সুলতান সিংহ
সে সময়ের সুলতান এখন অতিথি মাত্র।
এক কালে শুধু তাঁর নামেই বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেত। এলাকার তাবড় রাজনৈতিক নেতা থেকে দুষ্কৃতী, সকলের কাছেই তিনি ছিলেন ‘ত্রাস’। তিনি অর্থাৎ, আইপিএস সুলতান সিংহ।
চাকরি জীবন থেকে অবসর নেওয়ার পরে সেই ‘সিংঘম’কেই বামেদের লালদুর্গে লড়াই করতে পাঠিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাঁচ বছর আগের বিধানসভা ভোটে বালির নির্বাচনী প্রচারে তাঁকে পাশে নিয়েই দলনেত্রীর হুংকার ছিল, ‘এমন এক জনকে বালিতে দাঁড় করালাম, যিনি লড়াই করতে পারবেন। কড়া হাতে সব দমন করতে পারবেন।’
২০১১-র পরিবর্তনের হাওয়ায় এক সময়ের হাওড়ার জেলার পুলিশ সুপার পদে থাকা সুলতান সিংহ জিতলেন বালিতে। কিন্তু পাঁচ বছরের মার্কশিটে তাঁর প্রাপ্ত নম্বর আশা জোগাতে পারেনি দলনেত্রীর মনে। তাই এ বার তিনি বাদ পরেছেন। আর এর পর থেকেই বালির ভোট-যুদ্ধের চিত্রনাট্যে শুধুই তিনি এক জন ‘অতিথি শিল্পী’!
বিধানসভা ভোটের ঢাক বাজার অনেক আগে থেকেই কানাঘুষো ছিল, এ বার আর বালিতে টিকিট পাচ্ছেন না সুলতান। কিন্তু প্রার্থী ঘোষণার মাস খানেক আগে আচমকাই ফের লোকমুখে প্রচারিত হয়ে যায়, দলের শীর্ষ নেতাদের কার্যত ‘ম্যানেজ’ করে নিয়েছেন প্রাক্তন ওই আইপিএস অফিসার। তাই টিকিট পাবেন তিনিই। সেই মতো গোপনে ভোট যুদ্ধের প্রস্তুতিও শুরু করেছিলেন। এলাকায় এলাকায় জনসংযোগ বাড়ানো থেকে শুরু
করে যাবতীয় কাজকর্মের জন্য বিধাননগর থেকে বালিতে ছুটে আসছিলেন সুলতান।
কিন্তু প্রার্থী ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা আগে বালির তৃণমূল নেতারা জানতে পারলেন শিঁকে ছিঁড়ল না সুলতানের ভাগ্যে। যদিও দলীয় নেতৃত্ব দাবি করেছেন, নিজে থেকেই আর ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে রাজি হননি বালির এই বিধায়ক। তবে সংগঠনের কাজে থাকতে চেয়েছেন। কিন্তু সত্যিই কি বালির ভোট ময়দানে রয়েছেন সুলতান?
নিজেই বলছেন, ‘‘রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও ব্যক্তিগত কারণে মনটা ভাল নেই। তাই বালিতে বেশি যাচ্ছি না। নিজে থেকেই তিন-চারটে মিটিংয়ে গিয়েছিলাম।’’ তবে বিধায়কের কাজ করতে বালিতে নিয়মিত আসছেন বলেও দাবি সুলতানের। তিনি নিজেই জানাচ্ছেন, বিতর্ক থেকে দূরে থাকতেই বালির মাটিতে কম পদক্ষেপ করছেন। কেননা, পুরসভা ভোটে বালিতে বিধায়ক অনুগামীদের টিকিট দেওয়া হয়নি বলেই জল্পনা শুরু হয়েছিল। কিন্তু তা ঠিক নয় বলেই এখন দাবি করেন প্রাক্তন এই পুলিশকর্তা।
তিনি বলেন, ‘‘আমি ভোটের কাজে বেশি থাকলে সমস্যা। যদি কোনও ভাবে বৈশালী ডালমিয়া হেরে যান তা হলে সকলেই বলবে সুলতান সিংহই ইচ্ছা করে হারিয়ে দিয়েছেন। নিজে টিকিট পাননি বলে।’’ বালিতে নির্দিষ্ট করে তাঁর কোনও অনুগামী নেই বলেও দাবি এক বারের এই বিধায়কের। বরং তাঁর দাবি, ‘‘বালির ১৬ জন কাউন্সিলরের সঙ্গেই আমার ভাল সম্পর্ক রয়েছে।’’ এ বার ভোটে বালিতে কয়েকটি জনসভা এবং কর্মিসভায় হাজির ছিলেন সুলতান। কিন্তু সেখানেও তাঁকে কার্যত এড়িয়েই গিয়েছেন সকলে। নিজের মতোই এসেছেন এবং ফিরে গিয়েছেন পুলিশ বিভাগের এক সময়ের ত্রাস।
স্থানীয় রাজনৈতিক মহলের অবশ্য ব্যাখ্যা অন্য। তাঁদের মতে, বালিতে কোনও দিনই সংগঠন মজুবত করতে পারেননি সুলতান। উল্টে তাঁর জন্যই গোষ্ঠীদ্বন্ধ চরমে উঠেছিল। শুধু তা-ই নয়, অনেক সময়ে নিজেই জড়িয়েছেন বিভিন্ন বিতর্কে। যা নিয়ে দলকেও অস্বস্তির মধ্যে পড়তে হয়েছে তাঁকে। যেমন কিছু দিন আগেই সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর একটি ছবি নিয়ে আলোড়ন তৈরি হয়। সেই ছবিতে বালির এক মহিলা নেত্রীকে প্রকাশ্যে বন্দুক চালানো শেখাচ্ছিলেন সুলতান সিংহ। শুধু তা-ই নয়, বালির উন্নয়নেও এই বিধায়কের কাজে কেউ তেমন খুশি ছিলেন না। আর সব কিছুর মূলেই ছিল তাঁর শক্ত হাতে সংগঠনের রাশ ধরতে
না পারা।
রাজনৈতিক মহল সূত্রের খবর, উন্নয়ন কিংবা সংগঠনের কাজে তেমন ভাবে কোনও দিনই সময় দিতেন না সুলতান। তবু এলাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানের অতিথি হয়ে উপস্থিত থাকার সুবাদে পরিচিত মুখ ছিলেন। কিন্তু সংগঠন মজবুত করতে না পারায় নিজেই ক্রমশ হারিয়ে ফেলেছেন নিজের অস্তিত্ব। তাই এখন কেউ আর তাঁর ঘনিষ্ঠ নয়। বালির এক তৃণমূল নেতার কথায়, ‘‘ওঁর থাকা বা না থাকায় বালির ভোটে কোনও প্রভাব পড়বে না। তিনি তো সংগঠনটাই মজবুত
করতে পারেননি।’’
এখন বড্ড একা সুলতান। চিত্রনাট্যে তাঁর জায়গাও খুব কম। আর তাই বোধহয় সংলাপও নেই বললেই চলে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy