তিনি বলছেন, তিনি কোনও দুর্নীতিতে জড়িত নন। অভিযোগকারীরা বলছেন, তাঁরা ‘প্রতারিত’। তিনি বলছেন, তিনি একটি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে ফ্ল্যাট কিনেছিলেন। সে ঋণ সুদসমেত ফিরিয়ে দিয়েছেন। সংস্থার এক ডিরেক্টর বলছেন, ঋণ দেওয়ার কথা জেনে তিনি স্তম্ভিত! কারণ, তাঁর দাবি, তেমন কোনও ঘটনা ঘটেনি। রাজ্যের বিরোধী বিজেপি বলছে, কলকাতা পুলিশে অভিযোগ করে লাভ হয়নি। এ বার ঘটনার তদন্ত করুক কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)।
আরও পড়ুন:
তিনি— নুসরত জাহান। টালিগঞ্জের অভিনেত্রী তথা বাংলার শাসক তৃণমূলের সাংসদ। আশ্চর্য নয় যে, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ রাজনৈতিক রং পেয়ে গিয়েছে। তবে টালিগঞ্জের সঙ্গে অধুনা রাজনীতির যোগাযোগ নিবিড়। নয়-নয় করে টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রি থেকে সরাসরি তৃণমূলের জনপ্রতিনিধি রয়েছেন অন্তত ১১ জন! তাঁরা নুসরতের বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে অবহিত নন, এমন নয়। কিন্তু তাঁরা কী বলছেন ? ওই অভিযোগ নিয়ে কী বক্তব্য তাঁদের?
টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রির অন্দরে বেশির ভাগই প্রকাশ্যে এ বিষয়ে কিছু বলতে নারাজ। তবে একান্ত আলোচনায় তাঁরা খানিকটা কম সাবধানী। সেই আলোচনায় অনেকে যেমন নুসরতকে ‘বেনিফিট অফ ডাউট’ দিতে রাজি, তেমনই অনেকের মতে, গত ১০ বছরে নুসরত কোন কোন জায়গা থেকে ‘ঋণ’ নিয়েছেন, তার তালিকা তৈরি করা কঠিন। অন্য অনেক ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি মতোই টালিগঞ্জের ক্ষেত্রেও অর্থের উৎস নিয়ে অনেক সময়েই নানা রকম জল্পনার অবকাশ থেকেছে। যেমন অবকাশ থেকেছে নানা ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেন নিয়েও । তবে এ নিয়ে কেউই প্রকাশ্যে মুখ খোলেন না। যেমন অনেকেই এড়িয়ে গিয়েছেন নুসরত এবং তাঁকে ঘিরে সাম্প্রতিক বিতর্কের প্রসঙ্গও।
আরও পড়ুন:
সম্প্রতি শহরের এক ফিল্মি পার্টিতে নুসরত এবং তাঁ স্বামী যশের সঙ্গে অভিনেতা তথা তৃণমূল সাংসদ দেবকে গল্প করতে দেখা গিয়েছে। ঘটনাচক্রে, দেবকেও কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার মুখোমুখি হতে হয়েছিল এর আগে। তবে নুসরত প্রসঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও দেব ওই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। নুসরতের ‘প্রিয় বান্ধবী’ অভিনেত্রী তথা যাদবপুরের তৃণমূল সাংসদ মিমি চক্রবর্তীও সরাসরি ওই প্রসঙ্গে কোনও কথা বলতে চাননি। তাঁর টিমের তরফে জানানো হয়েছে, নুসরত প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করতে নারাজ মিমি। কারণ, ওই ঘটনার সঙ্গে তারঁ কোনওরকম ভাবেই কোনও সংশ্রব নেই।
তবে বিষয়টিকে অন্য ভাবে দেখতে চাইছেন বারাসতের তৃণমূল বিধায়ক তথা বর্ষীয়ান অভিনেতা চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তী। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘‘এটা ওর (নুসরতের) ব্যক্তিগত বিষয়। এর সঙ্গে তো দলের কোনও সম্পর্ক নেই!’’ এই ঘটনায় দল বা নুসরতের ভাবমূর্তি কি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে? চিরঞ্জিতের উত্তর, ‘‘এই ঘটনা নেগেটিভ (নেতিবাচক) দিকে না পজ়িটিভ (ইতিবাচক) দিকে বাঁক নেবে, সেটা তো ভবিষ্যতের বিষয়। তাই এখনই এ নিয়ে কিছু বলা কঠিন।’’
আরও পড়ুন:
নুসরত প্রসঙ্গে মুখ খুলেছিলেন সায়নী ঘোষও। টালিগঞ্জের অভিনেত্রী হওয়ার পাশাপাশি সায়নী যুব তৃণমূলের সভানেত্রী। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেছিলেন। বিজেপির অগ্নিমিত্রা পালের কাছে সামান্য ভোটের ব্যবধানে হেরে যান তিনি। সম্প্রতি নুসরতকে নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্ক প্রসঙ্গে প্রশ্ন করায় আনন্দবাজার অনলাইনকে সায়নী বলেছিলেন, ‘‘নিজের ব্যক্তিগত জায়গা থেকে যা বুঝেছি, মিডিয়া ট্রায়াল একটা বিশাল বড় ব্যাপার। আদালতের তরফে কিছু জানানোর আগেই মিডিয়াতে লেখা হচ্ছে। অভিযোগ প্রমাণের আগে দোষী বলা হচ্ছে। সেটা তো ঠিক নয়। আমার সঙ্গে নুসরতের কথা হয়নি। তবে এটা ঠিক, ভিউজ় বা টিআরপির জন্য অন্য কারও ক্ষতি হচ্ছে। সেটা ভাবা উচিত।’’
সায়নীর সঙ্গেই রাজ চক্রবর্তী পরিচালিত একটি ওয়েব সিরিজ়ে অভিনয় করেছেন মেদিনীপুরের বিধায়ক জুন মালিয়া। সায়নী বললেও জুন নুসরতকে নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে ইচ্ছুক নন। এই প্রসঙ্গে তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্য, ‘‘দলের মুখপাত্র আছেন। যা বলার তাঁরাই বলবেন।’’ মুখ খুলতে চাননি ব্যারাকপুরের তৃণমূল বিধায়ক তথা পরিচালক রাজও।
আরও পড়ুন:
২০২১ সালে বাঁকুড়া বিধানসভা থেকে তৃণমূলের টিকিটে লড়েছিলেন অভিনেত্রী সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। হেরে গেলেও তিনি বাঁকুড়ায় থেকেই সংগঠনের কাজ করছেন। নুসরতকে নিয়ে উদ্ভূত বিতর্ক প্রসঙ্গে সরাসরি মন্তব্য না করলেও তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক সায়ন্তিকা বলেছেন, ‘‘আমাদের দলের একাধিক নেতানেত্রীকে ইডি এবং সিবিআই বিভিন্ন ভাবে সমস্যায় ফেলার চেষ্টা করছে। আগেও এ রকম ঘটনা ঘটেছে। তবে আমরা তার জন্য প্রস্তুত।’’ বার বার এমন ঘটনা ঘটছে কেন? সায়ন্তিকার জবাব, ‘‘আসলে কেন্দ্র আমাদের প্রচুর টাকা আটকে রাখা সত্ত্বেও কাজের দিক থেকে তো আমাদের থামাতে পারছে না! তাই শেষে আইনি পথে গোটা দলকে সমস্যায় ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে।’’
উত্তর ২৪ পরগনার কামারহাটি পুরসভার তৃণমূল কাউন্সিলর শ্রীতমা ভট্টাচার্য পুর পরিষেবার পাশাপাশি অভিনয় জীবনও সামলাচ্ছেন। এখনও তাঁর অভিনীত সিরিয়াল দেখানো হচ্ছে। কিন্তু নুসরত প্রসঙ্গে তিনিও কিছুটা সাবধানী, ‘‘যে বিষয়ে আমার কোনও জ্ঞান নেই, তা নিয়ে আমি কোনও কথা বলতে চাই না। কী ঘটেছে বা না-ঘটেছে, তার কোনও কিছুই আমার কাছে পরিষ্কার নয়। তাই এ বিষয়ে আমার কোনও মন্তব্য করা ঠিক হবে না।’’ রাজারহাট-গোপালপুরের তৃণমূল বিধায়ক তথা সঙ্গীতশিল্পী অদিতি মুন্সীর বক্তব্যেও একই সুর, ‘‘আমার সঙ্গে ওঁর (নুসরত) ব্যক্তিগত আলাপ নেই। কী ঘটেছে সঠিক জানি না। আমার এলাকা রাজারহাট-গোপালপুরের বাসিন্দাদের প্রাপ্য সুযোগসুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করি। তার বাইরে কিছু জানি না। তাই মন্তব্যও করতে চাই না।’’
আরও পড়ুন:
উত্তরপাড়ার তৃণমূল বিধায়ক তথা অভিনেতা কাঞ্চন মল্লিকের ফোন বন্ধ ছিল। ক্রমাগত বেজে গেল পূর্ব মেদিনীপুরের চণ্ডীপুরের তৃণমূল বিধায়ক সোহম চক্রবর্তীর ফোনও। তবে সোনারপুর দক্ষিণের তৃণমূল বিধায়ক তথা অভিনেত্রী লাভলি মৈত্র সরাসরিই নুসরতের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘নুসরত জাহান ইতিমধ্যেই সাংবাদিক বৈঠক করে নিজের পক্ষে সব প্রমাণ দেখিয়েছেন। আমার মনে হয়, কারও বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ করার আগে তথ্যপ্রমাণ থাকা উচিত।’’ লাভলির আরও বক্তব্য, অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার আগেই কাউকে অভিযুক্ত করে দেওয়ার প্রক্রিয়াটা ঠিক নয়। কারণ, তাঁর কথায়, ‘‘এখন নুসরতকে নিয়ে কথা হচ্ছে। পরবর্তী কালে তো অন্য কারও সঙ্গেও এমনটা ঘটতে পারে!’’