রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অর্ক গঙ্গোপাধ্যায় ।
পল্লবী দে, বিদিশা দে মজুমদার, মঞ্জুষা নিয়োগী— তিন তরুণীর আত্মহনন নাকি কষ্ট দেয়নি রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়কে! সে কথা তিনি নিজেই সোচ্চারে সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন। দায়ী করেছেন এই প্রজন্মের অস্থিরতাকে, অনুভূতিহীনতাকে, লড়াই না করার মানসিকতা এবং মা-বাবার থেকে দূরে সরে যাওয়াকে। রুপোলি পর্দার নায়িকা কষ্ট পাচ্ছেন মৃতাদের মা-বাবার জন্য। যাঁরা অনেক কষ্টে সন্তানদের বড় করেছিলেন। তাঁদেরকেই সন্তানেরা আজ হাজার প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে!
রচনার এই বক্তব্য আমার মনে কিছু প্রশ্ন জাগিয়েছে। তিনি কি এই প্রজন্মের উপরে গবেষণা করে এসে কথাগুলো বলেছেন? নাকি ওঁর কাছে কোনও পরিসংখ্যান আছে? আসলে উনি যা বলেছেন, তেমনটা বলে দেওয়া খুব সহজ। এই ধরনের বক্তব্য সাধারণত শিক্ষার অভাব থেকেই আসে। আমরা একটা প্রজন্মের উপরে যে কোনও কিছুর দায় চাপিয়ে দিই। আজীবন শহরতলি বা মফস্সলের ছেলে কলকাতায় একা একাই আসতেন। মা-বাবাকে সঙ্গে নিয়ে আসতেন না। তাই বলে কি তাঁর সব কিছু নিয়ে প্রশ্ন তোলার অধিকার জন্মায়? আগে কি এমনটা হত?
কিছু বলার আগে দেখা উচিত, আমরা কাকে নিয়ে কথা বলছি? প্রাপ্তবয়স্ককে নিয়ে? না নাবালককে নিয়ে? আমাদের দেশের একটি আইনি ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের দেশের একটি সংবিধানও রয়েছে। সবার আগে তাকে সম্মান জানাতে হবে। আমাদের সংবিধান এক জন প্রাপ্তবয়স্ককে তাঁর মতো করে জীবনযাপনের স্বাধীনতা দেয়। সহবাস আমাদের দেশে বেআইনি নয়। আরও মনে রাখতে হবে, আমরা আফগানিস্তানে থাকি না। এ সব ঘিরে আমাদের দেশে সেই দেশের মতো বিশেষ কোনও আইনি ব্যবস্থাও চালু নেই। অর্থাৎ, নেশা, সহবাস বৈধ হলে তাকে নিয়ে নীতিপুলিশিও বোধহয় সাজে না। আজকের প্রজন্মের দিকে আঙুল তোলার আগে তাই দু’বার ভাবতে হবে। হাতের মুঠোয় তথ্য রাখতে হবে, আজকের প্রজন্ম কী এমন নতুন করছেন, যা আগের প্রজন্ম করতেন না!
কোনও প্রজন্মকে এ ভাবেও দায়ী করা যায় না। রচনার ছেলে সম্পর্কে মা হিসেবে তিনি মন্তব্য করতেই পারেন। কিন্তু অন্যের বিষয়ে না জেনে তাঁকে নিয়ে কোনও মন্তব্য কখনওই নয়। মানুষ আত্মহত্যা করেন নানা কারণে। চিকিৎসা শাস্ত্র মতে, অবসাদ তার মধ্যে একটি কারণ। কেউ অত্যধিক পার্টি করলে আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে যান, এটা রচনাকে কে বলেছেন? এর কি কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে? নেই। আরও একটি কারণ, আবেগপ্রবণতা। সেটাও কি যৌনতা, মা-বাবার প্রতি অবাধ্যতা থেকে বাড়ে? কোনও চিকিৎসক বা মনোবিদ আজ পর্যন্ত এই ধরনের বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন? এ ক্ষেত্রেও আবারও সেই ‘অশিক্ষা’ শব্দটিই চলে আসছে।
যে সমস্ত দেশ এখনও মনোরোগ সম্পর্কে ভাল করে কিছু জানে না, সে দেশের মানুষেরাই এই ধরনের অসংবেদনশীল কথা বলতে পারেন। নিজের নীতিকথা অন্যের উপরে চাপিয়ে দিতে পারেন। এই ধরনের কথাবার্তা তাই আমার চোখে ভীষণ ‘সস্তা’! আমি পল্লবীকে চিনতাম। মৃত্যুর দু’দিন আগে আমায় বার্তা পাঠিয়েছিলেন। তার মানে এই নয়, আমি ওঁকে নিয়ে এখন যা খুশি তাই বলব। আমি এঁদের মৃত্যু নিয়ে বলার কে? তবে এটুকু বুঝতে পারছি, মশলাদার কিছু ঘটলেই মানুষের নীতিজ্ঞান জেগে ওঠে। পল্লবী এক পুরুষের সঙ্গে থাকতেন। এই জিনিসটি চট করে মেনে নেওয়া যায় না, তাই খুব সহজেই দূর ছাই করে দেওয়া যায়! মানুষ সেই পশু শিকারের যুগ থেকে লড়াই করেই নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। আগেও নানা কারণে অজস্র মানুষ আত্মহননের পথে বেছে নিয়েছে। বরং এখন আমাদের দেশে আগের তুলনায় আত্মহত্যার পরিমাণ অনেকটাই কমেছে। তার পরেও আত্মহত্যাপ্রবণ প্রথম ১০টি দেশের মধ্যে রয়েছে ভারত।
তবু পরিস্থিতি যে ক্রমশ উন্নত হচ্ছে, সেই খবর কি রচনা রাখেন? তার পরেও তিনি এই প্রজন্মকে কী করে এ ভাবে দায়ী করতে পারলেন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy