‘ভবিষ্যতের ভূত’ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবার মুখ পুড়ল রাজ্য সরকারের।
শীর্ষ আদালত নির্দেশ দিল, ছবির প্রদর্শনে বাধা পড়ায় ‘ভবিষ্যতের ভূত’-এর প্রযোজকের ক্ষতিপূরণ বাবদ রাজ্য সরকারকে ২০ লক্ষ টাকা মেটাতে হবে। একই সঙ্গে দেশে বাক্স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সুপ্রিম কোর্টের মন্তব্য, ‘‘জনতার (মব) ভয়ে স্বাধীন বক্তব্য চুপ করিয়ে দেওয়া যায় না।’’ সুপ্রিম কোর্ট শুধু রাজ্য সরকারকে এক মাসের মধ্যে ২০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দিয়েই থামেনি। প্রযোজকের মামলার খরচ বাবদও ১ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ মেটাতে বলেছে।
ছবির মুক্তির পরেই ‘উপর মহলের নির্দেশে’ ছবির প্রদর্শন কার্যত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রযোজক সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। উল্টো দিকে রাজ্য সরকারের যুক্তি ছিল, রাজ্যের হাতে ছবির প্রদর্শন বন্ধ করার আইনি ক্ষমতা থাকলেও এ ক্ষেত্রে তা কার্যকর করা হয়নি। ‘ভবিষ্যতের ভূত’-এর উপরে কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়নি।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
কিন্তু আজ বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় ও বিচারপতি হেমন্ত গুপ্তর বেঞ্চ স্পষ্ট জানিয়েছে, ‘‘সরকার কোথাও নিষেধাজ্ঞা জারি করতে চাইলে তা আইন মেনেই করতে হবে। রাজ্য সরকার জানায়, আইন মেনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়নি। তা-ই যদি হবে, মুক্তির পরেই এক সঙ্গে সব জায়গায় ছবির প্রদর্শন বন্ধের ব্যাখ্যা থাকা দরকার। পুলিশের চিঠি থেকে স্পষ্ট, প্রযোজকদের সংশয় অমূলক নয়। বিশেষত আইনক্সের তরফে প্রযোজকদের জানানো হয়, কর্তৃপক্ষের থেকে নির্দেশ রয়েছে, দর্শকদের স্বার্থে ছবির প্রদর্শন বন্ধ করতে হবে। আমরা নিঃসন্দেহ, এটা সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার। রাজ্য পুলিশ এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে কাজ করেছে।’’
বিচারপতিদের মতে, এই ঘটনায় ছবির প্রযোজক, অভিনেতা ও দর্শকদের সাংবিধানিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করার ‘অসাংবিধানিক প্রচেষ্টা’ হয়েছে। তার থেকেও খারাপ হল, এই নজির তৈরি করে সমালোচক ও সমালোচনা বন্ধ করারও চেষ্টা হয়েছে। যাতে অন্য কেউ এই পথে এগোলে একই ধরনের ফল হবে ভেবে আতঙ্ক তৈরি হয়। শীর্ষ আদালতের রায়, ‘‘মুক্ত সমাজে একে প্রশ্রয় দেওয়া চলে না। ক্ষমতার সামনে স্বাধীনতা হাতজোড় করে দাঁড়াতে পারে না।’’
আজকের রায়ে খুশি ছবির প্রযোজক কল্যাণময় চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘দেশের আইন-আদালতের উপর আস্থা আরও বেড়ে গেল। এই রায় বাকস্বাধীনতার অধিকারের প্রশ্নে, শিল্পী-সাহিত্যিক-কবি-পরিচালকদের জন্য মাইলফলক হয়ে থাকল। সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট বলেছে, অন্য ছবির নির্মাতারাও নিশ্চিন্ত মনে কাজ করতে পারবেন। দর্শকরাও নিশ্চিন্তে ছবি দেখতে পারবেন।’’
‘ভবিষ্যতের ভূত’ মুক্তির আগে কলকাতা পুলিশ প্রযোজকদের কাছে ছবিটি দেখতে চেয়েছিল। যুক্তি ছিল, এই ছবি মুক্তি পেলে আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা হতে পারে বলে খবর রয়েছে। বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চ একে ‘গোপন চক্রান্ত’ আখ্যা দিয়ে বলেছে, ‘‘পুলিশ সামাজিক নৈতিকতার স্বঘোষিত অভিভাবক হয়ে উঠতে পারে না। তারা কোনও ভাবেই ভিন্ন মত ও বাকস্বাধীনতাকে ধামাচাপা দিতে পারে না।’’
আজকের রায়ে ‘পদ্মাবত’ বা ‘আরক্ষণ’-এর মতো সিনেমা নিয়ে বিতর্ক, মকবুল ফিদা হুসেনের ছবি নিয়ে বিতর্ক থেকে নাথুরাম গডসে নিয়ে বিতর্কের প্রসঙ্গ ঘুরেফিরে এসেছে। বিচারপতি চন্দ্রচূড় এ ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকার কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘‘শুধু পুলিশ কেন, জনমতও ঠিক করে দিতে পারে না, শিল্পী কী ভাবে নিজেকে প্রকাশ করবেন, কী ভাবে করবেন না। শিল্প যেমন মূলস্রোতের জন্য, তেমন প্রান্তিকদের জন্যও। শিল্প-সাহিত্য অসহিষ্ণুতার শিকার হয়ে পড়বে, যদি সরকার নিরাপত্তার বন্দোবস্ত না করে।’’ আদালতের মতে, ‘ভবিষ্যতের ভূত’-এর ক্ষেত্রে ঘটেছে ঠিক উল্টোটাই। ‘‘পুলিশ এ ক্ষেত্রে মুখ বন্ধ করার, চালু সংস্কৃতির সমালোচনা বন্ধ করার এবং নাগরিকদের মাথা নুইয়ে ফেলতে হুঁশিয়ারি দেওয়ার হাতিয়ার হয়ে গিয়েছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy