা আস্ত ইতিহাস হারিয়ে গেল! ভারতের প্রথম চলচ্চিত্রকার তো তিনিই!’’ কিন্তু শিবেন্দ্র দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করেছেন, এ দেশে ফিল্মের রেস্টোরেশন বলতে এখনও ডিজিটাল রূপান্তর আর খানিকটা রঙের মেরামতি (কালার কারেকশন) ছাড়া কিছু ভাবা হয় না। ‘‘রেস্টোরেশনের কাজ শুধু প্রযুক্তির নয়, বরং শিল্পবোধের। একটা ছবিকে তার স্বরূপে ফিরিয়ে দেওয়াটা একটা শিল্প। অপু ট্রিলজি সম্প্রতি বিদেশে যে ভাবে নতুন প্রাণ পেল, সেই মানের কাজ এখনও এ দেশে সম্ভব হচ্ছে না।’’
হবেই বা কী করে? শিবেন্দ্র মনে করিয়ে দেন, মাত্র চার বছর আগেও বেশির ভাগ ছবি সেলুলয়েডে তৈরি হত। এই ক’দিনেই এমন পরিস্থিতি যে, এখন সেলুলয়েড ছবি দেখানোর উপযুক্ত প্রেক্ষাগৃহই পাওয়া যায় না।
তা হলে উপায়? শিবেন্দ্রর মতে, ভারতের মতো দেশে যেখানে এতগুলি আঞ্চলিক ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি রয়েছে, এত ছবি যেখানে তৈরি হয়, সেখানে শুধু সরকারি প্রচেষ্টায়, শুধু সরকারি আর্কাইভের পক্ষে গোটা দেশের ছবি সংরক্ষণের দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব নয়। সরকারি-বেসরকারি প্রয়াসের সমন্বয় দরকার। আমেরিকায় অন্তত ২৫টি আর্কাইভ আছে। ফ্রান্স-ইতালি-ব্রিটেনে আছে অন্তত ১০টি করে। রাজ্য আর্কাইভের উন্নয়ন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গেও কথা চলছে শিবেন্দ্রর। বললেন, ‘‘নায়ারকে নিয়ে ছবি করতে গিয়েই বুঝেছিলাম, কী পরিমাণ ছবি আমরা ইতিমধ্যেই হারিয়েছি। যত বেশি করে মানুষ নিজেদের ইতিহাসকে সংরক্ষণের গুরুত্ব বুঝবেন, ততই ভাল।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy