ওই হাসি, কপাল জোড়া টিপ, সব থমকে গেল হঠাৎই।
মিউজিক ভিডিয়োর জন্য আজ, শুক্রবারই তাঁর লোকেশন দেখতে যাওয়ার কথা ছিল। দুর্গাপুজোর জন্য তসর আর সিল্কের উপর নতুন নকশা নিয়ে কাজ করছিলেন তিনি। গত মঙ্গলবারও ওয়ার্কশপে কাজ করেছেন। ইচ্ছে ছিল, থিয়েটার ড্রামায় নতুন ভাবে নিজেকে মেলে ধরার। শর্বরী দত্ত। এমন প্রাণবন্ত এক মানুষ কি নিজে জানতেন ভাদ্রের এক সকাল এমন নির্মম ভাবে পৃথিবী থেকে ছিনিয়ে নেবে তাঁকে?
পুরুষের পোশাকের কথা ভাবলেন এক মহিলা, তা-ও ন’য়ের দশকের গোড়ায়। সেখান থেকেই শুরু। শুরুর দিকের সঙ্গী ছিলেন অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। শুক্রবার তিনি বললেন, “আমি শর্বরীদির পোশাকের প্রথম মডেল ছিলাম। খুব আলোড়ন ফেলেছিল ওই শুট। তার পর থেকে ছবি হোক বা পুজোর কেনাকাটা, শর্বরীদিকে ফোনে জানিয়ে দিতাম আমার কী চাই। উনি জানতেন আমার পছন্দ! খুব বাজে সময় এখন। কী আর বলব! কলকাতার লেজেন্ডের সারিতে ওঁর নাম থেকে গেল। আমাদের জন্য রইল ওঁর সৃষ্টি!”
নিজেকে কোনও কালেই ফ্যাশন ডিজাইনার বলতে চাইতেন না। মকবুল ফিদা হুসেন থেকে সচিন তেন্ডুলকর— তাঁর ক্লায়েন্ট তালিকা ঈর্ষণীয়।মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, তিনি এক জন শিল্পী। ইদানীং শহর নিয়ে মেতে উঠেছিলেন। বারাণসী, রোম আর কলকাতা— তিন শহরের ফ্যাব্রিক আর ক্রাফ্টকে মিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন পোশাকের শরীরে।
শুরুর দিকের সঙ্গী ছিলেন অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়
শর্বরীকে দেখেই ফ্যাশন দুনিয়ায় কাজ করার কথা ভেবেছিলেন অগ্নিমিত্রা পল। শর্বরীর সঙ্গে তাঁর ২৫ বছরের সম্পর্ক। তাঁর মনে পড়ছিল শর্বরীকে প্রথম দেখার কথা। চোখের নীচে ঘন কাজল, উজ্জ্বল রং আর অ্যান্টিক গয়না মানেই শর্বরী। অগ্নিমিত্রার কথায় উঠে এল শর্বরীর সেই চিরকালের সাজ। বললেন, “আমার বরের বিয়ের পাঞ্জাবি করাতে গিয়েই ওঁর সঙ্গে আলাপ! রিতু কুমার, শর্বরীদি— এঁরাই ফ্যাশন দুনিয়ায় আমার আইকন।প্রচুর শো করেছি আমরা একসঙ্গে। খুব স্নেহ পেয়েছি।মেনে নিতে পারছি না ওঁর চলে যাওয়া। জানি না দেখতে যেতেও পারব কি না!’’
অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত সিঙ্গাপুর থেকে বললেন, “শর্বরীদি একজন পরিপূর্ণ নারী। ওই হাসি। কপাল জোড়া টিপ। আন্তর্জাতিক মানের ডিজাইনার তো বটেই, কিন্তু নানা ঝড়জলেও কাজের মধ্যে একটানা নিজেকে প্রকাশ করে চলেছিলেন।আমার বরের ইজিপশিয়ান মোটিফের বিয়ের পাঞ্জাবি আজও যত্ন করে রাখা আছে। ‘শূন্য’-তেই শেষ দেখা হল তা হলে। নাহ…মেনে নিতে পারছি না।”
লকডাউনে অবশ্য থেকে থেকেই মনখারাপে ছিলেন শর্বরী। ওয়ার্কশপে কাজ করতে যেতে পারছেন না— এটাই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা। আফশোস করছিলেন, প্রচুর ব্রাইডাল অর্ডার জমা হয়ে আছে। অথচ লকডাউনে কাজ হচ্ছে না। কারণ, বিয়ের তারিখ জানা নেই।
বিয়েতে শর্বরীর ডিজাইন করা পোশাক উপহার পেয়েছিলেন অভিষেক
বস্তুত, ‘বিগ ফ্যাট ওয়েডিং’ আর শর্বরীর ডিজাইন ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে।
২০০৭ সালের সেই বিয়ের কার্ডে ছিল রাধা-কৃষ্ণের ছবি। কনের নাম ঐশ্বর্যা। বর অভিষেক বচ্চন। বহুচর্চিত সেই বলিউডি বিয়ের সময় ডিজাইনার শর্বরীর বুটিকে দেখা গিয়েছিল কনের মা বৃন্দা রাইকে। বিয়েতে স্ত্রীর বাড়ির তরফে শর্বরীর ডিজাইন করা পোশাক উপহার পেয়েছিলেন অভিষেক। তা ছাড়াও বেয়াই অমিতাভের কুর্তা আর নিজের স্বামী এবং ছেলের জন্য বেশ কিছু পোশাক বৃন্দা কিনেছিলেন শর্বরীর কাছ থেকে।
২০১৩ সালে আবার সকলের নজর টলিউডের বহুচর্চিত বিয়েতে। পাত্র-পাত্রীর নাম নিসপাল সিংহ এবং কোয়েল মল্লিক। ডিজাইনার সেই শর্বরী। বিয়ের রাতে পাত্রের পোশাকের দায়িত্ব সেই তাঁরই উপর। ১ ফেব্রুয়ারি বাঙালি মতে বিয়েতে কোয়েল যে লাল রঙের বেনারসিটি পরেছিলেন, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি হয়েছিল নিসপালের পোশাক। কোয়েল-নিসপাল সেই পোশাকের জন্যই শর্বরীর বাড়িতে বার চারেক এসেছিলেন। অবশেষে দু’জনেই নিসপালের জন্য ‘অঙ্গরাখা’ স্টাইলের একটি ব্রোকেড কুর্তা পছন্দ করেছিলেন। এ দিন হতবাক কোয়েল বলছিলেন, ‘‘সকালে ঘুম থেকে উঠে খবরটা পেয়ে এত অবাক হয়েছি, যে কী বলব বুঝতে পারছি না। আমাদের বিয়ের সময় রানের পাঞ্জাবির দায়িত্ব ছিল ওঁর। প্রথম আলাপেই মানুষকে এত আন্তরিক করে নিতে পারতেন। এটা মানুষ হিসেবে একটা বিশাল গুণ ছিল ওঁর। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির আইকন তো ছিলেনই, বিশেষ করে পুরুষদের সাজপোশাকে উনি একটা বিপ্লব এনেছিলেন। স্রেফ একটা পাঞ্জাবিই যে শুধু পুরুষের পোশাক হতে পারে না, তাতে যে কত রকমের কাজ আর স্টাইল থাকতে পারে, সেই চোখ আমাদের উনিই খুলে দিয়েছিলেন। তাঁর এ ভাবে চলে যাওয়ায় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিরই যে শুধু ক্ষতি হল তা নয়, বাঙালি এবং কলকাতারও বিরাট ক্ষতি হল।’’
স্বভূমিতে সৃজিত-মিথিলার রাজকীয় বউভাত, মিথিলার শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে শর্বরী দত্ত সৃজিতকে পরিয়েছিলেন আচকান আর ধুতি
২০২০-র ফেব্রুয়ারিতে সৃজিত-মিথিলার রাজকীয় বউভাতে মিথিলার শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে সৃজিতকে আচকান আর ধুতি পরিয়েছিলেন শর্বরী। আনন্দবাজার ডিজিটালকে সে দিন বলেছিলেন, “দক্ষিণ আফ্রিকায় শুটে যাবে সৃজিত। তাই ওর আচকানে ওই প্রদেশের মোটিফের কাজ তুলে দিলাম ঘন সুতোয়।” এমনই করেই আলাদা হয়ে যেতেন তিনি নিজের সৃষ্টির মাঝে। সৃজিত মুখোপাধ্যায় যেমন তাঁর প্রিয় শর্বরীদিকে ‘গুডবাই’ জানিয়েছেন মনখারাপ নিয়ে। শর্বরীর সঙ্গে শেষ কাজ করেছেন গৌরব চট্টোপাধ্যায় আর দেবলীনা কুমার। গৌরব ভাবতে পারচ্ছেন না, ওই শুটটাই এমন একজন শিল্পীর শেষ শুট হয়ে থেকে যাবে। বললেন, “আমি এমনিতে খুব জমকালো পোশাক পরি না। কিন্তু উনি আমার সিমপ্লিসিটি বুঝে কেমন চমৎকার সাজিয়ে দিয়েছিলেন!”
স্বভাব আর সাজ— দুই দিয়ে তিনি মন জয় করেছিলেন ইন্ডাস্ট্রির। বিশ্বের। শেষ শুট করার অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে দেবলীনা বললেন, “আমার বাবা আর কাকা শর্বরী দত্ত-ই পরেন। ওঁরা তো আর ইন্ডাস্ট্রির নন। সাধারণ মানুষ। ওঁরা যে কোনও দিন কালার্ড ধুতি পরতে পারেন, আমি ভাবিনি। শর্বরীদি আসলে কলকাতাকেই বদলে দিয়েছিলেন।”
অভিনেত্রী সুদীপ্তা চক্রবর্তী ফেসবুকে লিখেছেন, “ওঁর পোশাক পরার সৌভাগ্য হয়েছে দু’-এক বার। তবে গল্প করার, আড্ডা মারার সুযোগ হয়েছে অনেক বেশি।কী অসম্ভব হাসিখুশি, ওয়ার্ম, ওয়েলকামিং ছিলেন মানুষটা। বিবাহিত জীবন, ঘরসংসার থেকে ফ্যাশন হয়ে সিনেমা, থিয়েটার— সব কিছু নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিয়েছি বহুবার।বিশ্বাস হচ্ছে না শর্বরীদি আর নেই।” সোশ্যাল মিডিয়ায় শোক প্রকাশ করেছেন শ্রাবন্তী, রুক্মিণী, রাজ চক্রবর্তীরা। পরিচালক অরিন্দম শীল বললেন, “কলকাতার গর্ব ছিলেন শর্বরীদি। সকলের সঙ্গে হাসিখুশি মেজাজ। সব সময় কাজের ইচ্ছা।আমি আমার এক জন কাছের মানুষকে হারালাম।”
সাধারণ মানুষ থেকে মডেল, অভিনেতা— কলকাতা আজ রংহীন
রুক্মিণী টুইট করেন, ‘জানি না কী বলব। কিছু বলার মতো অবস্থায় নেই। এতটাই শক্ড। ফ্যাশনের দুনিয়ায় তুমি অমর।’
সাধারণ মানুষ থেকে মডেল, অভিনেতা— কলকাতা আজ রংহীন। কেউ মানতে পারছেন না কলকাতার ক্যানভাস বদলে দেওয়া এমন এক মহিলার আকস্মিক মৃত্যু। কারণ, মনের মধ্যে এবং বাইরে যতই ঝড় উঠুক, শর্বরীর একটাই কথা ছিল ঘুরেফিরে, “আমি বাঁচতে চাই। কাজের মধ্যে বাঁচতে চাই।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy