Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪
Entertainment News

মুভি রিভিউ: ছবিটা ব্ল্যাক কমেডি আর দর্শকদের জীবনে গভীর ট্র্যাজেডি

মৈনাক ভৌমিকের একটা ক্ষুদ্র জগৎ আছে। তার ছবিগুলি মূলত শহুরে আপার মিডল ক্লাস ও আপার ক্লাস মানুষের জীবনযাপনের মধ্যেই বিচরণ করে। এটাই ওঁর কমফোর্ট জোন।

ছবির একটি দৃশ্যে পায়েল।

ছবির একটি দৃশ্যে পায়েল।

মেঘদূত রুদ্র
শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ১৮:৪৫
Share: Save:

সিনেমা: চলচ্চিত্র সার্কাস

পরিচালনা: মৈনাক ভৌমিক

অভিনয়: ঋত্বিক চক্রবর্তী, নীল মুখোপাধ্যায়, অরিন্দম শীল, রুদ্রনীল ঘোষ, পাওলি দাম, গার্গী রায়চৌধুরি, পায়েল সরকার, তনুশ্রী চক্রবর্তী, কনীনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুদীপ্তা চক্রবর্তী

সিনেমার ধারা নিয়ে কথা বলতে গেলে অনেকে অনেক ধারার কথা বলে থাকেন। বাণিজ্যিক সিনেমা, আর্ট সিনেমা, মেইন স্ট্রিম সিনেমা, প্যারালাল সিনেমা, আন্ডারগ্রাউন্ড সিনেমা ইত্যাদি। তবে আমি এত দিন মনে করতাম ছবি মূলত দুই প্রকার হয়। ভাল সিনেমা আর খারাপ সিনেমা। কিন্তু চলচ্চিত্র সার্কাস দেখার পর আমার এই ধারনাটা সম্পূর্ণ ভেঙে গেল। এখন থেকে আমার মতে ছবি মূলত তিন প্রকার। ভাল সিনেমা, খারাপ সিনেমা আর মৈনাক ভৌমিকের সিনেমা। যেটা কিনা ভাল-খারাপের ঊর্ধে। এটাকে সিনেমা বলা যায় কিনা, তাই নিয়েও অবশ্য প্রশ্ন উঠতে পারে। অনেক কথা বলা যেতে পারে। কিন্তু সেগুলো বলে অহেতুক পুজোর মরসুমে আমার আর পাঠকদের সময় নষ্ট করতে চাইছি না। সময়ের দাম আছে। খুব সহজে অল্প কথায় বলতে গেলে বলতে হয় এই ছবিটি মিরাক্কেল নামক টেলিভিশন প্রোগ্রামের একটা এক্সটেনশন। যার সঙ্গে পৃথিবীর বিভিন্ন বিষয়ের সম্পর্ক থাকতে পারে কিন্তু দূর দূরান্ত অবধি সিনেমার কোনও সম্পর্ক নেই।

আরও পড়ুন, মুভি রিভিউ: আদিত্যকে দেখতেই ছবিটা দেখা উচিত

মৈনাক ভৌমিকের একটা ক্ষুদ্র জগৎ আছে। তার ছবিগুলি মূলত শহুরে আপার মিডল ক্লাস ও আপার ক্লাস মানুষের জীবনযাপনের মধ্যেই বিচরণ করে। এটাই ওঁর কমফোর্ট জোন। আর এরাই ওঁর ছবির টার্গেট অডিয়েন্স। এর বাইরে সচরাচর তিনি বেরোন না। অনেকেই এ রকম ভাবে ছবি বানিয়ে থাকেন। এই বেরনো আর না বেরনোর অবশ্য দুটো দিক আছে। কিছুটা ভাল দিক আর অনেকটা খারাপ দিক। আগে ভালটাই বলে ফেলি। নিজের চেনা জানা জগৎ নিয়ে ছবি করলে ছবি অনেকটাই রিয়ালিস্টিক হয় (যদিও এই ছবিতে এরকম কিছুই হয়নি। তবে নর্মালি হয়ে থাকে আরকি)। কোনও দিনও শহরের বাইরের জীবনকে গভীর ভাবে অবজার্ভ না করে কিম্বা খুব বেশি হলে শান্তিনিকেতনে উইক অ্যান্ড কাটিয়ে এসে মেকি গ্রামের ছবি বানানো, সুখে-শান্তিতে জীবন কাটিয়ে পাহাড়-জঙ্গল-আকাশ নিয়ে অ্যাডভেঞ্চারের ছবি বানানো, জীবনের অধিকাংশ সময় হেসে-খেলে, পার্টি করে কাটিয়ে থ্রিলার ছবি বানানোর চেয়ে শহুরে ছবি বানানো একটু বেটার অপশন। কিন্তু খারাপ দিকটা হল একঘেয়েমি। একের পর এক ছবিতে কম-বেশি একই জিনিস দেখেতে দেখতে গভীর ক্লান্তি আসে। দর্শকের আসে। আর আমার মনে হয় পরিচালকেরও আসে। কিন্তু তার কিছু করার নেই হয়তো। কমফোর্ট জোন থেকে বেরতে তো একটু কলজে অর্থাৎ সাহস লাগে। কষ্ট করতে হয়। পায়ে হেঁটে, ট্রামে, বাসে করে চলতে হয়। অনেক অভাব এবং না পাওয়ার সঙ্গে ঘর করতে হয়। শরীর ও মনকে ক্ষয় করতে হয়। ফেসবুকের দেয়াল আর চার দেওয়ালের বাইরে বেরিয়ে বিভিন্ন ধরনের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হয়। শুধুমাত্র সিসিডি আর বারিস্তায় বসে ব্ল্যাক কফি খেয়ে আর গুরুগম্ভীর আলোচনা করে জীবনে জানা যায় না। আর ছবিও হয় না। কারণ শিল্পের দাবিই হল নতুন নতুন বিষয়কে অন্বেষণ করা, আবিষ্কার করা। আর তার পর দর্শক, পাঠক, শ্রোতার সামনে তুলে ধরা। অবশ্য শিল্প-টিল্পকে গুলি মেরে শুধুমাত্র ব্যবসার কথা ভেবে চললে অবশ্য আলাদা কথা। প্রযোজক, পরিচালকরা যদি সমালোচককে পাল্টা বলে বসে যে- পাবলিক খাচ্ছে তাই আমরাও দিচ্ছি। অত কথা বলার কি আছে। আর ছবিটা বানাতে যে টাকাটা লাগছে সেটা কে ফেরৎ দেবে? তোমার দাদু দেবে। তা হলে সত্যিই আর কিছু বলার থাকে না। কিন্তু চটকদার একঘেয়ে ছবি বানিয়ে টাকা আদৌ ফেরত আসছে কিনা সেটাও একটা লাখ টাকার প্রশ্ন। আর যদি আসেও তা হলেও বলতে হয় যে ছবি বানানোটা বাড়ি-গাড়ির ইএমআই জোগানোর মাধ্যম নয়, ছবি বানানো একটা সাধনা, একটা যাপন, একটা মুক্তির পথ। যাই হোক আপাতত সে সব বাদ দিয়ে আমরা এই ছবির প্রসঙ্গে আসি।

ছবির একটি দৃশ্যে পাওলি ও রুদ্রনীল।

এই ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র সূর্য (ঋত্বিক চক্রবর্তী) এক জন অডিও-ভিজুয়াল মাধ্যমের পরিচালক। তিনি আনারস নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি বানিয়ে কোনও একটা অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন এবং বর্তমানে টেলিভিশনে একটি নন ফিকশন প্রোগ্রাম বানান। তিনি ফিচার ফিল্ম বানানোর স্বপ্ন দেখেন এবং ছবির শুরুতেই একজন প্রডিউসার পেয়ে যান। সূর্য বানাতে চাইছিলেন একটি সিরিয়াস ছবি কিন্তু প্রডিউসারের চক্করে পরে একটি বাজার চলতি ছবি বানাতে বাধ্য হন। তার এই ছবি বানানোর বিভিন্ন ঘটনাকে নিয়েই অত্যন্ত বিরক্তিকর এবং ক্লিসে ভাবে চলচ্চিত্র সার্কাসের গল্প চলতে থাকে। ছবি বানানোর ঘটনা নিয়ে ছবি এর আগে অনেক হয়েছে। ত্রুফোর ‘ডে ফর নাইট’, কিয়ারোস্তামির ‘থ্রু দ্যা অলিভ ট্রিজ’, মৃণাল সেনের ‘আকালের সন্ধানে’, মাখমালবাফের ‘সেলাম সিনেমা’ ইত্যাদি। কিন্তু সেগুলো সিরিয়াস ভাল ছবি ছিল আর এটা মৈনাক ভৌমিকের ছবি। কাজেই এগুলোর প্রসঙ্গ টেনে এই ক্লাসিক ছবিগুলির পরিচালকদের মৃত আত্মা আর জীবিত মনকে আর কষ্ট দিয়ে চাই না। মৈনাক এই ছবিটা বানাতে চেয়েছিলেন ছবি তৈরি করতে গিয়ে যে সব ঘটনা ঘটতে থাকে তার একটা স্যাটায়ার। ব্ল্যাক কমেডি গোছের কিছু একটা। কিন্তু দর্শকদের জন্য এই ছবি দেখাটা যে একটা গভীর ট্রাজেডি হয়ে উঠবে সেটা তিনি বুঝতে পারেননি। পারলে নিশ্চয়ই কষ্ট করে এই ছবিটা বানাতেন না। অবশ্য কষ্ট করে বানিয়েছেন কিনা সেটাও একটা প্রশ্ন।

আরও পড়ুন, মুভি রিভিউ: ঘুরে দাঁড়ানোর উড়ান ধরলেন দেব

ছবিতে অনেক অভিনেতা আছেন। তাদের মধ্যে অনেকে ভাল অভিনেতা। কিন্তু ছবিতে কারোরই কিছু করার নেই। নেহাত ঋত্বিক চক্রবর্তী, সুদীপ্তা চক্রবর্তী এরা খারাপ অভিনয়টা করতে পারেননা তাই তারা এই হুরুমতালের মধ্যে নিজদের মত করে কিছু একটা করার চেষ্টা করেছেন। বাকিরা অসহায়। ছবির ক্যামেরা, এডিট, সাউন্ড ইত্যাদি টেকনিকাল দিকগুলো নিয়ে যত কম কথা বলা যায় ততই ভাল। আসলে মৈনাক যে সব ছবির মেকিং প্রসেসকে নিয়ে খিল্লি করতে চেয়েছিলেন নিজে সেই ছবিগুলোর থেকেও খারাপ ছবি বানিয়ে ফেলেছেন। সব কিছুই খারাপ আর ছবির সব থেকে খারাপ দিক হল ছবির সংলাপ। লেখক সৌরভ পালোধির উত্থান হয়েছিল মিরাক্কেল থেকেই। ওখানে তিনি হিট ছিলেন। কিন্তু এটা তো সিনেমা। ছ্যাবলামো তো নয়। মিরাক্কলের সঙ্গে এর পার্থক্যটা তো বুঝতে হবে। সে সব বাদ দিন। শেষে দর্শকদের উদ্দেশ্যে এটাই বলার ছিল তা হল যদি কেউ পুজোতে এই ছবিটি দেখবেন বলে স্থির করে থাকেন তাহলে তারা সেই টাকাটা দিয়ে বিরিয়ানি খান, চাইনিজ খান, মোগলাই পরোটা খান, নিদেন পক্ষে চিকেন রোল খান, তৃপ্তি পাবেন। ছবিটা দেখে নিজের কষ্টার্জিত অর্থের অপচয় করবেন না।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE