Advertisement
১৫ জানুয়ারি ২০২৫
Maha Kumbh Mela 2025

মহাকুম্ভের প্রান্তরে বেজে চলেছে মহা ভারতের সুর

সামনে মহাকুম্ভের স্নানে চলেছেন নাগা সন্ন্যাসীরা। মকর সংক্রান্তির সেই পুণ্যস্নানে প্রথম অধিকার যে তাঁদেরই। প্রতিটি আখড়া থেকেই এক একটি শোভাযাত্রা এগিয়ে চলেছে স্নানের পথ ধরে।

প্রয়াগরাজে মহাকুম্ভে সংক্রান্তির স্নানের সময়ে। মঙ্গলবার।

প্রয়াগরাজে মহাকুম্ভে সংক্রান্তির স্নানের সময়ে। মঙ্গলবার। ছবি: পিটিআই।

সুমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ ০৭:১৪
Share: Save:

আকাশ তখনও ফর্সা হতে শুরু করেনি। ভোর চারটেয় স্নান সেরে, সেই অন্ধকার আর শিরশিরে বাতাস গায়ে মেখে আস্তানায় ফিরছি। আচমকাই মুখোমুখি ভিড়ের স্রোত। প্রয়াগরাজের বিস্তীর্ণ প্রান্তরে দাঁড়িয়ে তখনই যেন স্পর্শ করল এক অভূতপূর্ব অনুভূতি— ধর্ম, পুণ্যের ভাবনা ছাড়িয়ে আদিগন্ত এক বিস্ময়ের সঙ্গে পরিচয় হল মঙ্গলবার।

সামনে মহাকুম্ভের স্নানে চলেছেন নাগা সন্ন্যাসীরা। মকর সংক্রান্তির সেই পুণ্যস্নানে প্রথম অধিকার যে তাঁদেরই। প্রতিটি আখড়া থেকেই এক একটি শোভাযাত্রা এগিয়ে চলেছে স্নানের পথ ধরে। একেবারে প্রথমে নাগা সন্ন্যাসীরা, তার পর কৌপীনধারী, গেরুয়াধারীরা। সকলে চলেছেন একে একে। সেই সারিতেই ধীর পায়ে চলেছেন নাগা সন্ন্যাসিনীরাও। দেবীকালিকার মতো মুণ্ডমালাতাঁদের গলায় নেই। চোখের সামনে মুখোমুখি মিছরিগুঁড়োর মতো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল সকালের আলো।

১৪৪ বছর অন্তর নাকি মহাকুম্ভ হয়! ঠিক তখনই প্রয়াগে স্নান করলে পুণ্য অর্জন হয়। ত্রিবেণী-সঙ্গমের সেই স্নানে কতটা পুণ্য হয় জানা নেই। তবে এই যে ভোরের আলো, তার স্নিগ্ধতা তো বটেই গত কয়েক দিন ধরেই এ তল্লাট জুড়ে যা যা দেখলাম তাতে চোখ সার্থক, মনও তৃপ্ত— এ কথা বলতে হবেই। দু’চোখ যে দিকে যায়, দৃষ্টিতে এ মাটি, আকাশ, বাতাস যত অনুভব করা যায় তাতে চিরন্তন ভারতই স্পষ্ট হয়ে চলেছে প্রতিটি ক্ষণ।

কুম্ভ পরিচিত অথচ তা এক মহাবিস্ময়। স্নানে এসে পথের ধারে ধুনি জ্বালিয়ে বসে থাকা নাগা সন্ন্যাসীরাই এই কুম্ভমেলার গোটা চিত্র নয়। একদিকে যেমন এই কটিবস্ত্র জড়ানো সন্ন্যাসীরা আছেন, তেমনি সময়ও ছুঁয়েছে, বদলেছে এই প্রাচীন মেলাকে। সে ছোঁয়াও লেগেছে এ ‘ভারতে’। ছাইমাখা সন্ন্যাসীর পাশেই জলের বোতল বিক্রি করে ‘কিউ আর কোড’ এগিয়ে দিচ্ছেন একেবারে সাধারণ ব্যাপারী। বলছেন, স্ক্যান করে দাম মিটিয়ে দিতে। দেহাত থেকে মাথায় ‘বোড়ি-বিস্তর’ নিয়ে ঘুরতে থাকা প্রৌঢ়, এক কানে হিরের দুল পরা জেনারেশন জেড, মিকি-মাউস আঁকা টিশার্ট পরনে তরুণী এগিয়ে নিয়ে চলেছেন এই ভারতের এক অর্থবহ ছবি। নিজেদের বিলাসবহুল এসইউভি চড়ে আসা ধনী আর চপ্পলহীন ফাঁটা পায়ে হেঁটে আসা দরিদ্র পাশাপাশি দাঁড়িয়ে এই সূর্যের আলোয় গা ভিজিয়েছেন। পুণ্যের আশায়, শান্তির প্রার্থনায়। একটানা দীর্ঘ সময় এই রকম সব দৃশ্যই ভাবিয়ে তুলছিল, কোন সে মন্ত্র যার বলে সকলেই মিলে চলেছেন এক ধারায়! বেলা বাড়তে তীক্ষ্ণ রোদে চকচক করে উঠেছে এই গর্বের সহাবস্থান। পোশাক, ভাষা, খাদ্যাভ্যাসের ফারাকও চোখে পড়ছে প্রতি মুহূর্তে। চেহারা দেখে যে মুহূর্তে ভৌগোলিক দূরত্ব আঁচ করার চেষ্টা করেছি, সামনে, পিছনে, বাঁয়ে, ডানে এগিয়ে চলা সহযাত্রী কোনও না কোনও প্রমাণ হাজির করে জানান দিয়েছেন, সে ফারাক মিলিয়ে যায় এক অভিন্ন ভারত-আত্মায়।

এ দেশে ভিআইপি অনেক। তাই ভিআইপি তাঁবুও অনেক। তার থেকে একটু দূরে খোলা আকাশের নীচে আট ডিগ্রি সেলসিয়াসে রাত কাটাচ্ছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। এই ফারাক যেমন এক ‘ভারত’ আবার কাকভোর থেকে তাঁদের পাশাপাশি অবস্থানও আর এক ভারত। কুম্ভমেলা তা-ই মনে করিয়ে দিচ্ছে থেকে থেকে। শত বিরোধ ভুলে একাত্মায়, শত স্রোত ছুঁয়ে যায় এক ঘাট। হাজার সুরে বেজে ওঠা শঙ্খধ্বনি, বাঁশি আর খালি গলার উদ্দাত্ত সঙ্গীত মাখামাখি হয়ে সেই ভারতের অভিন্নতাকে মিলিয়ে দিচ্ছে আকাশে, বাতাসে। দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যার সাজে তার টান তীব্র থেকে তীব্রতরহয়ে উঠছে।

এই একাত্মতাই তো আমার ভারত, আমাদের ভারত। বরফ-ঠান্ডা জলে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল, এই আয়োজনই এ দেশে মানুষের বেশে দেবতা আনতে পারে। সমুদ্র মন্থনের পরে অমৃতকুম্ভ থেকে যে চার ফোঁটা ছলকে পড়েছিল, মনে হল, প্রসাদ হিসেবে আঁজলায় তা-ই ঘুরছে এই ভিড়ে। বিস্ময়কে বাস্তবে নিয়ে এল শৈশবে শেখা সেই মন্ত্র, অস্ফুটে আরও একবার বেরিয়ে এল— ‘হে মোর চিত্ত, পুণ্য তীর্থে জাগো রে ধীরে...।’

অন্য বিষয়গুলি:

Maha Kumbh Mela 2025 Maha Kumbha 2025 Kumbh Mela 2025
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy