‘সুড়ঙ্গ’ ছবির একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত।
ছবিটি নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। বাংলাদেশের শিল্পী মহল থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের রাতের খাওয়ার টেবিলে, চায়ের দোকানে বা রাস্তার পাশের মাচায় এই ছবিটি নিয়ে তর্কের তুফান উঠেছে। মুক্তির আগে ছবির চরিত্রায়ন বা গান-সুর নিয়ে ওঠা বিতর্ক ছাড়াও, মুক্তির পর ছবির চোরাই সংস্করণ নিয়েও প্রবল বিতর্ক তৈরি হয়। বাংলাদেশের প্রায় ২৯টি সিনেমাহল এবং সব ক’টি মাল্টিপ্লেক্সে মুক্তি পাওয়ার পরেই এই ছবির চোরাই সংস্করণ দ্রুত বাজারে ছড়িয়ে পড়ে। প্রযোজক এবং প্রশাসনের উদ্যোগে সেই কারবার বন্ধ করা গেলেও সমাজমাধ্যমে ছবিটির বিভিন্ন দৃশ্যের ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়া পুরোপুরি আটকানো যায়নি। তবু ছবিটি জনপ্রিয়তার শিখরে ওঠে। বাংলাদেশের তথাকথিত বাণিজ্যিক ছবির ধারাকে বদলে দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে তৈরি, রায়হান রাফি পরিচালিত ‘সুড়ঙ্গ’ প্রথম দুই সপ্তাহে গড় বাংলাদেশি ছবির প্রায় তিন গুণ ব্যবসা দেয়।
একেবারেই অন্য রকম একটা গল্প নিয়ে তৈরি হয় এই ছবি। মূলধারার ছবিতে নির্দিষ্ট ফর্মুলাভিত্তিক যে ধরনের কাহিনি লক্ষ করা যায়, ‘সুড়ঙ্গ’ সেই ধরনের বাণিজ্যিক ছবি নয়। শোনা যায়, পড়শি দেশে ঘটে যাওয়া এক সত্য ঘটনা অবলম্বনে এই ছবি তৈরি হয়েছে। ছবির নায়ক মাসুদ (আফরান নিশো) এক জন ইলেকট্রিক মিস্ত্রি। মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে ময়নার (তমা মির্জা) সঙ্গে মাসুদের প্রেম দিয়েই ছবি শুরু হয়। মাসুদ ময়নাকে পাগলের মতো ভালবেসে ফেলে। ময়না মাসুদকে ভালবাসলেও সে টাকার প্রেমে পাগল। দামি জিনিসপত্র, গয়নাগাটির প্রতি ময়নার আকর্ষণ তীব্র। বিয়ের পর মাসুদ সাধ্যমতো চেষ্টা করে ময়নার আবদার মেটাতে। কিন্তু তা যথেষ্ট ছিল না। একসময় এই দু’জনের মধ্যে আসে মাসুদের বন্ধু জহির (মোস্তফা মনওয়ার)। ময়নাকে সে পছন্দ করে। গয়না, টাকা দিয়ে সে ময়নার মন জয় করার চেষ্টা করে। ময়নার সাধ মেটানোর জন্য ময়নারই পরামর্শে অতিরিক্ত রোজগারের আশায় মাসুদ মালয়েশিয়া পাড়ি দেয়। সেই সুযোগে জহির ময়নাকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে।
এই পর্যন্ত ছবির কাহিনির মধ্যে তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য বিষয় নেই। খুবই সাধারণ মানের বহুলচর্চিত এই গল্প নিয়ে, হাজার হাজার ছবি তৈরি হয়েছে। এই পর্যায়ের চিত্রনাট্যও বেশ দুর্বল লাগে। ময়না ও মাসুদের সম্পর্ক গড়ে ওঠার কোনও যুক্তিযুক্ত কারণ নেই। দু’টি চরিত্রের ভাবধারার সঙ্গে দর্শক পরিচিত হতেই পারেননি। ময়নার মতো লোভী চরিত্র অত সহজে কেন মাসুদের মতো একেবারে সাধারণ একটি ছেলের প্রেমে পড়বে এবং বিয়ে করবে, সেই প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তরও চিত্রনাট্যে নেই। মূলধারার কথা মাথায় রেখে ছবি বানালেই তার আবহ উচ্চ দাগের হতে হবে এই ধারণা ভেঙে ফেলার সময় বোধহয় এসেছে। পরিচালক আরও একটু সাহসী হলে, এই বিভাগের প্রতি অবশ্যই সুবিচার করতে পারতেন, আবহও অনেকটাই বাস্তবসম্মত হতে পারত।
প্রথম পর্যায়ের এই অতি সাধারণ মানের গল্প বলতে গিয়ে এক ঘণ্টা সময় পার হয়ে যায়। আধুনিক ছবির গতিপ্রকৃতিতে এই সময়টা বেশ মূল্যবান। এই সময় চিত্রনাট্যের অপরিকল্পিত গতি ছবিকে শ্লথ করে দেয়, ফলে গল্প একই জায়গায় ঘোরাফেরা করে সময় নষ্ট করে। এর পর ছবির কাহিনি এক ঝটকায় একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে যায়। শুরু হওয়ার এক ঘণ্টা পর থেকেই ছবিটি একটি নির্দিষ্ট ছন্দ, লয় ধরে এগোতে থাকে। বিদেশ থেকে ফিরে এসে বাড়িঘর এবং তার প্রাণের থেকে প্রিয় ময়নাকে হারিয়ে, ঋণে জর্জরিত মাসুদ জীবনের ভারসাম্যটাই হারিয়ে ফেলে। সে পাগলের মতো ময়নাকে খুঁজতে থাকে। একসময় ময়নার দেখা পেলেও, ময়না তাকে স্বীকার করে না। ময়না মনে করে অনেক টাকা রোজগার করে বড়লোক হওয়ার মতো ক্ষমতা মাসুদের নেই। মাসুদ ফিরে যায়। যে কোনও উপায়ে বড়লোক হওয়ার সহজ পথ খুঁজতে খুঁজতে মাসুদ এক ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা করে ফেলে। একটি ব্যাঙ্কের কাছে ঘরভাড়া নিয়ে প্রায় চারশো সাতাশি ফুট সুড়ঙ্গ খুঁড়ে সে ব্যাঙ্কের ভল্টে পৌঁছে যায়। সেখানে কোটি কোটি টাকার মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলে সে, কিন্তু এই টাকা কি মাসুদ নিতে পারে? এই টাকা নিয়ে মাসুদ কি ময়নাকে ফিরে পায়? সুড়ঙ্গ খোঁড়ার মুহূর্ত থেকে ছবিটির শেষ দৃশ্য পর্যন্ত, দর্শকদের কাছে অজস্র প্রশ্ন তৈরি করতে করতে ছবিটি এগিয়ে চলে। যে প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তরের জন্য দর্শক তার নির্দিষ্ট আসনে বসে থাকতে বাধ্য হন। এখানেই একটি ছবির সাফল্য। ‘সুড়ঙ্গ’ ছবিটির সমস্ত কলাকুশলী অবশ্যই এই সাফল্যের ভাগ দাবি করতে পারেন। ছবিতে মাসুদের ভূমিকায় আফরান নিশো এবং জহিরের ভূমিকায় মোস্তফা মনওয়ারের অভিনয় মনে রাখার মতো। কখনও মনে হয়নি বড় পর্দায় আফরান নিশোর এটিই প্রথম কাজ। ময়নার চরিত্রে তমা মির্জা ভাল অভিনয় করেছেন তবে তাঁর অভিনয়ে নায়িকাসুলভ আচরণই বেশি চোখে পড়েছে, ফলে গল্পের ময়না চরিত্রটিকে সম্পূর্ণ রূপে পর্দায় পাওয়া যায়নি। নায়িকার আভরণ ছেড়ে, তিনি যদি গ্রাম্য মেয়ে ময়নার চরিত্রে আরও একটু সাবলীল হতে পারতেন, তা হলে ময়না চরিত্রটি বোধহয় আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে পারত। ঘরের মধ্যের দৃশ্যে ময়নার চড়া মেকআপ সেই অস্বাভাবিক বিষয়কেই যেন উস্কে দেয়। প্রধান তদন্ত অফিসার আপেল খানের চরিত্রটিকে শহীদুজ্জামান সেলিম একটি নতুন আঙ্গিক দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, যা দেখতে ভাল লাগে।
ছবির বেশ কিছু দৃশ্য, যেমন শোয়ার ঘরে ময়না ও মাসুদের প্রেম, বিদেশ থেকে ফিরে মাসুদের কল্পনায় ঘরের মধ্যে জহির ও ময়নার প্রেম, বাজারে মাসুদের মার খাওয়া, মাসুদের সুড়ঙ্গ খোঁড়া, ভল্টে টাকার মধ্যে মাসুদের চিৎকার ইত্যাদি মনে রাখার মতো। ছবির গান বেশ ভাল। গানের দৃশ্যায়ন এবং সুড়ঙ্গের ভিতরের বিভিন্ন দৃশ্যে সিনেমাটোগ্রাফার সুমন সরকারের দক্ষতা নজর কাড়ে। এই মুহূর্তে ছবিটি ‘চরকি’ ওটিটি প্ল্যাটফর্মে দেখা যাচ্ছে।
একেবারেই অন্য রকম একটা গল্প বলার চেষ্টা, উন্নত সিনেমাটোগ্রাফি এবং মনে রাখার মতো অভিনয় ‘সুড়ঙ্গ’ ছবিটিকে জনপ্রিয় করেছে ঠিকই, কিন্তু সব জনপ্রিয় ছবি কি চিরন্তন ছবিদের দলে জায়গা করে নিতে পারে? প্রশ্নটি কিন্তু থেকেই যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy