‘সিমরন’। ছবি: কঙ্গনা রানাউতের ইনস্টাগ্রাম পেজের সৌজন্যে।
সিমরন
পরিচালনা: হনসল মেটা
অভিনয়: কঙ্গনা রানাউত, সোহম শাহ, এষা তিওয়ারি পাণ্ডে, অনিশা যোশী, রূপিন্দর নাগরা
’৯০-এর দশকে হলিউডে ‘ফিমেল বাডি ফিল্ম’ নামক এক ধরনের চলচ্চিত্রের ধারা শুরু হয়েছিল। ‘বাডি’ শব্দটি থেকে এই নামকরণ। এই ধরনের ফিল্মের কেন্দ্রে মেয়েরা থাকে। কিন্তু ছবিগুলো শুধুমাত্র মেয়েদের দুঃখ-দুর্দশা-যন্ত্রণার কাহিনি বলে না। বরং মেয়েদের বন্ধুত্বের কথা বলে। যার মাধ্যমে তাদের জীবনের স্বাভাবিক উচ্ছ্বাস, আনন্দ, ভাল লাগা, খারাপ লাগা, ইচ্ছা, অনিচ্ছা, যৌনতা (যৌন দৃশ্য নয়। যৌনতা সম্পর্কে মেয়েদের মনোভাবের স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ) ইত্যাদি চিত্রায়িত হয়। আর এগুলোর মধ্য দিয়ে নারীসত্তাকে সেলিব্রেট করা হয়। অনেকটা ‘দিল চাহতা হ্যায়’, ‘রক অন’, ‘থ্রি ইডিয়টস’ ইত্যাদি ছবির ফিমেল ভার্শন। হলিউডের এই ধারার গুরুত্বপূর্ণ ছবিগুলি হল ‘থেলমা অ্যান্ড লুইস’ (১৯৯১), ‘ফ্রাইড গ্রিন টম্যাটোস’ (১৯৯১), ‘ওয়েটিং টু এস্কহেল’ (১৯৯৫), ‘ওয়াকিং অ্যান্ড টকিং’ (১৯৯৬) ইত্যাদি। আমাদের সমাজ যেহেতু নারী স্বাধীনতার ব্যাপারে অনেকটাই পিছিয়ে এবং মেয়েদের যৌনতা নিয়ে যেহেতু আমাদের মধ্যে এখনও অনেক জড়তা আছে ফলে এখানে এই ধরনের ছবি তৈরি হতে অনেক দিন সময় লেগে গেছে। গত কয়েক বছরে তৈরি ‘কুইন’ (২০১৪), ‘অ্যাংরি ইন্ডিয়ান গডেসেস’ (২০১৫), ‘লিপস্টিক আন্ডার মাই বুর্খা’ (২০১৭) ছবিগুলি ‘ইন্ডিয়ান ফিমেল বাডি ফিল্ম’ গোত্রের গুরুত্বপূর্ণ ছবি। ‘সিমরন’ ছবিটি এই ভাবেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা ধরে রাখতে পারল না। একসঙ্গে অনেক কিছু করতে গিয়ে ছবিটি শেষ পর্যন্ত অল্প কিছুই করতে পারল।
আরও পড়ুন, মুভি রিভিউ: ‘ড্যাডি’ গ্যাংস্টার থেকে গডফাদার হয়ে ওঠার জার্নি
ছবিটা শুরু হয় আমেরিকা নিবাসী প্রফুল্ল পটেল ওরফে প্রেফ (কঙ্গনা রানাউত) নামে এক জন মেয়ের জার্নি দিয়ে। ৩০ বছরের এক ডিভোর্সি, খামখেয়ালি, খানিকটা পাগলাটে, স্বাধীনচেতা ও স্বনির্ভর প্রবাসী গুজরাতি মেয়ে। একটি পাঁচতারা হোটেলে সে হাউস কিপারের কাজ করে। নিজের জীবন নিয়ে খুবই খুশি। যৌনতা নিয়ে তার কোনও ছুৎমার্গ নেই। ছেলেদের বেছে নিতে প্রেফ লজ্জা পায় না। তার মতে, ছেলে পটানো এক ধরনের আর্ট। ফলে একাধিক ছেলের সঙ্গে সে সম্পর্কে জড়ায়। আটলান্টায় তার বাবা-মার সঙ্গে সে থাকে। কিন্তু স্বাধীন ভাবে বাঁচার জন্য নিজের একটা বাড়ি সে কিনতে চায়। যেখানে সে নিশ্চিন্তে তার বয়ফ্রেন্ডদের নিয়ে আসতে পারবে। এই পর্যন্ত ছবিটি খুব সুন্দর ভাবেই চলছিল। নর্মালি ভারতীয় সিনেমায় আমরা যে ভাবে ছেলেদের চিত্রায়ন দেখি এখানে এক জন মেয়েকে সেই জিনিসগুলি করতে দেখাটা খুবই টাটকা এবং সুন্দর অভিজ্ঞতা। কিন্তু ছবিটি হোঁচট খেতে থাকে তার পর থেকে। যেখানে জুয়া খেলে সর্বস্বান্ত হয়ে প্রফুল্ল একের পর এক ব্যাঙ্ক ডাকাতি করতে থাকে। একই সঙ্গে ফ্যামিলি ড্রামা, থ্রিলার, মিষ্টি প্রেম ইত্যাদি বিষয় একসঙ্গে ধরতে গিয়ে ছবিটি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে ঠিকঠাক ভাবে শুরু হয়েও শেষ অবধি ছবিটা ঠিক জমল না।
‘সিমরন’ ছবির একটি দৃশ্যে কঙ্গনা। ছবি: ইউটিউবের সৌজন্যে।
হনসল মেটা এক জন সেন্সিবল পরিচালক। এর আগে ‘শাহিদ’এবং ‘আলীগড়’-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ ছবি বানিয়েছেন। কিন্তু এই ছবিতে এসে তিনি একটু হোঁচট খেলেন। ছবিতে কঙ্গনা রানাউতের একটি সংলাপ আছে যার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়, ‘মেয়েদের মন একটা রহস্য। জানতে চেও না। তা হলে জান (প্রাণ) চলে যেতে পারে।’ এই রহস্যটাই পরিচালক ঠিকমতো ভেদ করতে পারেননি। অধিকাংশ পুরুষই পারে না। মেয়েরা চায় না ছেলেরা তাদের মুক্তি দিক, উড়তে শেখাক। তারা খোলা আকাশ চায়। উড়তে তারা ছেলেদের থেকে ভালই জানে। এই সূক্ষ্ম ব্যপারগুলো ছবিতে মিসিং। ছবিতে যেমন বেশ কিছু সুন্দর মুহূর্ত আছে তেমনই অনেকগুলো দুর্বল মুহূর্ত এবং লজিকাল মিসটেক আছে। দুর্বল জায়গাগুলির জন্য যদি পরিচালক দায়ী হন তা হলে সুন্দর জায়গাগুলির কৃতিত্ব একমাত্র কঙ্গনার। অন্য কোনও বড় অভিনেতা ছাড়া একটি সাধারণ ছবিকে তিনি শুধুমাত্র অভিনয় গুণে একা ঘাড়ে করে বয়ে নিয়ে গেছেন। ছবিতে তার অভিনয় দেখাটা একটা অসীম তৃপ্তির অনুভূতি। এই অভিনয় দেখার জন্য বহু মাইল পথ পায়ে হেঁটে যাওয়া যায়। ‘তনু ওয়েডস মনু’ থেকে শুরু হয়ে ‘কুইন’, ‘রেঙ্গুন’ আর তারপর ‘সিমরন’, কঙ্গনার অভিনয় ক্রমশ উন্নত থেকে উন্নততর হয়ে উঠছে। কোনও রকম ম্যানারিজম ছাড়া এ রকম সাবলীল অভিনয় হিন্দি ছবিতে খুব একটা দেখা যায় না। শুধুমাত্র তার অভিনয় দেখার জন্য ছবিটা এক বার দেখাই যায়।
আরও পড়ুন, মুভি রিভিউ: ‘চিলেকোঠা’ ভাবাল, কিন্তু চাহিদা পূরণ করল কি?
আরও পড়ুন, মুভি রিভিউ: নামেই বাদশাহো, আদতে ফকির
এখন কথা হচ্ছে, গল্পটা তো প্রফুল্ল পটেলের। এখানে সিমরন কোথা থেকে আসছে। সিমরন বলতে আপামর ভারতবাসীর সবার প্রথম ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে’-র কাজলের কথাই মাথায় আসে। এই ছবিতে অবশ্য ‘ডিডিএলজে’-র একটা রেফারেন্সও আছে। টিভিতে প্রেফের মা যখন ‘যা সিমরন যা। জি লে আপনি জিন্দেগী...’ নামক অমর দৃশ্যটি দেখছিল ঠিক তার পরেই প্রেফ তার প্রথম ব্যাঙ্ক ডাকাতিটি করতে যায় এবং ব্যর্থ হয়। অপ্রস্তুত অবস্থায় ব্যাঙ্কে সে নিজেকে সিমরন বলে পরিচয় দেয়। তার পর থেকেই এই নামটি ছবিতে বার বার ফিরে আসে। কিন্তু আসলে ছবিটি ঠিক ডিডিএলজে বা কাজলের আধুনিক সংস্করণ নয়। সিমরন নামের আভিধানিক অর্থ যদি আমরা দেখি তা হলে অভিধানে অনেকগুলো অর্থ দেখায়। ধ্যান, ঈশ্বরের কাছ থেকে পাওয়া উপহার, বন্ধুত্বপূর্ণ, অস্থির, সৃ, আনন্দদায়ক, গুরুতর, স্বাভাবিক, আধুনিক, সক্রিয়, উপযুক্ত, উদার, ভাগ্যবান। ছবিতে কঙ্গনাকে আমরা এই প্রতিটি রূপেই খানিক খানিক করে দেখতে পাই। সেটা অধিকাংশই তার অভিনয় গুণে। কিন্তু ছবির চিত্রনাট্য যদি আর একটু সাপোর্টিভ হত তা হলে হয়তো ছবিটা ভারতীর ‘ফিমেল বাডি ফিল্ম’-এর আর একটি মাইলফলক হয়ে উঠতে পারত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy