Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
Entertainment News

‘বাঘার ঢোলে বেঁচে থাকবেন আমাদের বাকুদা’: দেবজ্যোতি মিশ্র

সম্প্রতি চলে গেলেন প্রবাদপ্রতিম রিদম অ্যারেঞ্জার শুভেন দে ওরফে ‘বাকুদা’। স্মৃতিচারণায় তাঁর গুণমুগ্ধ দেবজ্যোতি মিশ্র

বাদ্যযন্ত্র-শিল্পী শুভেন দে।

বাদ্যযন্ত্র-শিল্পী শুভেন দে।

শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১৪:৪৩
Share: Save:

সময় হিসেবে ৩৮ বছর, আমার চেনা মানুষটি– একই মানুষ, দু’রকম ব্যক্তিত্ব। একজন বাদ্যযন্ত্র-শিল্পী শুভেন দে, যিনি সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছেন গুণীজনের,আর অন্যজন ‘বাকুদা’, ভালবেসে সবাই আমরা এই নামেই ডেকেছি তাঁকে।

যে সব গুণীজনের সান্নিধ্যে নিজের ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে একের পর এক কাজ করে গেছেন, তাঁরা হলেন সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার থেকে ঋতুপর্ণ ঘোষ। শুভেন দে হলেন বাংলার এক বিশিষ্ট সঙ্গীত পরিবারের চতুর্থ প্রজন্ম, বাংলার চলচ্চিত্র যতদিন থাকবে, এই মানুষটির অবদানও অমলিন ভাবে রয়ে যাবে। শুধু চলচ্চিত্র কেন বলব? অসংখ্য বাংলা আধুনিক গানের গায়েও লেগে আছে শিল্পী শুভেন দে’র অনবদ্য সঙ্গত।

তবলার জাদুকর রাধাকান্ত নন্দীর ভাবশিষ্য ছিলেন তিনি। বাংলা ঢোলে ‘তাকদুম’ বোলের আন্দাজ পেয়েছিলেন তিনি ওঁর থেকেই। এভাবেই তো পরম্পরা তৈরি হয় আর এভাবেই ‘গুপী-বাঘা’র বাঘা বাইনের রূপকার হয়ে ওঠেন কালজয়ী রাধাকান্ত নন্দী ও তাঁর ভাবশিষ্য শুভেন দে। বস্তুত, রাধাকান্ত নন্দীর বাজানো বাঘা বাইনের ঢোল ছিল শুভেন দে-র ঢোল বাজানোর অনুপ্রেরণা।

আমার বয়স যখন সতেরো, ইন্ডাস্ট্রিতে সবে এসেছি আমি। দেখেছি জমজমাট সলিল চৌধুরীর ফ্লোর থেকে সুধীন দাশগুপ্তের ফ্লোরে, সর্বত্র কি অনায়াস যাতায়াত তাঁর। সলিল দা’র গানের ধারা আর সুধীন দা’র গানের ফর্ম এক রকম নয়। বিস্মিত হতে হয় কী ভাবে নিজেকে দুটো জায়গায় দুটো সত্ত্বায় ভাগ করে নিতে পারতেন তিনি। দু’রকম সঙ্গত, দু’ধরনের পারকাশন, মানুষটি কিন্তু এক—শুভেন দে।

আরও পড়ুন, ঋতুদার বকুনিগুলোও মিস করি: সুদীপ্তা

আমি যখন সলিল চৌধুরীর সঙ্গে কাজ শুরু করি, তখন আমি তাঁর সহকারী ও অবশ্যই ছাত্র। দেখেছি বাকুদার প্রতি সলিলদার কি নির্ভরতা! নতুন কোনও রেকর্ডিং সেশনের মিউজিশিয়ান লিস্ট যখন তৈরি হত, প্রথম দু’-তিনটি নামের মধ্যেই থাকত বাকুদার নাম। কোনও একবার বাকুদা অ্যাভেলেবল ছিলেন না। তাঁকে পাওয়া যায়নি তাঁর অন্য রেকর্ডিংয়ের ব্যস্ততার কারণে।আমি এক গুণী তবলিয়ার কথা সলিলদাকে সাজেস্ট করেছিলাম। সলিলদা বলেছিলেন, “আমার বাকুকেই প্রয়োজন, কারণ ও গানবাজনা ছাড়াও আমাকে বোঝে। যেভাবেই হোক, ওকে রেকর্ডিংয়ে পেতেই হবে। সলিলদার প্রতি যেমন অগাধ শ্রদ্ধা ছিল বাকুদার, সলিলদারও তেমন ছিল বাকুদার প্রতি ভরসা ও আস্থা।


বাকুদার সঙ্গে দেবজ্যোতি।

পাঠকের নিশ্চয়ই মনে আছে, ‘গল্প হলেও সত্যি’র আমাদের সবার প্রিয় সেই দাদুকে, গোটা একান্নবর্তী পরিবারকে ধরে রেখেছিলেন যিনি। এ-ও নিশ্চয়ই মনে আছে, সেই ছায়াছবিতে সেই দাদুর মাথায় রবি ঘোষের তেল মালিশ করার দৃশ্যটি! তবলার বোলে যে হাস্যরস তৈরি হয়েছিল তার নেপথ্যের কারিগরও কিন্তু সেই শুভেন দে, আমাদের বাকুদা! তরুণ মজুমদার, তপন সিংহেরও অত্যন্ত প্রিয় মিউজিশিয়ান ছিলেন এই মানুষটি। অসংখ্য পরিচালক ও সঙ্গীত-পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন, কিন্তু পিছনে ফিরে তাকাননি কখনও। না হলে কি আর এমন বীরদর্পে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায়?

আরও পড়ুন, আমার মধ্যেও তো একটা ঋতু বেঁচে আছে!

আমার কাজের প্রসঙ্গে আসি। ঋতুপর্ণ ঘোষের সঙ্গে আমার ‘চোখের বালি’র কাজ চলছে তখন। সারা ছবি জুড়ে সিম্ফনি অর্কেস্ট্রা আর বড়সড় কয়ার অ্যারেঞ্জমেন্ট হয়েছে। সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র। বাকুদা ছিলেন আমার রিদম অ্যারেঞ্জার। বাংলা ঢোল থেকে খোল, পাখোয়াজ থেকে তবলা— কত নানা রকমের ইনস্ট্রুমেন্টের ব্যবহার। মূল ব্যাপারটা হল,বাকুদার মুন্সিয়ানায় প্রতিটি বাদ্যযন্ত্রের বৈশিষ্ট্য কখনওই অর্কেস্ট্রেশনকে ছাপিয়ে যায়নি। যাঁরা সঙ্গীত-মনস্ক মানুষ, তাঁরা জানেন এটা কতটা দুরূহ কাজ ছিল। আমি আজ পর্যন্ত এমন কোনও পার্কাশনিস্ট দেখিনি যিনি বাজনার বাইরে বাকুদার মতো করে এভাবে অর্কেস্ট্রাল মিউজিক বুঝতেন।

‘দহন’ থেকে ‘চিত্রাঙ্গদা’, আমার সমস্ত কাজের সঙ্গী ছিলেন বাকুদা। ঋতুপর্ণর সঙ্গে ছিল তাঁর এক অদ্ভূত সখ্য। সিনেমার আবহসঙ্গীতে দৈনন্দিনের টুকিটাকি যেকোনও সাধারণ জিনিস থেকে অসাধারণ শব্দের ক্যানভাস বাকুদা তৈরি করতে পারতেন অবলীলাক্রমে। ‘রেনকোট’ ছবির গানে বাকুদার রিদম অ্যারেঞ্জমেন্ট ছিল একেবারে ভিন্ন। খুবই অল্প বাদ্যযন্ত্র বেজেছে তাতে। অর্থাৎ, ‘চোখের বালি’রঠিক বিপরীত মেরুর সাউন্ডস্কেপ তৈরি করেছিলেন এই ছবিতে, সেই একই বাকুদা!


চেনা মেজাজে বাকুদা।

‘রোড টুকাঠমান্ডু’, এই নামের একটি অসাধারণ ইনস্ট্রুমেন্টাল মিউজিক আছে। এই কম্পোজিশনে অ্যাকর্ডিয়ান-এ ছিলেন ভারতের দিকপাল ওয়াই এস মুল্কি, গিটারে ছিলেন আর এক দক্ষ মিউজিশিয়ান খোকন মুখোপাধ্যায় এবং ভাইব্রাফোনে ছিলেন ভাইব্রাফোনের জাদুকর আন্টো মেনেজ্যেস। এই পিসটিতে বাকুদা যে কি অসাধারণ নেপালি মাদল বাজিয়েছেন, পাঠক শুনে দেখবেন। মনে হবে, ঘরে বসে আপনি নেপালের তুষারশুভ্র পাহাড়, ছোট ছোট গ্রাম, আর পাহাড় থেকে নেমে আসা নাম না জানা ঝর্নার দৃশ্য উপভোগ করছেন। এই নেপালি মাদল কলকাতা শহরে ইন্ট্রোডিউস করেছিলেন বাকুদা। এ কৃতিত্ব সম্পূর্ণ তাঁর।

বাকুদা ছটফটে। চঞ্চল। মেজাজি ও কিছুটা বেহিসাবিও। কখনও বা উদাসীন। সব মিলিয়ে এক রঙিন মানুষ। তবলায় অবলীলাক্রমে চলা আঙুল থেকে উঠে আসত ম্যাজিক মুহূর্ত।

এহেন শিল্পী মানুষটি আচমকাই ৭৬ বছর বয়সে আমাদের থেকে অনেক দূরে চলে গেলেন। এভাবেই একদিন সবাইকেই বিদায় জানাতে হয়। সে বড় মন খারাপের। তবু রয়ে যায় শিল্পীর কাজ। তিনি বেঁচে থাকেন তাঁর সৃষ্টিরমধ্যদিয়েই। কিছুদিন আগে ক্যানসার ধরা পড়েছিল। হাসপাতাল থেকে ক্রিক রো’র নিজের বাড়িতে আর ফেরাহলনা তাঁর। শেষ বিদায় জানাতে যখন মেডিক্যাল কলেজে পৌঁছলাম, দেখলাম পরিবারের মানুষেরা, স্নেহধন্য ছাত্রছাত্রীরা জড়ো হচ্ছেন একে একে আর এই সবের মাঝে অদৃশ্যভাবে যেন ষাট-সত্তর দশকের গানেরাও এসে হাজির নতমুখে। ওরাও জানাতে এসেছে ওদের প্রিয় মানুষটিকে আদরের বিদায়। আমার ৩৮ বছরের সঙ্গী। বাংলার এক অনন্য প্রতিভা। ‘শুভেন দে’। বাকুদা, তোমাকে আমার বিনম্র প্রণাম।

অন্য বিষয়গুলি:

Debojyoti Mishra Tollywood Death Celebrities
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE