অনুষ্ঠানে ইমন। নিজস্ব চিত্র।
ইমন ফেসবুক লাইভে অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে ঘটা অপ্রীতিকর পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন— ‘আমরা কেউ বাইজি নই, এখানে নাচতে আসিনি’। তা নিয়ে সমালোচনার মুখেও পড়েছেন সামাজিক মাধ্যমে। মঙ্গলবার সকালে ইমন ফের ফেসবুক লাইভে এর জন্য দুঃখপ্রকাশ করেন। এবং জানান, তাঁর উদ্দেশ্য কোনও সম্প্রদায় বা পেশাকে আঘাত করা ছিল না। সন্ধ্যায় আনন্দবাজারকে তিনি বলেন, ‘‘কারও খারাপ লেগে থাকলে দুঃখিত। ‘বাইজি’ শব্দের মধ্যে দিয়ে নৃত্যশিল্পীদের অপমান করেছি, এটা ভাবা বোকামি। বলতে চেয়েছি, এক সময়ে জমিদারবাড়িতে যাঁদের টাকা দিয়ে ডেকে এনে বাবুদের মনোরঞ্জন করানোর চল ছিল, তাঁদের কথা।’’
ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৪১ ধারা
অপরাধ: কাউকে অন্যায় ভাবে অবরুদ্ধ করা
শাস্তি: এক মাস জেল বা ৫০০ টাকা জরিমানা বা দুই-ই জামিনযোগ্য অপরাধ
*এই ধারাতেই কৃষ্ণনগর সাংস্কৃতিক মঞ্চের সম্পাদক অনন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছেন সঙ্গীতশিল্পী ইমন চক্রবর্তী
গোটা বিতর্কে মতামত প্রকাশ করেছেন অনেকেই। কেউ পক্ষে, কেউ বা বিপক্ষে। দেখে নেওয়া যাক সেই মতামতগুলি।
পক্ষে
• গান এখন সংখ্যা দিয়ে মাপতে হচ্ছে
সৈকত কুণ্ডু, গীতিকার
যে প্রসঙ্গে কথাগুলো লিখতে হচ্ছে, সেই প্রসঙ্গটা নিজেই বড় অসুন্দর, অসাঙ্গীতিক।
ইমন চক্রবর্তী অসম্মানিত হয়েছেন, সহ-শিল্পীরা নিগৃহীত হয়েছেন, ইমন চক্রবর্তী অনেক টাকা পারিশ্রমিক নিয়েছেন, বিনিময়ে তিনি যথেষ্ট গান শোনাননি— এই সব কথা এহ বাহ্য; বরং মূল সমস্যা হল বাইরের বেসুর এখন আমাদের ভিতরের সুর কেড়ে নিয়েছে, ভিতরের সুন্দর বাইরের কুৎসিতের কাছে পরাজিত। এই কারণেই গান এখন সংখ্যা দিয়ে মাপতে হচ্ছে। সৌজন্যই যে স্বাভাবিক সংস্কৃতি— তা আর মনে থাকছে না।
এর সঙ্গে রাজনীতির সহজ সমীকরণ খোঁজায় আমি নেই। কিন্তু বলব, ইমন যতটা দুঃখিত, আমরা তার চেয়ে অনেক বেশি লজ্জিত। এটা কৃষ্ণনগরের সংস্কৃতি নয়।
• গানের শ্রোতা এবং ক্রেতার ফারাক থাকুক
আকাশ দত্ত, বাচিকশিল্পী
যা ঘটেছে, তা লজ্জার। অনুষ্ঠানটির আয়োজক অনেক শিল্পী ও গুণী মানুষের নিয়ে গঠিত একটি সংগঠন।
সারা বছর কৃষ্ণনগরে বহু দিকপাল বহু সংগঠনের আমন্ত্রণে অনুষ্ঠান করতে আসেন। কিন্তু এই ঘটনা অপ্রত্যাশিত। তা একটি বৃহত্তর প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসে। আরও আরও দীর্ঘক্ষণ অনুষ্ঠান চালাতে হবে, শিল্পীর শারীরিক অবস্থা, ইচ্ছা এবং পরিবেশ-পরিস্থিতি বিচার না করে এই যে দাবি, এই প্রবণতা আসলে কি বল্গাহীন ভোগবাদিতার বেআব্রু প্রকাশ নয়?
আসলে সম্মান করার ইচ্ছেটাই ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে আমাদের। শিল্পী যে পণ্য নন, বরং সাধক তা তাঁর আচরণ, কথন, ব্যবহারে ফুটে ওঠা দরকার। শ্রোতা ও ক্রেতার মধ্যে আচরণের সূক্ষ্ম পার্থক্যের কথাও আমরা জানি। সেই বিভাজিকা মুছে গেলে সকল স্তরে প্রভাব পড়তে বাধ্য।
• অপমানের অশুভ প্রবণতা
শান্তিরঞ্জন দেব, নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পর্ষদের কর্মকর্তা
শিল্পীদের ডেকে এনে গানের আসর বসানো, এটা বাংলার সুপ্রাচীন ঐতিহ্য। আগে রাজা, জমিদার, ধনাঢ্য ব্যক্তিরা বাড়িতে এই ধরনের গানের আসর বসাতেন। বৈষ্ণব মঠ, মন্দির, আখড়ায় বসত কীর্তনের আসর। পরে আধুনিক সময়ে কোনও ব্যক্তিবিশেষ বা কোনও সংগঠন বড় জায়গায় সঙ্গীতশিল্পী, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের আহ্বান করে এনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতেন বা চ্যারিটি শো করতেন। এতে শ্রোতারা পরিতৃপ্ত হতেন, শিল্পীরাও পয়সা পেতেন। আয়োজকেরা উদ্বৃত্ত অর্থে সমাজের কল্যাণকর কোনও কাজ করতেন।
কিন্তু সম্প্রতি বিভিন্ন জায়গায় শিল্পীদের অপমানিত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে, যা কোনও মতেই কাম্য নয়। সোমবার কৃষ্ণনগরে সঙ্গীতশিল্পী ইমন চক্রবর্তীকে হেনস্থা করার খবরে এলাকার সংস্কৃতিপ্রাণ মানুষ জন ভীষণ ভাবেই উদ্বিগ্ন। দোষ যারই হোক, শিল্পীকে আটকানো বা অপমান করার মতো এই অশুভ প্রবণতা অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত। এর জন্য সংস্কৃতিমনস্ক, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদে এগিয়ে আসা উচিত।
বিপক্ষে
• শ্রোতাদের প্রতিও দায় থাকে
তন্ময় বিশ্বাস, বাচিক শিল্পী
বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করলেও ইমনের অনুষ্ঠানে আমি শ্রোতার আসনেই ছিলাম। নামি শিল্পীদের প্রতি শ্রোতার আবদার একটু বেশি মাত্রায় থাকে। মঞ্চে উঠে নিজের পরিবারের লোকজনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে, বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র শিল্পীদের দিয়ে বিভিন্ন মিউজিকের কম্পোজিশন শুনিয়ে ইমন সময় নষ্ট করেন। তার পর হঠাৎই ‘এটাই আমার শেষ গান’ বলে গানটি গেয়ে মঞ্চ থেকে নেমে যান।
প্রচুর শ্রোতা তাঁকে আরও গান গাইতে অনুরোধ করেন। উদ্যোক্তাদের এক জন আর দুটো গানের অনুরোধ জানালে তাঁকে সরিয়ে চলে যান ইমন। মঞ্চ থেকে মাত্র পনেরো ফুট দূরত্বে থাকা গাড়িতে উঠে ফেসবুক লাইভ দিতে থাকেন। শ্রোতাদের মধ্যে অসন্তোষ থাকলেও কেউ তাঁকে ধাক্কাধাক্কি বা গালিগালাজ করেননি। বরং তিনি নিজস্বী তুলতে-তুলতে নির্বিঘ্নে ফেসবুক লাইভ করেছেন।
শিল্পীর পরিবেশনা ও শ্রোতাদের চাহিদার সামঞ্জস্য থাকলে তবেই অনুষ্ঠান সর্বাঙ্গসুন্দর হয়। তবু উদ্যোক্তারা আশা করেন, শিল্পী নির্ধারিত সময়ের উপযোগী করে গান পরিবেশন করবেন। কারণ, তাঁরাও সদস্যদের কাছে দায়বদ্ধ। যাঁদের তাঁরা টিকিট বিক্রি করেছেন, সেই শ্রোতার কাছেও। ইমন তা মাথায় রাখেননি।
• ইমন আরও একটু ধৈর্যশীল হতে পারতেন
সুশান্তকুমার হালদার, নাট্যকর্মী
ইমন চক্রবর্তীর গাড়ি আটকানো কোনও ভাবেই সমর্থন করছি না। কিন্তু গোটা বিষয়টাকে আরও একটু খোলা চোখে দেখলে হত না? আমরা অনেকেই দীর্ঘ দিন ধরে মঞ্চে উঠছি। প্রথম কাজ হল, দর্শকদের আনন্দ দেওয়া। এটাই এক জন শিল্পীর দায়বদ্ধতা। আমি বাবার মৃত্যুর পরেও কাছা পরে নাটক করতে গিয়েছি। কৃষ্ণনগরের মানুষ ইমনের কাছে কী চেয়েছিল? দুটো গান শুনতে চেয়েছিল, এই তো! তাঁর পক্ষে সেই অনুরোধ রক্ষা করা সম্ভব না-ও হতে পারে। কিন্তু সেটা তিনি অন্য ভাবে সামলাতে পারতেন। একটু ধৈর্যশীল হতে পারতেন। সে ক্ষেত্রে পরিস্থিতি এই পর্যায়ে হয়তো পৌঁছত না। এক জন শিল্পীর তো স্বপ্ন হওয়া উচিত, শ্রোতারা তাঁর গান আরও বেশি বেশি করে শুনতে চাইবেন। সেখানেই তাঁর সার্থকতা।
• শিল্পী নিজেকে অপরিহার্য না যেন ভাবেন
তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়, সাহিত্যিক
আমি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম না। যাঁরা ছিলেন, তাঁদের কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, শিল্পীর ‘ফ্রিডম অফ মুভমেন্টে’ বাধা দিয়ে তাঁর প্রতি যে অন্যায় হয়েছে, নিশ্চিত। কিন্তু মুদ্রার উল্টো পিঠের দৃষ্টিভঙ্গিও উড়িয়ে দিতে পারি না।
শিল্পী ও শ্রোতাদের সহাবস্থানেই সম্পূর্ণ বৃত্ত রচনা হয়। শিল্পী যদি শ্রোতাদের আবদার-অনুরোধ অগ্রাহ্য করে নিজের মর্জিকেই চূড়ান্ত গণ্য করেন, জনসাধারণকে ‘টেকেন ফর গ্রান্টেড’ মনে করার ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেন, তা হলে তাঁর সাঙ্গীতিক প্রয়াস ‘ব্যর্থ’ বলা ছাড়া উপায় থাকে না। গায়কের তো শুধু পেশা নয়। গানের মধ্যে দিয়ে শিল্পী ও শ্রোতাদের মধ্যে নান্দনিক সেতু রচিত হয়। কিন্তু তাতে যদি শিল্পী নিজেকে একমেবাদ্বিতীয়ম্ ও অপরিহার্য ভেবে বসেন, তা হলে সেই সেতু পড়ে ভেঙে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy