Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪
সেদিন-২: ভুলে যাইনি সেই সব জুলুম

গায়ে ঘেঁষে নল ঠেকাল কোমরে

পরিকল্পনা নিখুঁত ভাবে রূপায়িত হলেও একটাই ফাঁক থেকে গিয়েছিল। মিডিয়া সে দিন মার খেয়েও ময়দান ছাড়েনি।সকাল সাতটায় এবি-এসি ব্লকের বাজারের সামনে গাড়ি দাঁড় করাতেই তেড়িয়া ভঙ্গিতে ছুটে এসেছিল একটা চেহারা। গত তেসরা অক্টোবর, সল্টলেকের পুরভোট সদ্য শুরু হয়েছে।

গত অক্টোবরে আহত নির্দল প্রার্থী অনুপম দত্ত। —ফাইল চিত্র।

গত অক্টোবরে আহত নির্দল প্রার্থী অনুপম দত্ত। —ফাইল চিত্র।

কাজল গুপ্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:২৪
Share: Save:

সকাল সাতটায় এবি-এসি ব্লকের বাজারের সামনে গাড়ি দাঁড় করাতেই তেড়িয়া ভঙ্গিতে ছুটে এসেছিল একটা চেহারা। গত তেসরা অক্টোবর, সল্টলেকের পুরভোট সদ্য শুরু হয়েছে।

ছেলেটির পায়ে স্নিকার্স, পরনে কালো জিনস্, টি শার্ট। কালো, পেটানো শরীর। সঙ্গী ফোটোগ্রাফার শৌভিক দে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘‘দাদা, বাইরের ছেলে।’’

তা বাইরের ছেলের কোনও রাখঢাক নেই! আঙুল উঁচিয়ে কর্কশ গলায় ফরমান দিল— ‘‘আপনাদের চিনি। এখান থেকে ফুটুন। জলদি।’’

ওর হুকুম শুনব কেন?

এগোলাম পার্কের দিকে। যেন যুদ্ধ বাধবে! পার্কের এক পাশে ক’হাজার লোক। উল্টো দিকে জনা কয়েক রিপোর্টার, ফোটোগ্রাফার। ওঁদের জটলায় গিয়ে দাঁড়াতেই বৃষ্টির মতো ইট। দৌড়ে গাড়িতে উঠে সোজা পার্কের উল্টো দিকে বুথের সামনে। কারা ইট মারছে?

ওই ওয়ার্ডে নির্দল প্রার্থী হিসেবে ছিলেন প্রাক্তন তৃণমূল নেতা অনুপম দত্ত। খবর ছিল, অনুপমকে যেন-তেন-প্রকারে হারানোর পণ করেছে তৃণমূল। তাই মিডিয়ারও নজর ছিল। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে সংবাদমাধ্যমকেও ‘সাইজ’ করার যে আগাম ছক কষা হয়েছে, সেটা টের পেলাম বুথের সামনে গিয়ে।

আমাকে দেখে এগিয়ে এলেন চেনা এক নেত্রী। তিনিও বহিরাগত। উনি যেটা করলেন, তার জন্য তৈরি ছিলাম না। জামা টেনে ধরে শাসালেন, ‘‘তোকে কিছু বলছি না। কিন্তু মিডিয়া বাড়াবাড়ি করছে। ভাল হবে না।’’

বাড়াবাড়ি?

বোঝা গেল, দলে দলে জড়ো হওয়া বাইরের ছেলেদের মিডিয়া লেন্সবন্দি করে ফেলায় ওঁদের বিলক্ষণ গোঁসা হয়েছে। বহিঃপ্রকাশ হিসেবে সাংবাদিকদের উদ্দেশে চার-পাঁচ অক্ষরের বাছা বাছা বিশেষণও ছুড়ে দিলেন নেত্রী। খানিক বাদে কয়েকটা ছেলে আমার পিঠে সেঁটে দাঁড়িয়ে পড়ল। কোমরের পিছনে ঠেকল শক্ত নলের মতো কিছু। কানে এল হিসহিসিয়ে ধমকি, ‘‘ভোট দেখবি? জন্মের মতো সাইজ করে দেব।’’

যা বোঝার, বুঝে গেলাম। ফের ইটের টুকরো উড়ে আসছে। শৌভিক ছবি তুলতে লেগেছে। হঠাৎ আর্তনাদ। ইটের ঘায়ে আঙুল ফেটে গিয়েছে, দরদরিয়ে রক্ত। যন্ত্রণাকাতর মুখেও একচিলতে হাসি। ক্যামেরাটা বেঁচে গিয়েছে!

আমার মতো ভোট ‘কভার’ করতে আসা অনুপ, অরিন্দমও ততক্ষণে ইটে ঘায়েল। ফোনে শুনছি, বিডি-বিবি-এবি-এসি-এডি ব্লক, বৈশাখী আবাসনেও চরম নৈরাজ্য। স্থানীয় কাগজের সাংবাদিক গীতার ফোন এল এফডি ব্লক থেকে— ‘‘ক’হাজার লোক আমাদের ঘিরে ফেলেছে। অবস্থা খুব খারাপ।’’

ঠিক করলাম, ওখানে যাব।

কিন্তু কী ভাবে? আমাদেরও তো ঘিরে রেখেছে! আঁতিপাঁতি করে পুলিশ খুঁজছিলাম। কোথায় পুলিশ? চারিদিকে শুধু বাইরের ছেলের ভিড়। মুখে অশ্রাব্য ভাষা, মারমুখী হাবভাব। অগত্যা আটকে রইলাম। দেখলাম, ব্লকের বাসিন্দাদের ত্রস্ত রেখে বুথে কী ভাবে ভোট লুটছে বহিরাগতের দল। হঠাৎ চারপাশের ছেলেগুলো রে রে করে তেড়ে গেল অন্য দিকে। সেই সুযোগে গাড়ি নিয়ে ধাঁ। এফডি ব্লকের এটিআই বুথে পৌঁছানোর আগেই অবশ্য ওখানে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। কী রকম?

জানা গেল, এবিপি আনন্দের অরিত্রিক ভট্টাচার্য ও তার সঙ্গী ক্যামেরাম্যান বুলেভার্ডে ক্যামেরা রেখে দাঁড়িয়েছিল, অন্য সাংবাদিকদের সঙ্গে। বহিরাগতেরা ক্যামেরা ছিনিয়ে নিতে যায়। সকলে মিলে প্রতিবাদ করে। পরিণামে অরিত্রিক, পার্থ, সঞ্জয়ের মতো কয়েক জনকে বেদম মার খেতে হয়েছে। অরিত্রিকের নাকের হাড় ভেঙেছে, পার্থ গুরুতর জখম। মহিলা সাংবাদিকদেরও রেয়াত করা হয়নি।

এবং সে সময় আশপাশে পুলিশের টিকিটি দেখা যায়নি। বুঝে গেলাম, হানাদার বাহিনীকে ভোট লুঠের বন্দোবস্ত প্রশাসনই করে দিচ্ছে!

পুলিশ এল বেশ কিছুক্ষণ বাদে। আমরাও জড়ো হলাম। স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক সুজিত বসু (এ বারও প্রার্থী) তখন হাজির হয়ে গিয়েছেন। সঙ্গে দলের আরও দুই এমএলএ— ভাটপাড়ার অর্জুন সিংহ ও বেলেঘাটার পরেশ পাল। তাঁদের সামনেই তাণ্ডবে মেতে গেল অনুগামীরা। ছবি তোলায় অর্জুনের ছেলেরা ক্যামেরা কাড়তে এল। তুমুল ধস্তাধস্তি। ঘুষিতে শৌভিকের মুখ ফাটল। তবে প্রবল হামলার মুখেও চিত্র সাংবাদিকেরা যখের ধনের মতো আগলে রেখেছিলেন নিজেদের ক্যামেরাগুলো।

এর পরেই লাঠি-বাঁশ-রড নিয়ে তাড়া। ‘‘মাজাকি বার করছি,’’— হুঙ্কার শুনলাম এক যুবকের মুখে। আধলা ইট হাতে ধেয়ে আসতে আসতে এক মাঝবয়সীর ঘোষণা, ‘‘আড়ং ধোলাই না-খেলে শু.... বাচ্চারা সিধে হবে না। মার শালাদের।’’

দৌড়, দৌড়। গাড়ি নিয়ে বেরোনোর সময় দেখি, এবিপি আনন্দের ময়ূখকে ধাওয়া করেছে কয়েক জন। গাড়ির দরজা খুলে ওকে ভিতরে টেনে নিলাম। ময়ূখ থরথরিয়ে কাঁপছে!

এরই মধ্যে বিডি ব্লকে বোমাবাজির খবর। স্কুলের বুথে পৌঁছে চোখে পড়ল, প্রার্থী অনুপমবাবু রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে লুটোচ্ছেন। বর্তমানের রাহুলের ফোন পেয়ে স্কুলের পিছনে ছুটলাম। মাটিতে তাজা বোমা পড়ে রয়েছে, পাশেই ওদের গাড়ি। গাড়ি টার্গেট করে বোমাটা ছোড়া হয়েছে। কপাল ভাল, ফাটেনি।

সকাল থেকে এমন পরিস্থিতি দেখে প্রথমে চেনা তৃণমূল নেতা, পুলিশ অফিসারদের ফোন করেছিলাম। সকলেই বলেছিলেন, ‘দেখছি, দেখছি।’ ছবিটা অবশ্য বদলায়নি। বেলা গড়ানোর সঙ্গে মালুম হয়ে গেল, কাউকে বলে কিছু হওয়ার নয়। কারণ, ভোট লুঠের তাগিদে যা যা করার, সব করা হবে। মিডিয়ার চোখ-কান বন্ধ রাখাও এর অঙ্গ। যেমন জরুরি প্রশাসনকে ঠুঁটো করে রাখা। পরিকল্পনা নিখুঁত ভাবে রূপায়িত হয়েছে। তবে একটাই ফাঁক থেকে গিয়েছে। মিডিয়া মার খেয়েও ময়দান ছাড়েনি।

ক্যামেরার ফুটেজই বলে দিচ্ছে, সাত মাস আগে সল্টলেকের ওই সকালটা ঠিক কেমন ছিল।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE