সঙ্গীত জীবনের রজতজয়ন্তীতে উপলব্ধি অকপট মনোময়। ছবি: ফেসবুক।
একক সঙ্গীত জগতের নক্ষত্র তিনি। কখনও নজরুলগীতি, কখনও রবীন্দ্রসঙ্গীত, কখনও আধুনিক গান, আবার কখনও ভক্তিগীতি। ক্যাসেট, সিডির যুগ থেকে ইউটিউব। রিয়্যালিটি শো-এর অন্দরকাহিনি থেকে নিজের জীবনের ঝড়ঝাপটা সামলে সঙ্গীতজীবনের ২৫টা বসন্ত কাটিয়ে ফেললেন শিল্পী মনোময় ভট্টাচার্য। তাঁর সামনে প্রশ্ন রেখেছিল আনন্দবাজার অনলাইন।
প্রশ্ন: সঙ্গীত জীবনের ২৫টা বছর কেমন কাটল?
মনোময়: ভাল-মন্দ মিলিয়েই কেটেছে। তবে আমার এই সফর যে খুব মসৃণ ছিল, তা নয়। প্রথম অ্যালবাম বার হল আর আমি সুপারহিট হয়ে গেলাম কিংবা বিরাট কোনও প্রচার হল, তেমন কিছু আমার জীবনে ঘটেনি। আমাকে আসলে ধাপে ধাপে জায়গা করতে হয়েছে। ১৯৯৬ সালে প্রথম অ্যলবাম মুক্তি। পরবর্তী পাঁচ বছর অসম্ভব লড়াই করতে হয়েছে। প্রত্যেক বছর অ্যালবাম বেরোত কিন্তু শ্রোতাদের কাছে পৌঁছত না।
প্রশ্ন: এর পিছনে কী কী কারণ থাকতে পারে বলে মনে হয়?
মনোময়: আসলে আমাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। অন্যান্য শিল্পীদের গুরুত্ব বেশি দেওয়া হয়েছে। আমার গান ভাল না এমনটা নয়, কিন্তু যতটা প্রচার সেই ক্যাসেট কোম্পানির কাছে আশা করেছিলাম, সেটা করা হয়নি। যার ফলে আমি সাধারণ শ্রোতা বা ‘মাস’-এর কাছে পৌঁছতে পারিনি। সেই সময় সমসাময়িক শিল্পীদের প্রচার হচ্ছে। তাঁদের জন্য মিউজিক ভিডিয়ো তৈরি হচ্ছে। কিন্তু আমার সময় বলত, বাজেট নেই। আমি সেই অসম লড়াইতে হেরেই গিয়েছিলাম।
প্রশ্ন: তা হলে কি এটা সঙ্গীত জগতের স্বজনপোষণের একটা দিক?
মনোময়: (একটু চুপ থেকে) আসলে আমি সেই অর্থে কোনও গডফাদার পাইনি। যার ফলে ২০০০ সাল পর্যন্ত কঠিন লড়াইয়ের মধ্যে কেটেছে আমার। তবে সব খারাপের মধ্যেই ভাল থাকে। সেই সময় রাজ্য সঙ্গীত অ্যাকাডেমির তিনটি বিষয়ে প্রথম হলাম, ডোভার লেন মিউজিক কম্পিটিশনে সেরা লাইভ কণ্ঠশিল্পীর পুরস্কার পেলাম।
প্রশ্ন: তা হলে কোন সময়কে আপনার কেরিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট বলবেন?
মনোময়: ২০০২ সালে ‘মনের মানুষ’ অ্যালবামটা প্রকাশ পেল। তখন অবশ্য নাম ছিল ‘অন্য রকম’। ক্যাসেট বেরোল কিন্তু, এ বারও সেই এক ঘটনা। ক্যাসেট কোম্পানির প্রচারে অনীহা! কিন্তু একটি এফ এম চ্যানেলে হঠাৎই বাজতে শুরু করে। এই যে রেডিয়োতে বাজতে শুরু করল, গানটা সুপারহিট হল। তার পর আমাকে আর রোখা যায়নি। সেই সময় থেকেই আমার ভাল সময় বা সুদিনের শুরু।
প্রশ্ন: প্রথম থেকেই কি সঙ্গীত জগতে আসার ইচ্ছে ছিল?
মনোময়: আমি কোনও দিনই ভাবিনি যে, আমি কী হব। তবে আমার মা-বাবা আমাকে বিভিন্ন গুরুর কাছে গান শিখিয়েছিলেন, প্রায় টানা ২৫ বছর। প্রায় ৭ বছর বয়সে রবীন্দ্রসদনে প্রথম মঞ্চে গান গাই। সেই হিসাব করলে আমার সঙ্গীত জীবনের প্রায় ৪০ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। বিভিন্ন খ্যাতনামী সব গুরুর সান্নিধ্য পেয়েছি। এগুলোই আমার জীবনের সম্পদ। তবে গানের পাশাপাশি খেলাধূলায় খুব আগ্রহ ছিল। এক বার রেলের চাকরির পরীক্ষা দিয়েছিলাম। ব্যাঙ্কের পরীক্ষাও দিই। কিন্তু এত পড়াশোনা করতে হয়, তার থেকে দেখলাম গানবাজনা সহজ। তার পর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে গান নিয়ে স্নাতকোত্তর করি। আমি নিজে কখনও ভাবিনি যে এটাই আমার জীবিকা হবে। তবে বাবা চাইতেন আমি সঙ্গীতশিল্পী হই। ১৯৯৫-৯৬ সালে দূরদর্শন বাংলায় ‘গান শুধু গান’ নামের একটি অনুষ্ঠানে আমি চ্যাম্পিয়ন হই, যেটা আমাকে পরিচিতি দেয়।
প্রশ্ন: আপনি যে সময়ের কথা বলছেন সেই সময় নচিকেতা চক্রবর্তী, কবীর সুমন, অঞ্জন দত্তদের সময়। লড়াইটা কি সে জন্য কঠিন হয়?
মনোময়: হতে পারে, তবে তাঁরা তখন রীতিমতো তারকা। আমি নিজে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে নচিদার ক্যাসেট কিনেছি, আমি ওঁর গানের ভক্ত। আসলে খারাপ লাগত, যখন দেখতাম একই ধরনের অ্যালবাম ওই কোম্পানি থেকে বেোরচ্ছে, কিন্তু আমার গানটাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না।
প্রশ্ন: সেই সময় আপনার তুলনায় বেশি প্রচার করা হত এ রকম শিল্পী কারা ছিলেন?
মনোময়: কারও নাম নিতে চাই না, সেই সময়কালটা ১৯৯৬ থেকে ২০০০-এর দিকে তাকালেই বোঝা যাবে সেই সময়ে কারা খ্যাতি পেয়েছেন। তবে সেই সময় একটা জেদ তৈরি হয় আমার। ‘মনের মানুষ’ অ্যালবামটা হিট করার পর যারা আমাকে প্রত্যাখান করেছিল, তারাই আবার ফিরে আসে। সেটাই আমার জিত।
প্রশ্ন: সেই সময় প্রচার কম পাওয়ার কারণে কি কোনও আক্ষেপ রয়েছে?
মনোময়: আমার লড়াই তো শেষ হয়নি! এখনও আমার গানের শিক্ষা দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে হয়। কারও প্রতি অভিযোগ নেই, তবে আক্ষেপ রয়েছে আমার গানের যে শিক্ষা সেখান থেকে আমি বুঝেছি, আমি ‘ক্লাস’-এর জন্য গানবাজনা করি, ‘মাস’-এর জন্য নয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় নেচে গান গাওয়ার জন্য তো গানবাজনা শিখিনি। আমার শ্রোতারা সুস্থ রুচির গান শুনতে পছন্দ করেন। এখন তো মঞ্চে শিল্পীরা উঠলে ধোঁয়া আর আলোর খেলা। আমি অবশ্য মঞ্চে ওঠার সময় বলে দিই স্টেজে কোনও ধোঁয়া হবে না। আর আলো যতটুকু না হলে নয়, ততটুকুই যেন থাকে।
প্রশ্ন: ক্যাসেট থেকে সিডি। সেখান থেকে ইউটিউবের যুগে নিজেকে কী ভাবে মানিয়ে নিয়েছেন?
মনোময়: আমি একেবারেই মানাতে পারিনি। যখন থেকে গানের মাঝে ভিডিয়ো এল, সঙ্গীতের ক্ষতি হয়েছে। বাংলা স্বর্ণযুগের গান কিন্তু বিখ্যাত হয় রেডিয়োর জন্য। গানটা শোনার, দেখার নয়। তাই ভাল কম্পোজ়িশন ছাড়া গান গাইব না। আর জীবনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, কখনও বিজ্ঞাপনে গাইব না। লোহালক্কড়, চানাচুর, আইসক্রিম, সাবান, এ সবের গান গাইব না!
প্রশ্ন: সুদীর্ঘ কেরিয়ার। সময়ের সঙ্গে গানের জগতে কী কী পরিবর্তন এসেছে বলে মনে হয়?
মনোময়: গান এখন এমন একটা জিনিস, যা বিনামূল্যে পাওয়া যায়। আগে শিল্পীকে খুঁজে নিতেন দর্শক। এখন শিল্পীকে যেতে হয় দর্শকের কাছে। আসলে মানুষ এখন রিল বেশি শোনে, গানটা পুরো শোনার ধৈর্য নেই। এখন দেখি নিম্নরুচির গান বেশি প্রচার পাচ্ছে।
প্রশ্ন: কলকাতার মিউজ়িক ইন্ডাস্ট্রির ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?
মনোময়: এই মুহূর্তে আমি খুব একটা স্বপ্ন দেখছি না। যদি গানকে ফের রেডিয়ো মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা যায়, তবে নতুন ভাবে সেই গৌরব ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
প্রশ্ন: আপনাকে সিনেমার গানে সে ভাবে পাওয়া যায়নি। সুযোগ কম পেয়েছেন বলে মনে হয়?
মনোময়: হ্যাঁ, মনে তো হয়। আমার কণ্ঠ ততটা ব্যবহার করা হয়নি। কিন্তু যেগুলো গেয়েছি সেগুলো দর্শক পছন্দ করেছেন। ‘রংবাজ’ ছবিতে আমার গাওয়া ‘দিশাহীন’ গানটি যে কোনও অনুষ্ঠানে আমাকে গাইতেই হয়। আমি আসলে কোনও দিনও কোনও সুরকারকে বলতে পারিনি, আমাকে কাজ দাও।
প্রশ্ন: আপনি রিয়্যালিটি শোয়ের অংশ হয়েছেন। বর্তমান সময়ে উঠতি গায়ক-গায়িকাদের জন্য রিয়্যালিটি শো-ই কি একমাত্র ভবিষ্যৎ?
মনোময়: এটা হল ক্ষণিকের খ্যাতি পাওয়ার জায়গা। এখন অনেকেই রিয়্যালিটি শো থেকে বেরিয়ে অর্থ উপার্জনের জন্য ছোটে। যার ফলে গানটা নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। আমি বলছি না, প্রতিভা একেবারেই নেই, তবে অর্থের পিছনে ছুটছে এরা। এখন সবাই নাচের গান গাইতে চান। যার ফলে নিজস্বতা হারিয়ে যাচ্ছে।
প্রশ্ন: রিয়্যালিটি শো-তে প্রতিযোগীদের কখনও মাত্রাতিরিক্ত প্রশংসা করা হয়। সেটা কি কোথাও পূর্ব পরিকল্পিত?
মনোময়: আসলে রিয়্যালিটি শো-তে বিনোদনটাই সব। এই ধরনের শোতে বাছাই করা কিছু গান আছে।রিয়্যালিটি শোতে ভারী গান গাওয়া হয় না, ঢিমে তালের গান গাইলে দর্শকের চ্যানেল ঘুরিয়ে দেওয়ার ভয় থাকে। একটা অনুষ্ঠানকে সফল করতে অনেক কিছু প্রয়োজন। গানও এখন সিরিয়ালের মতো হয়ে যাচ্ছে! সেটাকে সফল করতে কনটেন্টের প্রয়োজন। আসলে যুগের সঙ্গে সঙ্গে সবটারই পরিবর্তন হয়েছে।
প্রশ্ন: এখনকার দিনে শো পাওয়ার মাপকাঠি কী কী?
মনোময়: গ্রুমিংটা একটা বড় দিক। এক জন শিল্পী কতটা স্মার্ট, কতটা তাঁর সমাজমাধ্যমে পরিচিতি, সেই নিরিখেই তাঁরা শো পান। আয়োজকরাও সেগুলিই দেখেন। গানের তুলনায় এগুলো এখন অগ্রাধিকার পায়।
প্রশ্ন: গান নিয়ে কোনও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা?
মনোময়: নিজের অ্যাকাডেমি তৈরি করব। যে গুরুভাগ্য আমার হয়েছিল, সেটা আমি ছাত্রছাত্রীদের শেখাতে চাই। আর জীবনে আরও কতটা সুরে গাইতে পারি সেই প্রচেষ্টা করতে থাকব।
গ্রাফিক : সনৎ সিংহ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy