গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
বনগাঁ রাজ্যের একমাত্র লোকসভা আসন, যার অন্তর্ভুক্ত তিনটি বিধানসভার বিধায়ক এ বারের লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী। কারণ একটাই— তাঁদের সকলেরই মতুয়া সম্প্রদায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। বর্ধমান পূর্বে প্রার্থী হয়েছেন হরিণঘাটার বিজেপি বিধায়ক অসীম সরকার। বারাসতে বিজেপি প্রার্থী করেছে বনগাঁ দক্ষিণ থেকে জয়ী মতুয়া বিধায়ক স্বপন মজুমদারকে। আর খোদ বনগাঁয় বিজেপির প্রার্থী মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি শান্তনু ঠাকুর। আবার তৃণমূল যাঁকে প্রার্থী করেছে, সেই বিশ্বজিৎ দাসও ঠাকুর পরিবারের ঘনিষ্ঠ। তিনিও বনগাঁ লোকসভার অন্তর্গত বাগদার বিজেপি বিধায়ক ছিলেন। পদত্যাগ করে তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন দিল্লিবাড়ির লড়াইয়ে।
২০০৯ সালে জন্ম নেওয়া বনগাঁ বিধানসভায় প্রথম থেকেই মতুয়া অঙ্ক গুরুত্ব পেয়েছে। বামেরাও এই এলাকার বিধানসভা আসনগুলিতে মতুয়া সম্প্রদায়ের ভোটে জয়ী হত। তখন অবশ্য এতটা ‘প্রকট’ ছিল না মতুয়া ভোটব্যাঙ্ক। সেই সময়ের উত্তর ২৪ পরগনার বারাসত ও নদীয়া জেলার নবদ্বীপ আসন ভেঙেই জন্ম হয় বনগাঁর। প্রথম বারেই জেতে তৃণমূল। প্রার্থী হয়েছিলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় মন্ত্রিসভার সদস্য গোবিন্দচন্দ্র নস্কর। প্রায় ৯৩ হাজার ভোটে জয়ী গোবিন্দচন্দ্রকে অবশ্য দ্বিতীয় বার আর প্রার্থী করেনি তৃণমূল। ২০১৪ সালে সরাসরি ঠাকুরবাড়ির সদস্যরা চলে আসনে ভোট রাজনীতিতে।
মতুয়া সম্প্রদায়ের ‘বড়মা’ বীণাপাণি দেবীর সঙ্গে তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠতা রাজ্যে পালাবদলের আগেই। সেই সূত্রেই ২০১১ সালে বীণাপাণির কনিষ্ঠ পুত্র মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুরকে গাইঘাটা আসন থেকে প্রার্থী করেন মমতা। মঞ্জুল জেতায় তাঁকে মন্ত্রীও করেন। প্রসঙ্গত, মঞ্জুলের দুই পুত্রই এখন বিজেপির ‘সম্পদ’। এক জন শান্তনু। যিনি গত বার বিজেপির টিকিটে জিতে কেন্দ্রের মন্ত্রী হয়েছেন। আর এক পুত্র সুব্রত ঠাকুর এখন গাইঘাটার বিজেপি বিধায়ক।
মঞ্জুলকৃষ্ণের সঙ্গে তৃণমূলের দূরত্ব তৈরি হওয়ায় ২০১৪ সালে তাঁরই দাদা, অর্থাৎ বীণাপাণির বড় ছেলে কপিলকৃষ্ণ ঠাকুরকে বনগাঁ লোকসভায় প্রার্থী করে তৃণমূল। প্রায় দেড় লাখ ভোটে জেতেন তিনি। তখন থেকেই ঠাকুরনগরে মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রাণকেন্দ্র ঠাকুরবাড়ির অন্দরে ঢুকে যায় রাজনৈতিক লড়াই। সাংসদ হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই মৃত্যু হয় কপিলকৃষ্ণের। ২০১৫ সালে ফেব্রুয়ারি মাসের উপনির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী করে তাঁর স্ত্রী মমতাবালা ঠাকুরকে। জেঠিমার বিরুদ্ধে বিজেপির প্রার্থী হন সুব্রত। দু’লাখের বেশি ব্যবধানে মমতাবালা জেতেন। সুব্রত তৃতীয় হন। ওই লড়াইয়ের কারণে মমতার দেওয়া মন্ত্রিত্ব ছেড়ে বিজেপিতে যোগদান করেছিলেন মঞ্জুল। ২০১৪ সালের লোকসভার নির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী হয়ে মতুয়া সম্প্রদায়ের কেডি বিশ্বাস ২ লক্ষ ৪৪ হাজার ভোট পেয়ে সকলকে চমকে দেন। ফলে বনগাঁ লোকসভায় বিজেপির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয়ে যায়। উপনির্বাচনে সুব্রত প্রার্থী হন। পদ্ম প্রতীকে ভোট পড়ে ২৪.১৭ শতাংশ। দ্বিতীয় হয় সিপিএম। তাদের ভোট ছিল ২৬.৩০ শতাংশ। সেই সময় থেকেই মতুয়া ভোট একটু একটু করে তৃণমূল থেকে বিজেপির দিকে যেতে শুরু করে।
এর পরে আগমন শান্তনুর। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে জেঠিমা মমতাবালাকেই প্রার্থী করেছিল তৃণমূল। কিন্তু দাদা সুব্রত তৃতীয় হলেও শান্তনু ৪৮.৮৫ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হন। ১ লাখের বেশি ভোটের ব্যবধানে জয়ী শান্তনু শুরুতে না হলেও নরেন্দ্র মোদী মন্ত্রিসভায় রদবদলে ২০২১ সালের জুলাইয়ে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এ বারও তিনিই প্রার্থী। তবে বিপক্ষে পরিবারের কেউ নেই।
কিন্তু একেবারে নেই বলাও কি ঠিক হবে? একদা তৃণমূলে থাকা বিশ্বজিৎ মুকুল রায়ের হাত ধরে গিয়েছিলেন বিজেপিতে। এর পিছনে কারণও ছিল। মতুয়া সমাজের উপরে তাঁর প্রভাবের কথা আগে থেকেই জানা ছিল। সেই সময়ে ঠাকুরবাড়ি এবং শান্তনুর সঙ্গেও নিত্য যোগাযোগ বিশ্বজিতের। তিনি প্রায় ‘ঠাকুরবাড়ির লোক’ হয়ে উঠেছিলেন। এর পরে ২০২১ সালে বিশ্বজিতের হয়ে প্রচারও করেছেন শান্তনু। কিন্তু জয়ের কয়েক মাস পর বিশ্বজিৎ যোগ দেন বিজেপিতে। পরে তিনি তৃণমূলে এলে তাঁকে বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি করেন মমতা। তবে খাতায়কলমে বিশ্বজিৎ বিজেপি বিধায়কই থেকে গিয়েছিলেন। এ বার বিজেপির বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে লোকসভার প্রার্থী তিনি। তবে স্থানীয়দের মতে, মতুয়া সম্প্রদায়ের ভোট পাওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বজিতের থেকে এগিয়ে থাকার কথা শান্তনুর। তবে দল হিসাবে তৃণমূল পিছিয়ে নেই। পরিবারের কাউকে লোকসভায় প্রার্থী না করলেও আগে থেকেই রাজ্যসভায় পাঠিয়ে দিয়েছে মমতাবালাকে। তাঁর পূর্ণ সমর্থন রয়েছে বিশ্বজিতের দিকেই।
কিন্তু মতুয়া ভোটের সঙ্গে আরও একটি বিষয় জড়িয়ে রয়েছে। সেটি নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন। আসলে উদ্বাস্তু মতুয়ারা বরাবরই ভারতীয় নাগরিকত্বের দাবিতে সরব। গত বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে সিএএ কেন কার্যকর হচ্ছে না, তা নিয়ে নিজের দলের সঙ্গেই সংঘাত তৈরি হয়েছিল শান্তনুর। সে সব মেটাতে মুকুল বা কৈলাস বিজয়বর্গীয়র দৌত্যে কাজ না-হওয়ায় স্বয়ং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। করোনাকাল মিটে গেলে কেন্দ্র উদ্যোগী হবে বলে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন তিনি। এর পরেও অনেক দিন পেরিয়ে যায়। শেষে লোকসভা নির্বাচনের মুখে এসে কেন্দ্র সিএএ কার্যকরের বিজ্ঞপ্তি জারি করে গত ১১ মার্চ।
প্রাথমিক ভাবে আশ্বস্ত হয়েছিলেন শান্তনুরা। কিন্তু ভোট যত এগিয়েছে, তত এমন প্রশ্ন তৈরি হয়েছে যে, সিএএ ভোটের জন্য ভাল না খারাপ। রাজ্যে সিএএ কার্যকর করতে দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়ে চলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। অন্য দিকে, শাহ বনগাঁয় এসে পাল্টা চ্যালেঞ্জ করেছেন এই বলে যে, সিএএ আটকানোর ক্ষমতা রাজ্যের নেই। প্রধানমন্ত্রী মোদীও বাংলায় যত সভা করেছেন, সেখানে সিএএ ‘উপকারী’ বলে দাবি করেছেন। আর তৃণমূল সর্বশক্তি দিয়ে সিএএ আগামীতে বিপদ তৈরি করবে বলে আশঙ্কার কথা শুনিয়ে চলেছে। শুধু বনগাঁ নয়, রাজ্যের অনেক আসনেই সিএএ প্রভাব ফেলবে ভোটের ফলাফলে। তবে এ-ও ঠিক যে, বনগাঁয় বিশ্বজিতের মতো রানাঘাট লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী মুকুটমণি অধিকারী বিপাকে পড়তে পারেন। কারণ, একটা সময়ে বিজেপির মঞ্চ থেকে তাঁরাই সিএএ চালুর বড় দাবিদার ছিলেন।
এই ভোটে দুই ফুলই চায় মতুয়া ভোট। দু’পক্ষই চায় ভোটে সিএএ চোট দিক প্রতিপক্ষকে। কিন্তু দুই ফুলের এই এক অঙ্কে কি আদৌ জোট প্রার্থীর কোনও ভূমিকা থাকবে? হিসাব বলছে, কংগ্রেস প্রার্থী প্রদীপ বিশ্বাসের পুঁজি বলতে ২০১৯ সালে পাওয়া নিজের দলের ১.৬১ আর সিপিএমের ৬.৪০ শতাংশ ভোট। নির্বাচনী আবহ তো বটেই, অঙ্কও বলে দিচ্ছে, বনগাঁয় কংগ্রেসের ‘হাত’-এ নেই ভোটের ভবিষ্যৎ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy