তরুণ মজুমদার এবং দেবশ্রী রায়।
বাবার পরে পিতৃস্থানীয় যদি কেউ থেকে থাকেন, তিনি তরুণ মজুমদার। তনুদার ছবিতে আমার প্রথম কাজ ‘কুহেলি’ দিয়ে। তখন আমি খুবই ছোট। অভিনয়ের ‘অ’-ও বুঝি না। একটু বড় হয়ে মনে মনে ইচ্ছে, আমি নাচের দুনিয়ায় আসব। এ দিকে, মায়ের শখ মেয়ে অভিনয়ে আসবে। তাই মা তনুদাকে ‘কুহেলি’র পরেই অনুরোধ জানিয়ে রেখেছিলেন, তাঁর পরের ছবিতে যেন আমায় অভিনয়ের সুযোগ দেন। তনুদা মাকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ‘‘মিসেস রায়, চুমকিকে আমার মনে থাকবে। আমার পরের ছবিতে ওকে অবশ্যই ডাকব।’’
এর কিছু পরে তনুদা ঠিক করলেন হিন্দিতে ‘বালিকা বধূ’ করবেন। ঠিক মনে রেখে আমায় ডেকে পাঠালেন। মায়ের সঙ্গে গেলাম ওঁদের টালিগঞ্জের বাড়ি ‘সন্ধ্যানীড়’-এ। যাওয়ামাত্র সন্ধ্যাদি আদর করে তাড়াতাড়ি কাছে টেনে নিলেন। বললেন, ‘‘আমি সাজিয়ে দেব। তার পর যে ভাবে দেখিয়ে দেব, সে ভাবে অভিনয় করবে। কেমন?’’ আমি বাধ্য মেয়ের মতো ঘাড় নেড়েছিলাম। সন্ধ্যাদি কত যত্ন করে আমায় বেনারসি পরিয়ে, চুল বেঁধে দিলেন। সংলাপও শিখিয়ে দিলেন। সে ভাবে বললামও। তনুদা সব দেখে মাকে ডাকলেন। বললেন, ‘‘মিসেস রায়, আমি যে রকম ‘পাকা বাচ্চা’ চেয়েছিলাম চুমকি যে সে রকম নয়! ও এখনও খুবই সরল। মুখে-চোখে সেই সারল্যের ছায়া। ওকে দিয়ে তো আমার হবে না! আমার ‘পাকা বাচ্চা’ চাই।’’
শুনে মায়ের মুখ ম্লান। আমার তখন নিজের উপরেই কী রাগ! কেন একটু ‘পাকা’ হতে পারলাম না! তা হলে তো তনুদার ছবিতে সুযোগ পেয়ে যেতাম। তনুদা তখনও মাকে আশ্বাস দিচ্ছেন, তিনি আরও ছবি করবেন। ঠিক ডাকবেন। এর পরে ডাক এল ‘দাদার কীর্তি’র জন্য। আমি তত দিনে আর কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেছি। তনুদা আবারও ‘লুক টেস্ট’ করালেন। এ বারে উৎরে গেলাম। ওঁর একটা বিশেষ ধরন ছিল। সমস্ত অভিনেতাদের একসঙ্গে বসিয়ে চিত্রনাট্য পড়তেন। সে সব মিটলে আবারও মাকে ডাকলেন তনুদা। এ বার তাঁর বক্তব্য, ‘‘আপনার মেয়ে আগামী দিনে আরও ছবিতে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করবে। সেখানে তো চুমকি নাম মানাবে না! ওর নাম বদলাতে হবে।’’ মা তনুদাকে অনুরোধ জানালেন, ‘‘আপনিই তা হলে দায়িত্ব নিয়ে একটা নাম দিন। মৌসুমীর দিয়েছেন, মহুয়ার দিয়েছেন। আমার মেয়ের নতুন নাম না হয় আপনার হাতেই হোক।’’
তনুদা রাজি হলেন। জানালেন, চিত্রনাট্যের খাতায় নতুন নাম লিখে পাঠিয়ে দেবেন। যথা সময়ে খাতা এল। দেখি উপরে লেখা, ‘দাদার কীর্তি’, চিত্রনাট্য, দেবশ্রী রায়। পরের পাতায় লেখা চরিত্র-বাণী। সেই দিন জন্ম নিল দেবশ্রী। এত অজানা নাম আমায় দাদা দিয়েছিলেন! সবাই শুনে তারিফ করতেন। গর্বে আমার বুক ভরে উঠত। তনুদা সব সময়ে বলতেন, ‘‘আমার তিন মেয়ে। মৌসুমী, মহুয়া, দেবশ্রী। যাঁদের আসল নাম ইন্দু, সোনালি আর চুমকি। আমার মৃত্যুর পরে এঁরাই আমার শেষকৃত্য করবে।’’ হাতে ধরে অভিনয় শিখিয়েছেন। বুঝিয়েছেন, গানের যেমন ছন্দ আছে, স্বরলিপি আছে, অভিনয়েরও তেমনই ছন্দ-স্বরলিপি আছে। ঠিক সময়ে তাকে ধরতে হয়। আবার ছাড়তে হয়। দরকারে অভিনয় করে দেখিয়ে দিতেন আমাদের। সব পরিচালক কিন্তু এ ভাবে অভিনয় করে দেখাতে পারেন না। এটা পারতেন তরুণ মজুমদার আর তপন সিংহ।
যেমন আদর করতেন তেমন বকুনিও দিতেন তনুদা! ‘দাদার কীর্তি’র সেটে একটা স্কেল রেখে দিয়েছিলেন। একটু ভুল হলেই পিঠে পটাং পটাং করে রুলের ঘা! এ ভাবে পাখি পড়ানোর মতো করে অভিনয় শিখিয়েছেন। জীবনভর তার সুফল পেয়েছি। একটি দৃশ্যের আগে হঠাৎ আমার ঠোঁটের দিকে নজর গেল কিংবদন্তি পরিচালকের। সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘‘ঠোঁটে কী মেখেছিস রে চুমকি?’’ আমি তো ভয়ের চোটে বলেছি, কিচ্ছু মাখিনি। এ দিকে তো জানি কী করেছি! মু্ম্বইয়ের অভিনেত্রীদের দেখে লিপগ্লস লাগিয়েছি! ঠোঁট চকচক করছে। ঠিক নজরে পড়েছে তনুদার। সঙ্গে সঙ্গে রূপটান শিল্পীকে ডেকে ঠোঁট মুছে দিতে বললেন। আর আমায় শেখালেন, সিঁদুরের টিপ পড়লে ক্যামেরায় মুখ স্নিগ্ধ দেখতে লাগে। ভেলভেটের বিন্দি পড়লে একদম বদলে যায় মুখ। ঠিক সে ভাবেই লিপগ্লস ক্যামেরায় দেখতে ভাল লাগে না। তাই আর কোনও দিন যেন অভিনয়ের সময়ে লিপগ্লস না লাগাই।
অন্যান্য সময়ে দাদার ক্যামেরা সামলাতেন সৌম্যেন্দু হালদার। কিন্তু গানের দৃশ্যে কিছুতেই কাউকে ক্যামেরা ছাড়তেন না তিনি। পুরোটা নিজে সামলাতেন। তরুণ মজুমদারের গানের দৃশ্য তাই এত কাব্যিক হয়ে উঠত।
এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনা বলি? ‘ভালবাসা ভালবাসা’ ছবির একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য নেওয়া হচ্ছে। আমার জ্বর। পর্দায় সন্তু-সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির সরস্বতী পুজোয় ওই অবস্থাতেই আমায় পাঁজাকোলা করে নিয়ে আসা হবে। আমি এসে বসব। তাপস পাল গাইবেন, ‘হার মানা হার পরাব তোমার গলে’। গানের আগে সে দিনের মতো দৃশ্যগ্রহণ শেষ।
তনুদা পইপই করে বললেন, ‘‘দেবশ্রী আজ বাড়ি গিয়ে কারওর সঙ্গে কোনও কথা বলবে না। কোনও গান বা সিনেমাও দেখবে না। খেয়ে, ঘুমিয়ে পড়বে। যেখানে আজ শেষ করলে ঠিক সেখান থেকে আগামী কাল শুরু করতে হবে।’’ আমি কথা শুনেছিলাম। সেই আমিই কিন্তু পুরো বিগড়ে গিয়েছিলাম প্রথম ছবি ‘কুহেলি’র সেটে। একটা কান্নার দৃশ্য ছিল। কিছুতেই কাঁদছিলাম না সেখানে। চোখে গ্লিসারিনও দিতে দিচ্ছিলাম না। পরে শুনেছি, ক্যামেরাম্যান সৌম্যেন্দুদাকে ক্যামেরা তৈরি রাখতে বলে তনুদা আমায় প্রচণ্ড বকেছিলেন। আচমকা সেই রাগ দেখে, ধমকের চোটে প্রথমে আমি থতমত খেয়ে গিয়েছিলাম। তার পরেই ঝরঝরিয়ে কাঁদছি! আর ক্যামেরা চলছে। শট শেষ। কিন্তু আমায় আর থামানোই যাচ্ছে না। ক্যাডবেরি, চকোলেট দিয়েও না।
তখনই আমি তনুদাকে সেটে সবার সামনে শাসিয়েছিলাম, ‘‘আমায় এ ভাবে করলে তো! পাড়ায় এস এক বার। আমার হাতে অনেক গুন্ডা আছে। তাদের দিয়ে তোমায় মার খাওয়াব।’’ শুনে সবার সে কী হাসি। অনেক দিন পর্যন্ত তনুদাও এই নিয়ে আমায় কম খেপিয়েছেন নাকি! খালি বলতেন, ‘‘দেবশ্রী আর এক বার বল! তুই যেন আমায় কী করবি বলেছিলি? গুন্ডা দিয়ে মার খাওয়াবি!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy