যাত্রায় বরাবরই আনাগোনা টেলিপাড়ার তারকাদের
যাত্রা মানেই রাম-রাবণের যুদ্ধ কিংবা দেবতাদের অসুরবধের গল্প। বহু দিন পর্যন্ত এটাই ছিল আমজনতার চালু ধারণা। সে কথা ভুল প্রমাণ করে ছেড়েছে রমরমিয়ে চলা একের পর এক ঐতিহাসিক ও সামাজিক পালা এবং দর্শক-ঠাসা মাঠ। কিন্তু সে ধারাও ভেঙে ফেলে গত কয়েক বছরে ফের অন্য পথে হাঁটছে যাত্রা পাড়া। সৌজন্যে টলিউড তারকাদের উপস্থিতি। অনেকেই বলছেন, ইদানীং যাত্রাও নাকি লেখা হচ্ছে ধারাবাহিকের আদলে!
যাত্রার মঞ্চে পর্দার চেনা মুখেদের আনাগোনা নতুন কিছু নয়। টলিউড থেকে বরাবরই যাত্রা-য় যাত্রা অব্যাহত অভিনেতা-অভিনেত্রীদের। গত কয়েক দশকে পৌরাণিক থেকে ঐতিহাসিক পালা কিংবা সামাজিক পালার বিভিন্ন চরিত্রে নানা সময়েই দেখা গিয়েছে বড় পর্দা ও ছোট পর্দার চেনামুখ। কেউ সেখানেও সফল, কেউ বা পর্দায় জনপ্রিয় হলেও তেমন নজর কাড়তে পারেননি যাত্রার মঞ্চে। কোভিডের আগে গত কয়েক বছরে টলিউড তারকাদের অনেককেই দেখা যাচ্ছে যাত্রার মঞ্চে। শোনা যাচ্ছে, তাঁদের অভিনয় রীতিকে পালা-র মানানসই করে তুলতে ইদানীং নিজের চেনা চরিত্র পাল্টে ফেলছে যাত্রাই! দৃশ্য লেখা হচ্ছে টিভির ধারাবাহিকের মতো করে।
এ নিয়ে আক্ষেপ রয়েছে সাঁইত্রিশ বছর যাত্রা পাড়াতেই কাটিয়ে দেওয়া অভিনেতা-পালাকার অনল চক্রবর্তীর। নিজে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে পালা লেখেন বরাবরই। বললেন, “এখন বেশির ভাগ দলই চেষ্টা করে টেলিপাড়ার নায়ক-নায়িকাদের যাত্রার মঞ্চে নিয়ে আসতে। গ্রামগঞ্জ, মফস্সল কিংবা শহর, তাঁদের দেখতে দর্শক ভিড় করেন বেশি। ফলে বিষয়টা লাভজনক। তাই নতুন ছেলেমেয়েদের তৈরি করার চেয়ে ইদানীং প্রযোজকরাও এ দিকটায় ঝুঁকছেন বেশি। আর সেই অভিনেতাদের সুবিধা দিতে গিয়ে যাত্রার দৃশ্যগুলোও তাই ধারাবাহিকের মতো করে লেখা হয়।”
যাত্রা এ ভাবে তার নিজস্ব গরিমা হারানোর জন্য নিজেদেরই দায়ী করছেন ছোটপর্দার জনপ্রিয় অভিনেতা বাদশা মৈত্রও। তাঁর কথায়, “এক সময়ে স্বপনকুমারের মতো দুর্দান্ত মঞ্চসফল তারকারা ছিলেন যাত্রায়। এমনই অসামান্য তাঁর অভিনয়, যে স্বয়ং উত্তমকুমারও নিয়মিত যাত্রা দেখতে যেতেন। পরবর্তীতেও একের পর এক নামী অভিনেতা তৈরি করেছে যাত্রা মঞ্চ। দুর্দান্ত সব পালা লেখা হত, ঐতিহাসিক পালা, সামাজিক পালা— তার অভিনয়, তার কাহিনি, সমাজকে দেওয়া বার্তা, সে সবের কোনও তুলনা হয় না। সেটা তো নষ্ট করেছে আমাদের মতো অভিনেতারা। পর্দায় অভিনয় আর যাত্রায় অভিনয়ের অনেকখানি তফাত। তা আয়ত্ত করতে পরিশ্রম লাগে, আগ্রহ আর যত্নও। সে সব না দিলে চলবে? বিদেশে যে ভাবে অপেরা বা ব্রডওয়ে থিয়েটারকে একেবারে আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হয়, যাত্রার পুরনো ঐতিহ্য ধরে রাখতে এ দেশে কি তা করা যেত না? উল্টে এখানে যাত্রার মান তো পড়েইছে, তাকে বাঁচিয়ে রাখতে এখন বিনা টিকিটের শো হয়!”
যাত্রা যে ধারাবাহিকের মতো হয়ে যাচ্ছে, তা মানছেন গৌতম নন্দীও। তিনটি যাত্রা দলের প্রযোজক সরাসরিই বললেন, “হ্যাঁ, ইদানীং পর্দার তারকাদের একা বা জুটি হিসেবে যাত্রায় নিয়ে আসার চল-টা সত্যিই বেশি। কারণ আর কিছুই নয়, তাঁদের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগানো। টেলিভিশনের তারকারা পর্দায় যতটা সাবলীল, মঞ্চে যে তেমনই হবেন, তা তো হয় না। ফলে তাঁদের অভিনয়ের সুবিধা করে দিতে কিছুটা ধারাবাহিকের মতো করে পালার দৃশ্য লেখা হয়। আর এই অভিনেতাদের যথাসম্ভব সাপোর্ট দেন যাত্রার শিল্পীরা। তবে টলিউডের কেউ কেউ এসে কিন্তু নিজগুণেই যাত্রার মঞ্চে জায়গা করে নিয়েছেন। তাঁদের অভিনয় যাত্রার দর্শকও ভালবাসেন। যেমন, লাবণী সরকার কিংবা পর্দার ‘ওম-তোড়া’ জুটি।”
টেলিপাড়ার চেনা মুখ, পর্দার ‘ওম-তোড়া’ ওরফে তারকা দম্পতি রাজা ও মধুবনী গোস্বামী যাত্রায় কাজ করতে রীতিমতো ভালবাসেন। ২০১২ সাল থেকে কোভিডের আগে পর্যন্ত প্রায় প্রতি মরসুমেই যাত্রার শো করেছেন নিয়মিত। রাজার কথায়, “পর্দার অভিনয় ক্যামেরার সামনে। আর সেখানে যাত্রায় মঞ্চের তিন দিক থেকে দর্শক আমাদের দেখছেন। একেবারে শেষ সারির দর্শকের কাছেও আমাদের সংলাপ আর গান একেবারে ঠিক ঠিক পৌঁছতে হচ্ছে, তার মজা বা চ্যালেঞ্জ দুটোই আলাদা। দারুণ উপভোগ করি। আর যাত্রার দর্শক কিন্তু আমাদের ভালও বেসে ফেলেছেন। এক বার বিবাহবার্ষিকীর দিনে জেলায় শো করতে গিয়েছিলাম। কী করে যেন খবর পেয়ে কয়েক জন দর্শক একেবারে ছুরি হাতে কেক নিয়ে হাজির! আর এক বার বিরতির সময়ে নিজের বাড়িতে তৈরি মুড়ি-বেগুনি নিয়ে এসেছিলেন এক দর্শক। এই ভালবাসার কোনও তুলনা হয় নাকি!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy