হৃদয় ঘোষের পিছনে সর্বক্ষণ দুই নজরদার। —নিজস্ব চিত্র।
বারনবগ্রামে ঢোকার পর হৃদয় ঘোষের বাড়ি খুঁজতে এখন আর বেগ পেতে হয় না। গ্রামের রাস্তায় সংবাদমাধ্যমের গাড়ি দেখলেই গ্রামবাসীরা বুঝে নেন, কোন বাড়িতে যাবে গাড়িটা। পথনির্দেশ জিজ্ঞাসা করলেই ঝটিতি অঙ্গুলিনির্দেশ— কোন পথে যেতে হবে।
মূল সড়কের ধারেই দোতলা বাড়িটা। তবে সদর দরজা মূল সড়ক থেকে নেমে যাওয়া লাল কাঁকুরে রাস্তাটার উপর। আশপাশটা ফাঁকা ফাঁকাই। বেশ চুপচাপ। সংবাদমাধ্যম দেখে বাড়ির ভিতরে কথোপকথনটাও এখন ফিসফাস। আগে এমন ছিল না। ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে হৃদয় ঘোষ যখন তৃণমূল ছেড়ে দিয়ে নির্দল প্রার্থী হয়ে ভোটে দাঁড়িয়ে পড়লেন, তখনও লোক-লস্করে গমগম করত বাড়িটা। হৃদয়বাবুর বাবা সাগর ঘোষ তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীদের বোমা-গুলিতে খুন হন এর পর। তাতে নিঃসন্দেহে ধাক্কা খেয়েছিল ঘোষ পরিবার। কিন্তু তখনও বাড়িটায় শ্মশানের নিঃস্তব্ধতা নেমে আসেনি। যেমনটা এসেছে এখন। বাবার মৃত্যুর পর দীর্ঘ দিন আইনি লড়াই চালিয়েছেন হৃদয় ঘোষ। সে লড়াই এখন আর নেই। বারনবগ্রামে ফিসফাস, শাসক দল, পুলিশ, প্রশাসন, দুষ্কৃতী— নানা রকম চাপের মুখে নতি স্বীকার করেই তৃণমূলে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন মৃত সাগর ঘোষের ছেলে। এই গুঞ্জন যদি সত্যি হয়, তা হলে হৃদয়বাবু মন থেকে তৃণমূলে রয়েছেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
সাত সকালেই প্রচারে বেরিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। বাড়িতে সংবাদমাধ্যম পৌঁছেছে বলে খবর আসতেই ছুটে এলেন। অবশ্য এলেন না বলে পৌঁছে দেওয়া হল বলাই ভাল। দুই যুবক বাইকে চড়িয়ে হৃদয় ঘোষকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনলেন। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যতক্ষণ কথোপকথন চলল, ততক্ষণ নজরদারি চালিয়ে গেলেন দু’জনে। ক্যামেরা আর মাইক্রোফোনের সামনে কথা বলতে বলতে হৃদয় ঘোষ যখন যে দিকে হাঁটলেন, ততক্ষণই ঠিক তিন ধাপ পিছনে পিছনে ঘুরতে থাকলেন নজরদার।
দেখুন সেই নজরদারির ভিডিও:
তৃণমূলের বিপক্ষে অবশ্য একটাও কথা বললেন না হৃদয়বাবু। বললেন, ‘‘উন্নয়নের যজ্ঞে সামিল হতেই তৃণমূলে ফিরেছি।’’ তা হলে এত লড়াই, বাবার খুনিদের শাস্তির দাবিতে আইনি সংগ্রামের অঙ্গীকার— সে সবের কী হবে? হৃদয় ঘোষ গড়গড় করে বলতে শুরু করলেন, ‘‘সিপিএমের লোকজন আমার বাবাকে গুলি করে খুন করেছিল। ওরা সবাই সিপিএম করত। পরে তৃণমূলে ঢুকেছিল। এখন তাদের দল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।’’ আগে যে বলেছিলেন, অনুব্রত মণ্ডলের আশ্রিত দুষ্কৃতীরাই খুন করেছে সাগর ঘোষকে। হৃদয়বাবু বললেন, ‘‘আমাদের ভ্রান্ত ধারণা ছিল। অনুব্রত মণ্ডল এ সবের মধ্যে নেই। তিনি নিশ্চুপ ছিলেন বলে ভেবেছিলাম দুষ্কৃতীদের প্রতি তাঁর নৈতিক সমর্থন রয়েছে। কিন্তু আসলে তা নয়।’’ অনুব্রত মণ্ডল কি এখন দুষ্কৃতী রাজের বিরুদ্ধে সরব? হৃদয় বললেন, ‘‘হ্যাঁ, খুবই সরব।’’
কোন মন্ত্রে হৃদয় ঘোষের এমন ভোলবদল? হীরক রাজার দেশের মতো কেষ্টদার দেশেও কি কোনও যন্তরমন্তর ঘর তৈরি হল নাকি? বারনবগ্রাম ছাড়ার আগেই উত্তর মিলে গেল। জানা গেল, হৃদয় ঘোষকে তৃণমূলে ফিরতে বাধ্য করেও স্বস্তিতে নেই বীরভূমের ‘মুকুটহীন রাজা’ অনুব্রত মণ্ডল। কড়া নজর রাখা হচ্ছে হৃদয় ঘোষ ও তাঁর পরিবারের উপর। বাড়িতে মিডিয়া হাজির হয়েছে শুনে তড়িঘড়ি সেখানে নজরদার পাঠানোর সিদ্ধান্ত নাকি স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বই নিয়েছিল। কারণ কেষ্টদার তরফ থেকে নাকি তেমনই নির্দেশ রয়েছে। হৃদয় ঘোষের অনুপস্থিতিতে তাঁর পরিজনরা যদি বেফাঁস কিছু বলে ফেলেন ক্যামেরার সামনে!
তাই দুই যুবকের সঙ্গে বাইকে চড়ে তড়িঘড়ি বাড়ি ফিরলেন হৃদয়বাবু। ক্যামেরার সামনে মুখস্থ বুলি আওড়ানোর মতো বলে গেলেন কথাগুলো। আর পিছন পিছন সারাক্ষণ ঘুরে বেড়াল বীরভূমের ‘দাদা’র নজরদাররা।
আরও পড়ুন:
কেষ্টকে ছাড়বে না কমিশন, বদলি বীরভূমের এসপি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy