গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
হুগলি লোকসভা আসন মানেই রূপচাঁদ পাল। বাম জমানায় একটি বছর বাদ দিলে এটাই ছিল হুগলির পরিচয়। ১৯৮০ থেকে মাঝে একটি বার বাদ দিলে সাত-সাত বার সেখানে জিতেছিলেন সিপিএম নেতা রূপচাঁদ। ১৯৮৪ সালে কংগ্রেসের ইন্দুমতী ভট্টাচার্যের কাছে হেরে গিয়েছিলেন রূপচাঁদ। এর পরে ২০০৯ সালে তৃণমূল প্রার্থী রত্না দে নাগের কাছে হারেন। তার পরে আর প্রার্থী হননি। রূপচাঁদের আগেও বামেদের ‘ঘাঁটি’ ছিল এই আসন। এখন সেই আসনেই সাংসদ বিজেপির লকেট চট্টোপাধ্যায়।
ইতিহাস বলছে, লকেটের অনেক আগে হুগলি থেকে জিতেছিলেন আর এক গেরুয়া প্রার্থী। স্বাধীনতার পরে প্রথম লোকসভা নির্বাচনে ১৯৫২ সালে জিতেছিলেন হিন্দু মহাসভার নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এর পরে লাল আর লাল। ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর বছরে শুধু ইন্দুমতী জিতেছিলেন। এর পরে সাংবাদিক উমাশঙ্কর হালদারকে (যিনি ‘হলধর পটল’ নামেও খ্যাত ছিলেন) দু’বার প্রার্থী করে কংগ্রেস। ১৯৯৮ এবং ১৯৯৯ সালে তপন দাশগুপ্তকে প্রার্থী করে তৃণমূল। কিন্তু বদল আনতে পেরেছিলেন তৃণমূলের রত্না দে নাগ ২০০৯ সালে। রূপচাঁদকে ৮০ হাজারের বেশি ভোটে হারিয়ে দেন রত্না। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে সিপিএম প্রদীপ সাহাকে প্রার্থী করলে রত্নার জয়ের ব্যবধান দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে গিয়েছিল। সেই বছরেই বিজেপির ‘উত্থান’ প্রথম চোখে পড়েছিল। ২০১৯ সালে জিতেই যান বিজেপির লকেট।
লকেটের প্রধান প্রতিপক্ষ নিঃসন্দেহে তৃণমূলের রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়। অতীতে একই সঙ্গে সিনেমায় অভিনয় করা লকেট-রচনা ভোটের ময়দানে সম্মুখসমরে। তবে রচনাই প্রথম তৃণমূলের টিকিটে হুগলিতে রাজনীতির বাইরের এবং অভিনয় জগতের প্রতিনিধি হিসেবে দাঁড়াচ্ছেন না। ২০০৪ সালে বলিউডের অভিনেত্রী ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়কে প্রার্থী করেছিল তৃণমূল। জয় পাননি। পরের বারেই জয় হাসিল করেন রত্না। সেই বছরে না পারলেও বিজেপি ২০১৪ সাল থেকে হুগলিতে নিজেদের উপস্থিতি বোঝাতে শুরু করে। সে বার প্রার্থী হয়েছিলেন অধুনাপ্রয়াত সাংবাদিক চন্দন মিত্র। রত্না বিপুল ভোটে জিতলেও তৃতীয় স্থানে থাকা বিজেপি প্রায় ১৩ শতাংশ ভোট বাড়িয়ে নেয়। সিপিএমের ক্ষয় জারি থাকে। ২০১৯ সালে সিপিএমের ভোট কমে ২৭ শতাংশের বেশি। বিজেপির বাড়ে ২৯.৬৬ শতাংশ। ৪৬.০৩ শতাংশ ভোট পেয়ে লকেট জেতেন ৭৩ হাজারের কিছু বেশি ভোটের ব্যবধানে।
এ বার সেই ‘ক্ষত’ নিরাময় করতে তৃণমূল হুগলিতে নিয়ে গিয়েছে ছোট পর্দার ‘দিদি নম্বর ওয়ান’ রচনাকে। বড় পর্দায় নায়িকা হিসাবেই উত্থান হয়েছিল রচনার। কিন্তু সেই সাফল্য বেশি দিন ধরে রাখতে পারেননি। মাঝে ওড়িয়া ছবিতেও অভিনয় করেন। তার পরে একটা লম্বা সময় বিরতি। শেষে রিয়্যালিটি শোয়ের হাত ধরে ফের উত্থান। এখন তাঁর জনপ্রিয়তাও অতীতের তুলনায় বেশি। তাঁর সঞ্চালিত অনুষ্ঠানে গিয়েছেন বাংলার ‘দিদি নম্বর ওয়ান’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই অনুষ্ঠান সম্প্রচারের পরে পরেই কালীঘাটের ডাক পান রচনা। যদিও অনেকে বলেন, যোগাযোগ আগে থেকেই চলছিল। তমলুক না হুগলি, সেটাই শুধু চূড়ান্ত হয়নি। ১০ মার্চ তৃণমূলের ব্রিগেড সমাবেশে জল্পনার অবসান ঘটে। আগে সরকারি অনুষ্ঠানে মমতার পাশে দেখা গেলেও প্রথম বার তৃণমূলের মঞ্চে দেখা যায় রচনাকে। র্যাম্প থেকে সটান হুগলির পথেঘাটে। রচনা ভোটের প্রচারে একের পর এক মন্তব্যে নজর কেড়েছেন। তাতে ‘হাস্যরস’ বেশি। তাঁর কথার ‘ধোঁয়া’, ‘দই’, ‘ঘুগনি’ নিয়ে মিমের ছড়াছড়ি। রচনার নিজের হাসিও নির্বাচনের মতো গম্ভীর বিষয়ে মজার উপাদান এনেছে।
রচনার চেয়ে লকেট অনেক বেশি ‘রাজনীতিক’। অভিনেত্রী লকেটকে ছাপিয়ে গিয়েছেন রাজনীতিক লকেট। রাজ্য বিজেপির মহিলা মোর্চার সভানেত্রী থেকে রাজ্যের সাধারণ সম্পাদক। ভিন রাজ্যে সাংগঠনিক দায়িত্বও সামলেছেন। তবে লড়াই তাঁর একেবারে সোজা বলা যাবে না। বস্তুত, হুগলিতে লকেট প্রার্থী হবেন কি না, তা নিয়েই বিজেপির মধ্যে জল্পনা ছিল। দিল্লি বা উত্তরাখণ্ডে বেশি সময় দেওয়ার জন্য দলীয় কর্মীদের মধ্যেও তাঁকে নিয়ে বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়েছিল। তিনি আসন বদলাতে পারেন বলেও শোনা গিয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত জানা যায়, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী লকেটকে পুরনো আসন হুগলি থেকেই লড়তে বলেছেন।
প্রথম বার লোকসভা ভোটে দাঁড়িয়ে জিতে গেলেও লকেটের বিধানসভা নির্বাচনের ভাগ্য ভাল নয়। ২০১৬ সালে বীরভূমের ময়ূরেশ্বর বিধানসভায় পরাজিত লকেট ২০২১ সালের নীলবাড়ির লড়াইয়েও হেরে যান। লোকসভা নির্বাচনে ভাল ব্যবধানে এগিয়ে থাকা আসন চুঁচুড়া থেকে বিজেপি প্রার্থী করেছিল তাঁকে। কিন্তু লকেট তৃণমূলের কাছে হারেন। হুগলি লোকসভার অন্তর্গত একটি আসনেও জয় পায়নি বিজেপি। যদিও গত লোকসভা নির্বাচনে পাঁচটি আসনে এগিয়ে ছিল পদ্মশিবির। সেই হিসাবে লকেটের কাছে জয় ধরে রাখা চ্যালেঞ্জের। অন্য দিকে, প্রথম বার ভোটে দাঁড়িয়ে রচনার হারাবার কিছু নেই। জয় করার জন্য রয়েছে গোটা হুগলি।
তবে হুগলির লড়াইয়ে সিপিএম এখন সত্যিই ‘সর্বহারা’। গত লোকসভা নির্বাচনের হিসাবে কংগ্রেস এবং সিপিএম মিলিয়ে ১০ শতাংশের মত ভোটই পুঁজি বামপ্রার্থী মনোদীপ ঘোষের। লকেট বা রচনার মতো ‘খ্যাতনামী’ নন তিনি। একমাত্র পরিচয়, পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ। এই প্রথম বার ভোটের ময়দানে সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য মনোদীপ। চুঁচুড়ার চাঁপাতলার বাসিন্দা মনোদীপ ছাত্রজীবন থেকেই বাম রাজনীতিতে। বরাবরই দলের সাংগঠনিক দায়িত্বে থেকেছেন রূপচাঁদের ‘রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী’। কিন্তু রূপচাঁদ-কাল ফেরানোর স্বপ্ন দেখার মতো সংগঠন নেই তাঁর পাশে।
অতএব মূল লড়াই লকেট-রচনার। লকেট অভিনত্রীর খোলস ছেড়ে রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছেন ২০১২-’১৩ সাল থেকেই। তার আগে ২০১১ সালে তৃণমূলে এবং ২০১৪ সালে বিজেপিতে যোগ দিলেও অভিনয় চালিয়ে গিয়েছিলেন। রচনার সঙ্গেও কাজ করেছেন। ২০১৪ সালেই রচনার অভিনয় করা চরিত্র ‘গোয়েন্দা গোগোল’-এর মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন লকেট। ২০১৭ সালেও ‘হঠাৎ একদিন’ ছবিতে কাজ করেন দু’জনে। এ তো হালফিলের কথা। কিন্তু যখন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দু’জনেই অভিনয় করতেন, তখন বেশির ভাগ কাহিনিতেই ‘নায়িকা’ ছিলেন রচনা। লকেট সেখানে ‘পার্শ্বচরিত্র’। এই লোকসভা নির্বাচন ঠিক করে দেবে, রাজনীতির ময়দানে কে হবেন ‘নায়িকা’। আর ‘পার্শ্বচরিত্রে’ থাকতে হবে কাকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy