কর্মজীবী নারীর লাঞ্ছনার কাহিনি
প্রথম দৃশ্য— কবি সদ্যলেখা কবিতা পড়ে শোনাচ্ছেন এক তরুণীকে। উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে তরুণী তাঁকে জানায় কলেজ-জীবনে তাদের প্রেমের চিঠিতে উদ্ধৃত হত কবির কবিতা।
দ্বিতীয় দৃশ্য— মেয়েটিকে শারীরিকভাবে পাওয়ার জন্য কবি জোর করছেন। মেয়েটির চোখে ভয়মেশানো ঘৃণা।
তৃতীয় দৃশ্য— কবি তথা সংস্কৃতি কেন্দ্রের চেয়ারম্যানের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মেয়েটি অফিসে কোনও বিচার না পেয়ে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে ন্যায় বিচার চাইছে। তাকে ক্লান্ত ও একা লাগছে।
চতুর্থ দৃশ্য— রহস্যময় ভাবে খুন হয়ে পড়ে আছেন কবি।
পঞ্চম দৃশ্য— ক্রমশ স্মৃতিহীন, অসুস্থ বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটি বলতে চায়--- কখনও কখনও স্মৃতি হারিয়ে ফেলাই ভাল।
কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়। দৃশ্যের পরতে পরতে থাকে জীবনের নানা সরল, জটিল রং। যা আমাদের রাগ দেয়। কান্না দেয়। রহস্যে জড়ায়। এক কাহিনিসূত্র গড়ায় অন্য কাহিনিসূত্রের দিকে। গল্প কখনওই শেষ হয় না। এমনই অনুভূতি হয় বাংলাদেশের চলচ্চিত্র পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন’ দেখে। আট পর্বের এক ওয়েব সিরিজ। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ইতিমধ্যেই আমাদের ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’, ‘টেলিভিশন’, ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ প্রভৃতি অন্য স্বাদের ছবি উপহার দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র জগতে তিনি তাঁর প্রতিভার স্বীকৃতিও পেয়েছেন। তাই মোস্তফা সরয়ার ফারুকী যখন ওয়েব সিরিজ তৈরি করতে আসেন তখন প্রত্যাশাটা অন্য রকম হয়। পরিচালক সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন কীভাবে বাংলাদেশের এক সাধারণ মেয়ে দেশের কর্মজীবী নারীদের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠল, তার গল্পই এই সিরিজে তুলে আনা হয়েছে।
তরুণী সাবিলাকে কেন্দ্র করে গল্পটি শুরু হয়েছে। সাবিলার বাবা অসুস্থ। ধীরে ধীরে তিনি স্মৃতিহীন হয়ে যাচ্ছেন। বাবাকে নিয়ে সাবিলা খুব চিন্তিত। বাবার চিকিৎসার জন্য তাকে প্রায়ই টাকা ধার করতে হয়। সাবিলা সংস্কৃতি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠানের একজন অস্থায়ী কর্মী। তার স্বামীও সংস্কৃতি কেন্দ্রের কর্মী। ঢাকার বাইরে কাজ করে সে। এই সংস্কৃতি কেন্দ্রের চেয়ারম্যান একজন বর্ষীয়ান কবি। নাম খায়রুল আলম। খায়রুল আলমকে চেয়ারম্যান পদের নির্বাচনে জেতানোর জন্য যারা পরিশ্রম করেছিল তাদেরই একজন সাবিলা। সে আশা করেছিল এবার তার চাকরিটা স্থায়ী হবে। বাবার চিকিৎসার সুরাহা হবে। কিন্তু খায়রুল আলমের মাথায় অন্য প্যাঁচ। সাবিলাকে স্থায়ী কর্মী করার লোভ দেখান তিনি। এমনকি তার বাবার চিকিৎসার জন্য পাঁচ লক্ষ টাকা ঋণের ব্যবস্থা করে দিতেও চান। কিন্তু সমস্তটাই খায়রুল দিতে চান সাবিলার শারীরিক সান্নিধ্যের বিনিময়ে। সাবিলা রাজি না হলে ফাঁকা অফিসে এক দিন তার শ্লীলতাহানি করেন খায়রুল। নারীসত্তার অপমানে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে সাবিলা। অফিস কর্তৃপক্ষের কাছে সে অভিযোগ করে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে।
কিন্তু তাতে কী হয়? ফারুকী চমৎকার ভাবে দেখিয়েছেন, কর্মরত নারীদের সম্ভ্রম রক্ষার জন্য অফিসে যে সব অভিযোগ-কেন্দ্র বা কমিশন আছে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সেগুলি কার্যকারিতাহীন। প্রভাবশালী বসকে বাঁচাতেই সকলে তৎপর হন। এমনকি সাবিলার স্বামী, যে সংস্কৃতি কেন্দ্রের একজন কর্মী, সেও এই পরিস্থিতির জন্য স্ত্রীকেই দোষ দিতে থাকে। অফিসে, বাড়িতে ক্রমশ কোণঠাসা সাবিলা সাংবাদিক সম্মেলন করে ন্যায়বিচার চায়। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত কবি, প্রভাবশালী মানুষ খায়রুল আলম পাল্টা যে সাংবাদিক সম্মেলন করেন, সেটাকেই বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে করে এই সমাজ। পরিচালক সাহসের সঙ্গে দেখিয়েছেন খায়রুল আলম অপরাধী হয়েও অপরাধকে তোয়াক্কা না করে কেমন ক্ষমতা দেখাচ্ছেন একা হয়ে যাওয়া মেয়েটিকে। তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করছেন। ল্যাপটপ চুরির অভিযোগ দিচ্ছেন। ক্ষমতার এই খেলা এবং তার মুখোমুখি বিপন্ন মেয়েটির অসহায়তা দর্শকের মনে সতেজ ক্রোধ আনে। নানা প্রশ্নে মুখর হয় মন। পরিচালক এখানে সার্থক। অসাধারণ অভিনয় করেছেন সাবিলার ভূমিকায় তাসনিয়া ফারিন। পাশে খায়রুল আলমের ভূমিকায় আফজাল হোসেন, সাবিলার স্বামী আরিফের ভূমিকায় মোস্তফা মনোয়ার যথাযথ।
সাবিলা যখন সব মিলিয়ে দিশেহারা, কী করবে বুঝে পাচ্ছে না, তখন হঠাৎই খুন হয়ে যান চেয়ারম্যান। গল্প অন্যদিকে মোড় নেয়। শুরু হয় তদন্ত। কে খুন করল চেয়ারম্যানকে? গোয়েন্দাদের চোখে সবচেয়ে সন্দেহভাজন সাবিলাই। তাছাড়াও নানা চরিত্রকে নিয়ে নানা টানাহ্যাঁচড়া শুরু হয়। শেষে সত্য উঠে আসে। কিন্তু কী সেই সত্য, কে এই খুনি, এই আলোচনায় তা উল্লেখ করছি না। এই অংশটিকে জীবন্ত করেছেন পার্থ বড়ুয়া, হাসান মাসুদের মতো অভিজ্ঞ অভিনেতারা।
আট পর্বের এবং চার ঘণ্টার বেশি লম্বা একটি সমাজ-সচেতন ওয়েবসিরিজ তৈরি করা এবং দীর্ঘ সময় দর্শককে টেনে রাখা সহজ কথা নয়। তাই হয়তো মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ক্রমশ থ্রিলারে প্রবেশ করেছেন। এমন একটা কাজের জন্য অভিনন্দন জানিয়েও বলতে হয়, তাঁকে কিন্তু একটু দ্বিধাগ্রস্ত মনে হয়েছে। দ্বিধা এই--- নারীসত্তার অপমানে অপমানিত একজন মেয়ের লড়াইয়ের গল্পকে গুরুত্ব দেবেন, না ‘খুনি কে’ জাতীয় গল্পকে? গোয়েন্দা গল্পের রোমাঞ্চ এসে যাওয়ায় অপমানিত নারীসত্তার বিষাদ অনেকটাই ঢেকে যায়নি কি? সাবিলার মরিয়া লড়াইয়ের আগুন ও অশ্রুই কিন্তু ‘লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন’-এর মূল সম্পদ। সিরিজের শেষে অবশ্য সাবিলার ওপর আবার ফোকাস ফিরে এসেছে। খায়রুল আলমের মেয়ে লরার সহযোগিতায় সাবিলা স্বাধীন ব্যবসায় নামে। অসুস্থ বাবা ও মেয়ের আবেগঘন দৃশ্য ভোলার নয়। তবু...
তাসনিয়া ফারিনের মতোই এই সিরিজে অসাধারণ অভিনয় করেছেন সাবিলার বাবার ভূমিকায় মামুনুর রশীদ। প্রায় নির্বাক অভিনয়, অথচ কী মুখর! তবে চঞ্চল চৌধুরীর মতো জনপ্রিয় অভিনেতাকে অকারণ কয়েক সেকেন্ড এই ছবিতে ব্যবহার করার কারণ বোঝা যায়নি।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী স্বাধীন ও মুক্তচিন্তার পরিচালক। ওয়েব সিরিজে এলেন এ বার। অতিমারি পরিস্থিতিতে গৃহবন্দি মানুষের কাছে চলচ্চিত্র নিয়ে পৌঁছানোর এই নতুন মাধ্যমটি তাঁর অস্ত্র হয়ে উঠুক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy