Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
webseries

অচিন তারে সুরের থ্রিলার বাঁধল ‘তানসেনের তানপুরা’

করোনা-লকডাউনের ত্রস্ত দিনযাপনে বাঙালির নেট-আড্ডায় বিনোদন চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে এখন তাদের নতুন ওয়েব সিরিজ ‘তানসেনের তানপুরা’।

বাংলা ধারাবাহিকের রোম্যান্টিক মুখ যে ঝকঝকে স্মার্ট গোয়েন্দা হিসেবেও মানানসই হতে পারেন, আলাপের চরিত্রে নজর কেড়ে তা বেশ বুঝিয়ে দিয়েছেন বিক্রম—নিজস্ব চিত্র

বাংলা ধারাবাহিকের রোম্যান্টিক মুখ যে ঝকঝকে স্মার্ট গোয়েন্দা হিসেবেও মানানসই হতে পারেন, আলাপের চরিত্রে নজর কেড়ে তা বেশ বুঝিয়ে দিয়েছেন বিক্রম—নিজস্ব চিত্র

পরমা দাশগুপ্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০২০ ১৩:১১
Share: Save:

অভিনয়ঃ বিক্রম চট্টোপাধ্যায়, রূপসা চট্টোপাধ্যায়, রজত গঙ্গোপাধ্যায়, জয়তী ভাটিয়া প্রমুখ

পরিচালনাঃ সৌমিক চট্টোপাধ্যায়

খোদ মিঞা তানসেনের তানপুরা!

তা কি যে সে লোকের হাতে শোভা পায়?

তাই বেশ কিছু হাত ঘুরে সে ঐশ্বর্য যখন নিজ গুণে অর্জন করে নিলেন সঙ্গীতগুরু কেদারনাথ মিশ্র, তা যে তিনি তাঁর সেরা শিষ্যের হাতেই তা তুলে দিতে চাইবেন, তাতে আর সন্দেহ কী!

আর তাই নিয়েই হইচই ফেলে দিয়েছে ‘হইচই’। করোনা-লকডাউনের ত্রস্ত দিনযাপনে বাঙালির নেট-আড্ডায় বিনোদন চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে এখন তাদের নতুন ওয়েব সিরিজ ‘তানসেনের তানপুরা’। প্রথম দফায় পাঁচটি পর্ব, দ্বিতীয় দফায় আরও পাঁচ পর্বের গোটা সিজনে গল্প অবশ্য শেষ করেনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সুতোয় বোনা, অথচ হাল্কা মেজাজের এই মিউজিক্যাল থ্রিলার। ঐতিহাসিক সেই তানসেনের তানপুরা ঠিক কোন শিষ্য বা শিষ্যাকে দিয়ে গেলেন তাঁদের গুরু, তা জানতে এখন অপেক্ষা পরের সিজনের। এবং টানটান গল্পে কিংবা রাগরাগিণীর সুরে মজে থাকা দর্শক তাই সটান দু’ভাগ- এক দল গল্পের ক্লাইম্যাক্সের জন্য হা পিত্যেশ, অন্য দল অপেক্ষার শর্তে বরং খানিক বিরক্ত।

তবে হিন্দুস্থানী ক্লাসিক্যালের সুর-তাল-ছন্দে ভর করে এগিয়ে চলা এই গল্পের হাত ধরে দর্শকের পরিচিতি হয়ে যায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দুনিয়ার সঙ্গে। জানা হয়ে যায় তার ইতিহাস, নানা খুঁটিনাটি, অজানা তথ্যের অজস্র মণিমুক্তো। সিরিজ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা একগুচ্ছ রাগধর্মী গানও নিঃসন্দেহে এই সিরিজের সম্পদ। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতকে থ্রিলারের প্রেক্ষাপটেই গড়ে তোলার ভাবনাটাও বেশ মন কাড়ে। গল্পের ভাঁজে ভাঁজে রাখা ভারতীয় রাগরাগিণীর ইতিহাস বা তথ্য একেবারে সঠিক কি না, কিংবা গানের সুর-তালে কোথাও ভুলভ্রান্তি আছে কি না, তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া পেজে চর্চা আছে, তর্কও। তবে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ব্যতিক্রমী প্রেক্ষাপট যে গানপাগল বাঙালির বেশ লাগে, ‘তানসেনের তানপুরা’র ঊর্ধ্বমুখী জনপ্রিয়তাই তার প্রমাণ।

আনন্দগড়ের সেই প্রাসাদে প্রতিষ্ঠিত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী মধুবন্তীই এখন ‘গুরুমা’। নিজস্ব চিত্র।

সবুজের গালচে মোড়া পাহাড়, অনাবিল নীল আকাশ, খোলা হাওয়া, টলটলে নদীতে ছবির মতো সাজানো আনন্দগড়ে প্রাসাদোপম এক বাড়ি। সে বাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি আর তানসেনের তানপুরা নিজের সঙ্গীতশিক্ষক কেদারনাথকে (রজত গঙ্গোপাধ্যায়) দিয়ে গিয়েছিলেন বংশধরহীন নবাব। শর্ত ছিল, সে তানপুরা নিজের যোগ্যতম শিষ্যের হাতেই তুলে দিয়ে যাবেন কেদার। তবে যদি নবাবের বংশের কেউ কখনও এসে তা দাবি করে, তবে তানপুরা আর বাড়ির অর্ধেক অংশ ফিরিয়ে দিতে হবে তাঁকে। তাঁর ছাত্রছাত্রীরা সকলেই তা জানত। ফলে অজ্ঞাত কোথাও লুকিয়ে রাখা, গুপ্তধন হয়ে ওঠা তানসেনের তানপুরা কে পাবে, তা নিয়ে জল্পনার অন্ত ছিল না। কেদারনাথের রহস্যমৃত্যুর পরে সে তানপুরার হদিস পায়নি কেউই। এমনকী, তাঁর নিজের সুযোগ্যা কন্যা তথা ছাত্রী মধুবন্তীও (জয়তী ভাটিয়া) নন।

আনন্দগড়ের সেই প্রাসাদে প্রতিষ্ঠিত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী মধুবন্তীই এখন ‘গুরুমা’। বাবার মতোই তাঁর অজস্র শিষ্য-শিষ্যা। আর পুরনো সব কিছুর সঙ্গেই জড়িয়ে থাকা, বাবার আমলের পরিচারক অনাদি এবং বাদ্যযন্ত্রের ব্যবসায়ী বাহাদুর। মেয়ে শ্রুতির (রূপসা চট্টোপাধ্যায়) সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে মধুবন্তীর কাছে তালিম নিতে কলকাতা থেকে সেই বাড়িতেই এসে উঠল অসামান্য গানের গলা, ভারতীয় সঙ্গীতে রীতিমতো চর্চা ও পড়াশোনা করা আলাপ মিত্র (বিক্রম চট্টোপাধ্যায়)। দাদু ও মায়ের ধারা বেয়ে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিপুল ভাণ্ডার অবশ্য একটুও টানে না শ্রুতিকে। খাঁটি দেশি রাগরাগিণীর ঐশ্বর্য থেকে সে সাড়ে দশ হাত দূরে, ধ্যানজ্ঞান জুড়ে পাশ্চাত্য সঙ্গীত। শ্রুতি-আলাপের কলেজের ব্যান্ড এ দিক-সে দিক ফাংশনে, ক্লাবে, কলেজ ফেস্টে গান গায়।

আরও পড়ুন: অভিনেতা শুভেন্দুর ছেলের অভিনেতা হওয়ার যন্ত্রণা হাড়েহাড়ে টের পেয়েছি, লিখলেন শাশ্বত

আনন্দগড়ের আকাশে-বাতাসে সুর। মধুবন্তী এবং নানা দিকে ছড়িয়ে থাকা প্রিয় ছাত্রছাত্রীদের গানে, যন্ত্রসঙ্গীতে ভারতীয় রাগ, বুড়ো ভিখারির গাওয়া টপ্পা, মন্দিরের সামনে কাওয়ালি গানের আসর-- সবটুকুতেই আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে কেদারনাথের উপস্থিতি এবং লুকোনো তানপুরার হদিস। সেখানেই গুরুমা-র কাছে তালিমের ফাঁকে আলাপের নিখুঁত গায়কী এক দিন খুলে দিল রহস্যের দরজা। জানা গেল, তানসেনী তানপুরা কে পাবে, তা ছাত্রছাত্রীদের দেওয়া উপহারে লুকোনো বার্তায় জানিয়ে দিয়ে গিয়েছেন কেদারনাথ। তবে তা জানতে হলে খুলতে হবে একের পর এক ধাঁধার পরত, একেবারে সঠিক ভাবে চিনতে এবং চর্চা করতে হবে রাগরাগিণী। কারণ তারই সুরে লুকিয়ে তানপুরা আর তার উত্তরাধিকারীর হদিস।

তারই সমাধানের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয় আলাপ। সঙ্গী হয় শ্রুতি। সূত্র খোঁজার সমান্তরালেই বাড়তে থাকে রহস্যের জট, খুলতে থাকে মুখোশ। গল্পের ভাঁজেই দর্শকের জানা হয়ে যায়, আলাপ স্রেফ গান শিখতে পৌঁছয়নি আনন্দগড়ে। বরং কারও নির্দেশে তানপুরা রহস্যের কিনারা করতেই তার ওই বাড়িতে পা রাখা।

বাংলা ধারাবাহিকের রোম্যান্টিক মুখ যে ঝকঝকে স্মার্ট গোয়েন্দা হিসেবেও মানানসই হতে পারেন, আলাপের চরিত্রে নজর কেড়ে তা বেশ বুঝিয়ে দিয়েছেন বিক্রম। খানিক আদুরে, ছেলেমানুষি বকবকানিতে মাতিয়ে রাখা, যুক্তির মারপ্যাঁচ কিংবা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া শ্রুতির ভূমিকায় রূপসাও অনবদ্য। পাশাপাশি, কেদারনাথের ভূমিকায় রজত কিংবা মধুবন্তীর ভূমিকায় হিন্দি ধারাবাহিকের পরিচিত মুখ জয়তী ভাটিয়া সঙ্গীতজ্ঞ এবং ব্যক্তিত্বময় অভিভাবকের মিশেলে জীবন্ত করে তুলেছেন নিজেদের চরিত্র। কেদারনাথের বিভিন্ন শিষ্য-শিষ্যা, অনাদি, বাহাদুর, ভিখারি-সহ প্রত্যেকটি পার্শ্বচরিত্রও আলাদা করে চোখে পড়ে সুজন মুখোপাধ্যায়, ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবেশ রায়চোধুরী, শুভাশিস মুখোপাধ্যায়ের মতো জনপ্রিয় মুখের অভিনয়ের বলিষ্ঠতায়। এবং অবশ্যই মন টানে গোটা গল্পে ছড়িয়ে থাকা একগুচ্ছ রাগধর্মী গান। শ্রীজাতর কথায়, জয় সরকারের সুরে জীমূত রায়, সোমলতা আচার্য, পিউ মুখোপাধ্যায়, সোহম চক্রবর্তী এবং বিশিষ্ট শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পীদের গাওয়া গানগুলোর রেশ থেকে যায় বেশ খানিকক্ষণ।

আরও পড়ুন: মিঠে পাতার পানে একটু জর্দা

তানপুরা শেষমেশ কার হাতে পৌঁছল, তা জানার সুযোগ ঘটেনি। তবে ইতিমধ্যে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মজে থাকা বাঙালি যে এ গল্পের প্রেমে পড়েছে, তা বলাই যায়। থ্রিলার বলতেই ইদানীং যে একাধিক স্তরে গাঁথা গল্পের বুনন, নিষ্ঠুরতার ছবি, টেনশন-ভয়-রহস্যের শিহরণ জাগানো ওয়েব সিরিজগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে, এ গল্পের মেজাজ তার চেয়ে অনেকটাই আলাদা। হাল্কা চালে বলা, সরলরেখায় চলা, চেনা ছকের এ রহস্য কাহিনি বরং ঘুরে বেড়ায় হিন্দুস্থানী সঙ্গীতের অলিগলিতে, মন ভরানো গানে, হাসি-মজার ফাঁকফোকরে। বর্তমান ও অতীতের ঘটনায় অনায়াস যাতায়াতে গল্প বলার ভঙ্গীও বেশ লাগে। গল্পের গতি অবশ্য তাতে এতটুকু টাল খায়নি। দ্রুত নয়, মন্থরও নয়, কাহিনি এগিয়েছে তার নিজস্ব ছন্দে। সৌজন্যে অবশ্যই পরিচালক সৌমিক চট্টোপাধ্যায় এবং চিত্র সম্পাদক মহম্মদ পিয়াসুদ্দিনের মুন্সিয়ানা। চোখ জুড়নো সিনেম্যাটগ্রাফিতে প্রশংসা প্রাপ্য প্রসেনজিৎ চৌধুরীরও।

খামতি যে একেবারে নেই, তেমনটা নয়। প্রথম পর্বে গল্পের ভূমিকার অংশ খানিক লম্বা হয়ে গিয়েছে। এক-আধটা পর্ব আরও একটু টানটান হতেই পারত। রাগরাগিণীর তথ্যে, ধাঁধার ছত্রে লুকোনো সূত্র বেশ জটিলতাহীন ভাবেই খাপে খাপে মিলে যায়। সে সব আরও খানিক দুর্বোধ্য হলে হয়তো থ্রিলার হিসেবে এ গল্পের বুনোট আর একটু শক্তিশালী হতে পারত। তবে হ্যাঁ, মিউজিক্যাল থ্রিলার হিসেবে গানই যে বাড়তি গুরুত্ব পাবে, তাতে আশ্চর্যেরও নেই তেমন। তানসেনের গল্প শোনাতে কার্টুনের ব্যবহারও একটু যেন খাপছাড়া। গুরুমা-র কাছে তালিম নেওয়ার এক দৃশ্যে আলাপের রাগেড জিনসের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে থাকা অনেকখানি হাঁটু শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মেজাজের সঙ্গে খানিক বেমানানও লাগে বটে!

তবে হ্যাঁ, পাঁচটা পর্ব দেখার পরে দিন কয়েকের বিরতি কেটে গিয়েছিল গল্প জানার কৌতুহলে। কিন্তু এক সিজনে শেষ না হওয়া গল্পের রহস্যভেদের জন্য পরের সিজন পর্যন্ত অপেক্ষা দর্শকদের ধরে রাখতে পারবে কি না, সেই পরীক্ষাতেই এখন বসতে চলেছে 'তানসেনের তানপুরা'।

অন্য বিষয়গুলি:

webseries Tansener Tanpura Review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy