Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Satyajit Ray

একাই ১০০ নন, বরং ‘সত্যজিৎ ৩৬০’

কলকাতা শহরের বুকে বসে এক চলচ্চিত্রকার কেন সব কিছু নিজে করলেন? আর কী ভাবেই বা করলেন?

সত্যজিৎ রায়

সত্যজিৎ রায়

বৌদ্ধায়ন মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ মে ২০২১ ০১:৫৪
Share: Save:

প্রযুক্তির সঙ্গে সঙ্গে সিনেমার গণতন্ত্রীকরণ হয়েছে। সহজ হয়েছে সিনেমা বানানো । কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে চলচ্চিত্র নির্মাণের মোটামুটি সব বিভাগেই ভুল করার সুযোগও বেড়েছে, যাকে ইংরেজিতে বলে 'স্কোপ অব এররস'। আজকাল হাতে মোবাইল ফোন থাকায় সবাই ফিল্মমেকার। এ দিকে ডিজিটাল যুগের নির্মাতাদের কথায় কথায় ‘টেক’এর পর ‘টেক’। ‘অ্যাকশন’ আর ‘কাট’ বলার ডিসিপ্লিন, আজ প্রচলিত থেকেও বিলুপ্তপ্রায়। সব ‘শট’ সব অ্যাঙ্গল থেকে শ্যুট করে এডিটে মিলিয়ে দেওয়াই যেন আধুনিক সময়ের রীতি। এ সব কারণে সিনেমার বিবর্তনের ইতিহাসকারদের মতে, 'এক্সপেরিমেন্ট’-এর সুবিধে বাড়লেও, একজন সৃষ্টিকর্তার ‘ভিসন’ খর্ব হয়েছে ক্রমশ। না দেখে না শুনেও সেটা দেখে ফেলা বা ভেবে ফেলার অভ্যাস কমেছে। দুর্বল হয়েছে দূরদৃষ্টি। কমেছে নিখুঁত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা।

কিন্তু যে সময়ে দাঁড়িয়ে সত্যজিৎ রায় কাজ করেছেন, সেই সময়টা অন্য রকম ছিল। খুঁতখুঁতেপনা ছাড়া, দূরদৃষ্টি ছাড়া ছবি বানানো ছিল অসম্ভব। হাল সময়ের এত বৈভব ছিল না সে কালে। 'স্কোপ অব এররস'-এর কোনও জায়গা ছিল না সেই সময়ের কলাকৌশলে। প্রোডাকশন- বাজেট- টেকনোলজি, কোনও দিক থেকেই নয়। সীমিত সাধ্যে, সংস্থানে ছবি বানাতে হত। আর সেই কারণেই, ওঁর মত ‘ভিসনারি’ একজন মানুষকে প্রায় সব দায়িত্ব পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ ভাবে তুলে নিতে হয়েছিল নিজের কাঁধে। গল্প লিখেছেন, চিত্রনাট্য রচনা করেছেন, সংলাপ লিখেছেন, সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন, গান লিখেছেন, এমনকি পোস্টার ডিজাইন ও স্টোরিবোর্ডিং পর্যন্ত করেছেন নিজে হাতে। এর সঙ্গে কাস্টিং করেছেন, পোশাক পরিকল্পনা করেছেন এবং সর্বোপরি পরিচালনা করেছেন।

কিন্তু কেন করলেন এত কিছু একা হাতে?

হলিউড বা টলিউড তো এটা শেখায়নি! ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে অ্যাসেম্বলি লাইনে ফিল্ম তৈরি হয়েছে। তাবড় তাবড় ব্যক্তি এসে নিজের বিভাগ সামলেছেন। সেখানে কলকাতা শহরের বুকে বসে এক চলচ্চিত্রকার কেন সব কিছু নিজে করলেন? আর কী ভাবেই বা করলেন?

যেমন সঙ্গীত। রবিশঙ্কর ('পথের পাঁচালী', 'অপরাজিত', 'অপুর সংসার', 'পরশ পাথর'), বিলায়েত খাঁ ('জলসাঘর') ও আলি আকবর খাঁ ('দেবী')- ৩ প্রবাদপ্রতিম শিল্পী, ওঁর প্রথম ৩ সঙ্গীত পরিচালক। কিন্তু তার পর জীবনে আর কখনও অন্য কাউকে সঙ্গীতের দায়িত্ব দেননি। নিজের সঙ্গীত পরিচালনায় প্রথম ছবি 'তিন কন্যা'। সেই শুরু। এর পর জীবনের শেষ ছবি পর্যন্ত সব ছবিতে নিজেই সঙ্গীত সৃষ্টি করেছেন।

কিন্তু কেন?

ভারতবর্ষে তো সঙ্গীত প্রতিভার অভাব ছিল না! তা সত্ত্বেও কেন গানের দায়িত্ব নিলেন? কেন আর কোনও দিন পেশাদার সঙ্গীত পরিচালকদের ব্যবহার করলেন না? কারণটা বোধ হয় সঙ্ঘাত, নিজস্ব সঙ্গীত চেতনার সঙ্গে সঙ্ঘাত। ‘পিউরিটান’ সঙ্গীতশিল্পীরা নিজেদের সঙ্গীত নিয়ে অত্যন্ত স্পর্শকাতর হয়ে থাকেন। তার উপরে যদি সঙ্গীত ভাবনা বা সাজেশন আসে একজন চলচ্চিত্রকারের থেকে, যিনি প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে সঙ্গীতে 'শিক্ষিত' বা 'দীক্ষিত' নন, তা হলে তাঁকে স্বীকৃতি দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এটা আমি আমার কর্মজীবনেও বহু বার দেখেছি। কিন্তু সিনেমার সঙ্গীত তো ‘বিশুদ্ধ’ সঙ্গীত নয়-- এটা একটা অনুষঙ্গ। তাকে সেই ছবির পরিমণ্ডলে দেখতে হবে। তাই অনেক ক্ষেত্রে ছবির রিদম, বিট, দৃশ্যের নাটকীয় উপাদান-- এগুলোই প্রধান হয়ে ওঠে, সঙ্গীতের ভূমিকা হয় গৌণ। সেটা চলচ্চিত্রকার বোঝেন। কিন্তু ‘বিশুদ্ধ সঙ্গীতকারদের' পক্ষে এটা মেনে নেওয়া কঠিন। আমার ধারণা, সত্যজিৎ রায়ের ক্ষেত্রে এর অন্যথা হয়নি। দিকপাল সঙ্গীত পরিচালকরা 'পরিচালিত হওয়া' পছন্দ করেননি কোনও কোনও ক্ষেত্রে। তারই ফলশ্রুতি ওঁর সঙ্গীত পরিচালক হয়ে ওঠা। পরবর্তীকালে নিজের ছবি ছাড়াও সত্যজিৎ রায় সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন অন্যদের ছবিতেও। নিত্যানন্দ দত্তর 'বাক্স বদল', জেমস আইভরির 'শেক্সপিয়ারওয়ালা', সন্দীপ রায়ের 'ফটিকচাঁদ' তার মধ্যে অন্যতম।

পরিচালক এবং সাহিত্যিক

পরিচালক এবং সাহিত্যিক

যেমন ইলাস্ট্রেশন, পোস্টার আর্ট ও স্টোরিবোর্ডিং। কলা ভবনে পেন্টিং শিক্ষা। এমন সব শিক্ষকদের সান্নিধ্যে আসা, যাঁরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে দিকপাল। নন্দলাল বসু। বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়। তার পর কলকাতার ডি জে কিমার-- তখনকার দিনের নাম করা বিজ্ঞাপন সংস্থা, সেখানে জুনিয়র ভিস্যুয়ালাইজার হিসেবে কর্মজীবন শুরু। ইলাস্ট্রেটর হিসেবে একাধিক ক্যাম্পেনে কাজ। কপি-ও লিখেছেন। তখনকার দিনের প্রচলিত পাশ্চাত্যের অনুকরণে হওয়া বিজ্ঞাপন সত্যজিতের ছোঁয়ায় ভারতীয় হয়। আর সেই ভারতীয় গেলেন লন্ডনে ডি জে কিমার-এর হেড অফিসে কাজ করতে ৩ মাসের জন্য। জানলা দরজাগুলো খুলল। শিল্প প্রদর্শনী, সংগ্রহশালা ঘুরে দেখার সুযোগ হল। সিনেমার পোস্টার শিল্প নিয়ে একটা ধারণা তৈরি হল। কিন্তু পাশ্চাত্যের অনুকরণ পছন্দ তো হলই না, কলা ভবনের শিক্ষা কাজে লাগালেন বরং। তাই তো পথের পাঁচালীর পোস্টারে আমরা আলপনা দেখি, ইলাস্ট্রেটিভ ডুডল দেখি। এবং কোন সময়ে দেখি? যখন সারা ভারতবর্ষে সিনেমা পোস্টারে শুধুই দিলীপ কুমার, রাজ কপূর, মধুবালা, উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেন প্রমুখের মুখ। খ্যাতনামী-বন্দনা। সত্যজিতের ইলাস্ট্রেটর ব্যাকগ্রাউন্ড কাজে লাগল সিনেমার টাইপোগ্রাফিতে, ওপেনিং ক্রেডিট ডিজাইনে। এই সম্মিলিত বোধ (সিনেমা, ফোটোগ্রাফি, ডিজাইন, টাইপোগ্রাফি) আর ক'জনই বা দেখাতে পারতেন?

যেমন সম্পাদনা। এক্ষেত্রে হিচকক সাহেবের সংযম সর্বজনবিদিত। শোনা যায়, শেষমেশ ফিল্মে যেখানে শট কাট হত, সেখান থেকে সম্পাদক মেরে কেটে বড় জোর দেড় ফিট পেতেন র-স্টক-এ। সত্যজিৎ রায়ও নাকি সেই রকমই ছিলেন। এডিট মাথায় থাকত, চিত্রনাট্য লেখার সময়েই যে রিদম তৈরি হত সেই অনুযায়ী এডিট করতেন। ‘কাট’ বলতেন এটা মাথায় রেখে যে, শেষমেশ ছবিতে কত পর্যন্ত শটটা থাকবে। সম্পাদক দুলাল দত্ত ছিলেন সারা জীবনের কর্মসঙ্গী। অম্ভব শ্রদ্ধা ছিল দুলালবাবুর প্রতি। তবুও সম্পাদনা নিজেই করতেন, কারণ দৃশ্যগ্রহণের যে ছন্দ ওঁর মাথায় খেলত, সেটা ছবির টাইমলাইনে অনুবাদ করার দায়িত্ব অন্য কাউকে দিতে চাননি বোধ হয়। দুলালবাবু বসতেন মেশিনে আর উনি দাঁড়াতেন পিছনে। রাশ চলতে থাকত আর মাঝে মধ্যে ভেসে আসত ওঁর কণ্ঠস্বর- ‘কাট!’ দুলাল বাবু কেটে শট জুড়তেন।

‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’-তে অভিনয় করতে আসেন স্যর রিচার্ড অ্যাটেনবরো। যিনি পরবর্তী কালে ‘গাঁধী’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। খুব কাছ থেকে সত্যজিৎ রায়কে দেখেন। ইংল্যান্ড ফিরে গিয়ে উনি লেখেন-- মানিকদার (উনি সত্যজিৎ রায়কে 'মানিকদা' বলে ডাকতেন) বিষয়ে সব থেকে চমকপ্রদ ব্যাপার হল তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের সেই সব কাজ একা করেন, যা সব সময় আলাদা আলাদা লোক করে থাকেন। তিনি চিত্রনাট্য লেখেন, সঙ্গীত পরিচালনা করেন, নির্দেশনা দেন, ক্যামেরা অপারেট করেন, সেটে লাইটিং কেমন হবে তারও অর্ধেক কৃতিত্ব ওঁর, এর পর নিজে ছবি এডিটও করেন-- অনেকটা চ্যাপলিনের মতো। নিজের ছবিতে ডিটেলিং নিয়ে ওঁর উন্মাদনা এমনই যে, শেষ পর্যন্ত ছবিতে যা দেখা যায় তার নব্বই শতাংশ ওঁর নিজের হাতে করা।

আজ যখন একবিংশ শতাব্দীতে নতুন প্রজন্মের পরিচালকরা একাই সব কিছু করার চেষ্টা করছেন এবং আমরা সংগত কারণেই সেই সোলো ফিল্মমেকারদের সেলিব্রেট করছি ( সে রিমা দাস, অমর্ত্য ভট্টাচার্য হোক বা শ্যেন কারুথ বা রবার্ট রডরিগেজ, যিনিই হন), আমাদের কিন্তু তখনও নতজানু হতেই হবে সত্যজিৎ রায়ের সামনে। মাথায় রাখতে হবে, যে ‘ভিলেজ রকস্টার’ বানানো আর ‘হীরক রাজার দেশে’র মতো একটা 'ওয়ার মিউজিক্যাল' বানানো এক কথা নয়।

সেখানেই উনি প্রকৃত ওয়ান ম্যান আর্মি, সেখানেই উনি 'সত্যজিৎ ৩৬০' ।

অন্য বিষয়গুলি:

Satyajit Ray 100th birth anniversary
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy