Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
Article 15

রামরাজ্যের সেই শম্বুক নিধন আজও চলছে, ফের দেখাল ‘আর্টিকল ১৫’

এই আলো-আঁধারির রূপক, ছবি এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অতি অবশ্যই মনে করিয়ে দেবে সেই শূদ্র শম্বুকের কথা, বেদাধ্যয়নের ‘অপরাধে’ রাজা রাম যাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। সমাজের অন্ধকারে বাস করে আলোর দিকে চেয়ে থাকা সেই শম্বুকরা আজও, এই আধুনিক, অত্যাধুনিক মহাভারতেও যে আছেন, এ ছবি আর একবার সেটা তুলে ধরল।

দলিত হওয়ার মাসুল, ‘আর্টিকল ১৫’ ছবির দৃশ্য

দলিত হওয়ার মাসুল, ‘আর্টিকল ১৫’ ছবির দৃশ্য

অর্পিতা রায়চৌধুরী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৯ ১৯:৫৩
Share: Save:

শ্রীরামচন্দ্র যে দিন ফিরছিলেন বনবাস থেকে, গোটা অযোধ্যা সেজেছিল আলোর মালায়। শুধু একটি গ্রাম ডুবে ছিল অন্ধকারে। প্রথমে অবশ্য আলো জ্বেলেছিলেন সে গ্রামের মানুষও। কিন্তু আচমকা আঁধিতে সব প্রদীপ নিভে যায়। নিকষ অন্ধকারে গ্রামবাসীদের চোখে আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে অযোধ্যার আলোকিত প্রাসাদ। তাই তাঁরা নতুন করে আলো জ্বালালেন না। যাতে চোখে থেকে যায় উদ্ভাসিত রাজপ্রাসাদই। এই লোককথা দিয়েই শুরু হচ্ছে ‘আর্টিকল ১৫’। বর্তমানে আলোচনার শীর্ষে থাকা হিন্দি ছবি।

রাম এ দেশে সেই কোন কাল থেকে বিপুল জনপ্রিয় মহাকাব্যিক বা লোককাব্যিক চরিত্র। সেই রামের অযোধ্যাপ্রবেশের গল্প পরিচালক শুনিয়েছেন পুলিশে কর্মরত এক দলিত চরিত্রের মুখ দিয়ে। এ গল্প তাঁর পরিবারেই ছোটবেলা থেকে শোনা। এই আলো-আঁধারির রূপক, ছবি এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অতি অবশ্যই মনে করিয়ে দেবে সেই শূদ্র শম্বুকের কথা, বেদাধ্যয়নের ‘অপরাধে’ রাজা রাম যাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। সমাজের অন্ধকারে বাস করে আলোর দিকে চেয়ে থাকা সেই শম্বুকরা আজও, এই আধুনিক, অত্যাধুনিক মহাভারতেও যে আছেন, এ ছবি আর একবার সেটা তুলে ধরল।

ভারতীয় সংবিধানের পঞ্চদশ অনুচ্ছেদ বলছে— ধর্ম, বর্ণ, জাতপাত, লিঙ্গ, জন্মস্থানের নিরিখে কোনও বৈষম্য থাকবে না স্বাধীন ভারতে। কিন্তু স্বাধীনতার সাত দশক পরেও এই ভেদাভেদের জটিলতা পিছনদিকে টেনে রেখেছে দেশকে। সেই অবনমন ছবির পরতে পরতে। নামকরণেই মোক্ষম চপেটাঘাত। চিত্রনাট্য যত এগোতে থাকে, তত সেই চপেটাঘাতের তীব্রতা বাড়তে থাকে।

আরও পড়ুন : মডেল, নাচে দক্ষ, দক্ষিণী ছবির সুপারস্টার এই নায়িকা চমকে দিলেন ‘আর্টিকল ১৫’-এ

আরও পড়ুন: ‘প্রেমিকাকে চড় মারার অধিকার না থাকলে সেটা প্রেমই নয়’! নয়া বিতর্কে ‘কবীর সিং’ পরিচালক

এই আঘাত পুরনো। চার বছর আগে উত্তরপ্রদেশের বদায়ুঁতে উদ্ধার হয়েছিল দুই দলিত কিশোরীর ঝুলন্ত দেহ। দেশের প্রায় সব সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম এসেছিল। বাড়ির লোক জানিয়েছিল, বাড়িতে শৌচাগার না থাকায় মাঠে গিয়েছিল তারা। আর ফেরেনি। ময়নাতদন্ত বলেছিল, গণধর্ষণের পরে তাদের জীবন্ত অবস্থায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে সিবিআই নাকচ করে দেয় ধর্ষণ-সম্ভাবনা। প্রেমঘটিত জটিলতার তকমা দিয়ে নজর ঘুরিয়ে দেওয়া হয় আত্মহত্যার দিকে। যদিও দেশজুড়ে তীব্র প্রতিবাদের ঝড়ে বয়ান পাল্টাতে বাধ্য হয় সিবিআই। নতুন করে পেশ করা হয় চার্জশিট। ঘটনাপ্রবাহের সেই চাপানউতোর নিয়েই পরিচালক অনুভব সিনহার ছবি ‘আর্টিকল ১৫’।

ছবিতে আইপিএস অফিসার আয়ান রঞ্জনের পানিশমেন্ট পোস্টিং হয় প্রত্যন্ত লালগাঁওতে। কাজ শুরু করেন এমন এক পরিবেশে, যেখানে শূদ্রদের ছায়াও মাড়ানো হয় না। চর্মজাত পণ্য ব্যবহার করা যায়, কিন্তু চর্মকারদের আসতে দেওয়া যায় না নিজেদের ত্রিসীমানায়। সংবিধানে যা-ই লেখা থাকুক, ‘দেশ’ চলবে পুরনো সিস্টেমেই। সেই ঘুণধরা সিস্টেমের বিরুদ্ধেই রুখে দাঁড়ান আয়ান। প্রথমে সিস্টেমে থেকে, নিজের ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করে। কিন্তু তার মাসুল স্বরূপ এল সাসপেন্ডের কোপ। তাতেও কর্তব্যচ্যুত হলেন না । পাখির চোখ বিদ্ধ করেই থামলেন শেষ অবধি। উদ্ধার করলেন ধর্ষকদের হাত থেকে বাঁচতে লুকিয়ে থাকা মৃতপ্রায় তৃতীয় কিশোরীকে। এ ছবিতে তিন কিশোরীর দুজনের মৃ্ত্যু দেখিয়েছেন পরিচালক।

আয়ুষ্মান খুরানার অভিনয় ‘আর্টিকল ১৫’ ছবির বড় সম্পদ

মৃত্যুর কারণ গণধর্ষণ। কিন্তু পুলিশের একাংশ আর সমাজের উচ্চবর্ণ ষড়যন্ত্র মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যায়। যাতে পরিবারকেই দায়ী করা যায়। যাতে প্রমাণ করা যায় সম্মান রক্ষার্থে খুন। এখানেই চ্যালেঞ্জ আয়ানের। তাঁর রোখ চেপে যায়। কী ভাবে তিনি দুই কিশোরীর হত্যার আসল কারণ প্রকাশ করবেন? কী করে উদ্ধার করবেন তৃতীয় কিশোরীকে? সেই নিয়েই এগোয় টানটান ছবি।

চিত্রনাট্যের প্রতি কোনায় দগদগ করছে দলিত পেষণের ক্ষত। গোবলয়ের এক কোনায় লালগাঁওতে দলিতকন্যার হারিয়ে যাওয়া কোনও ‘খবর’ নয়। ওরা হারিয়ে যায়। কেউ ফেরে। কেউ ফেরে না। তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই পুলিশের। সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে তদন্তে চালিয়ে যান আইপিএস আয়ান। একে একে বেরিয়ে আসে কর্কশ সত্যি। স্কুলবাসে ধর্ষিত হয় কিশোরীরা। স্কুলের তালাবন্ধ ঘর থেকে পাওয়া যায় তাদের মুখ হাত পা বেঁধে রাখতে ব্যবহৃত দড়ি। এ ভাবেই তাদের ‘অওকত’ বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। আয়ানের উল্টো দিকে বসে একটুও না ভেবে বলে ঠিকাদার। তাদের ‘অপরাধ’? হাড়ভাঙা খাটুনির বিনিময়ে ঠিকাদারের কাছে চেয়েছিল বাড়তি তিন টাকা মজুরি। না মেলায় কাজে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। এত স্পর্ধা! ‘অওকত’ বোঝাতে দলিত কিশোরীদের ধর্ষণ করে ঠিকাদার, এক পুলিশ অফিসার এবং এক কনস্টেবল।

অপরাধের প্রমাণের সন্ধানে তন্নতন্ন করে খোঁজা হয় এক পরিত্যক্ত তালাও। শূকরদের বিচরণ ছিল বলে তা উচ্চবর্ণের কাছে তীব্র ঘেন্নার। সেই তালাও-এর প্রতি ইঞ্চি খুঁজে চললেন আইপিএস। হাঁটু অবধি পাঁকজলে নামতে বাধ্য করলেন বাকি পুলিশকেও। সামাজিক নিয়মের উলটপুরাণে পঙ্কিল হয় ‘ভদ্দরলোক’রা। ঠিক যে ভাবে সমাজের উচ্চবর্ণকে শ্বেতশুভ্র রাখতে নিজেদের কলুষিত করে চলেন দলিতরা।

সমাজের নির্দিষ্ট একটি শ্রেণিকে এ ভাবেই কলুষিত করে রাখার প্রথা সুদীর্ঘকালীন। যে ‘নোংরা কাজ’ তথাকথিত উচ্চবর্ণীরা করতে চায় না, সেটাই বরাদ্দ অন্ত্যজদের জন্য। কখনও তারা ‘হরিজন’, কখনও ‘বহুজন’, কিন্তু কোনওদিন ‘জন’ হয়ে উঠতে পারে না। ‘জনগণমন’-তে নিজেদের জায়গা খুঁজে চলেছে তারা, এখনও। ঠিক এই কথাগুলোই বলেছেন এ ছবির চরিত্ররা।

ছবিতে বলিষ্ঠ অভিনয় সায়নী গুপ্তর

আইপিএস অফিসার হয়ে আয়ুষ্মান খুরানার ভূমিকাও যেন সমাজের লুকিয়ে থাকা বিবেকের মতো। যার সঠিক সময়ে জেগে ওঠা পাল্টে দিতে পারে অনেক কিছু। এই ছবি হয়তো রাতারাতি সামাজিক খোলনলচে পাল্টাতে পারবে না। কিন্তু প্রশ্ন তুলবেই। আমরা একদিকে সংরক্ষণ করব, সংরক্ষণের প্রতিবাদে-বিপক্ষে সোচ্চার হব, কিন্তু একইসঙ্গে সমাজে থাকবে ‘দলিতরা’। যাদের বর্ণহিন্দুরা বলে যাবে, ‘মা নিষাদ!’ তবে কি রাজনীতিকরাই বাঁচিয়ে রাখেন এই বৈপরীত্য? ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থে?

বাস্তবে আমরা দলিতদের কাজের মানুষ করে রেখেছি। কাছের মানুষ করিনি। ছবিতে সেটাও করে দেখালেন আয়ান। আন্ডারগ্রাউন্ড বিদ্রোহী দলিত নেতাকে গ্রেফতার নয়। বরং সহমর্মিতা দিয়ে তাঁকে কাছে আনলেন। কাজে ফেরালেন ধর্মঘটী দলিতদের। আর ফেরালেন নিখোঁজ মৃতপ্রায় কিশোরীকে। শূকরতাল পেরিয়ে ঘন জঙ্গলে বেচারি লুকিয়ে ছিল পরিত্যক্ত পাম্প হাউজের পাইপে। তাঁকে অ্যাম্বুল্যান্সে তুলে দিয়ে খেতে বসলেন ইউরোপ ফেরত উচ্চশিক্ষিত আইপিএস। পথের ধারে, দলিত মহিলার দোকানের তৈরি খাবার খেলেন চেটেপুটে, বাকি দলিতদের সঙ্গে মিলেমিশে।

ছবিতে দলিতদের সঙ্গে খেয়েছিলেন মঠের জনৈক মহন্তও। কিন্তু সে ছিল ভোটের প্রচারের তুরুপের তাস। সাংবাদিকরা আসার আগে তাঁর জন্য চলে এসেছিল আলাদা বাসন, আলাদা খাবার। হিন্দুদের বর্ণসাম্যের কথা বলে ভোটে তিনি জিতলেন বটে। কিন্তু দলিত জনমানস জয় করলেন সাহেবি আদবকায়দার আইপিএস-ই।

পুরুষতন্ত্রের ডঙ্কা বাজানো ছবি ‘কবীর সিং’-এর মতো দুশো কোটির ক্লাবের ধারেকাছে হয়তো যেতে পারবে না ‘আর্টিকল ১৫’। কিন্তু দর্শককে ঝাঁকুনি দিতে পারবে। স্মার্টফোনে বুঁদ শহুরে দর্শকও অনুভব করতে পারবে বদায়ুঁতে ঝুলন্ত কিশোরীর রক্তবিন্দু। শুনতে পাবে গুজরাতের উনা-য় গোরক্ষকদের হাতে প্রহৃতদের কান্না।

সবথেকে বড় কথা, এই ছবি মনে করিয়ে দিল ভারতীয় সংবিধানে আর্টিকল ১৫ বলে একটা অনুচ্ছেদ আছে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy