—প্রতীকী ছবি।
প্রচার চলছে। সভা হচ্ছে তাবড় নেতাদের। কিন্তু চর্চা হচ্ছে কি! চায়ের আড্ডায়, দোকানে, বাজারে, মন্দিরের চাতালে? কান পাতলে কি শোনা যাচ্ছে তুমুল রাজনৈতিক আলোচনা?
হুগলি কিন্তু নিশ্চুপ। ২০১১ সালে ‘পরিবর্তনের’ সলতে পাকানো যে এলাকা থেকে শুরু হয়েছিল, ২০১৯ সালে লকেট চট্টোপাধ্যায়কে ৭৩ হাজার ভোটের ব্যবধানে জিতিয়ে যে এলাকা, সেই লোকসভা আসনের মুখে হঠাৎ কথা কম। সিঙ্গুর যার কেন্দ্রে, সে এমন চুপ কেন? তা হলে ২০ মে বৈদ্যুতিন ভোটযন্ত্রের কোন বোতামে আঙুলের চাপ দেবেন অধিকাংশ ভোটার? নিশ্চিত নয় কোনও পক্ষ। তাই খোঁজ চলছে ‘এক্স ফ্যাক্টর’-এর।
কী হতে পারে সেই ‘এক্স ফ্যাক্টর’?
প্রচারের ময়দানে তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিজেপি হাতিয়ার করছে নিয়োগ, রেশন-সহ একাধিক দুর্নীতি, সন্দেশখালি (ভিডিয়ো-কাণ্ডকে আমল না দিয়ে)-কে মধ্যে রেখে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। বিজেপির বিরুদ্ধে সামাজিক এবং ধর্মীয় ভেদাভেদ ছড়ানো, গরিবের পাওনা ছিনিয়ে নেওয়ার (একশো দিন এবং আবাস প্রকল্প নিয়ে) মতো অভিযোগ তুলে পাল্টা সরব তৃণমূল। আবার এই অভিযোগগুলিতেই তৃণমূল এবং বিজেপিকে এক যোগে বিদ্ধ করতে ছাড়ছে না সিপিএম। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা অনেকেই মনে করছেন, মুঠোফোনের দৌলতে অভিযোগগুলি সম্পর্কে প্রত্যেকেই ওয়াকিবহাল। ফলে ভোটারের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ কী ভাবে ঘটবে, তার আগাম অনুমান করা মুশকিল।
তৃণমূলের অন্যতম গড় তথা রাজনৈতিক পালা বদলের ভরকেন্দ্র এই আসনের ফল ঘুরেছে ২০১৯ সালে। সেবার হুগলি লোকসভায় সাতটির মধ্যে পাঁচটি থেকেই ‘লিড’ পেয়েছিল বিজেপি। ধনেখালি এবং চন্দনগর বিধানসভার ‘লিড’ গিয়েছিল তৃণমূলের অনুকূলে। এ বার পুরোদস্তুর রাজনৈতিক প্রার্থী লকেটের বিপরীতে তৃণমূলের তারকা-প্রার্থী রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়। সিপিএম প্রার্থী মনোদীপ ঘোষ।
জেলা তৃণমূলের অন্দরে কান পাতলে সব থেকে বেশি যে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা শোনা যায়, সেটা ‘গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব’। জেলা নেতাদের অনেকেই মানছেন, ২০১৯ সালের মতোই সেই দ্বন্দ্বের ছায়া ক্রমে দীর্ঘ হচ্ছে। একে তো বলাগড়ের বিধায়ক মনোরঞ্জন ব্যাপারী বার বার বেসুরো। পান্ডুয়ায় দলীয় নেতৃত্বের মধ্যে বিভাজনও কার্যত স্পষ্ট। যা ঠেকাতে আসতে নামতে হয় দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কেও। ‘চোরাস্রোত’ আছে অন্যত্রও।
এর মধ্যে নেতাদের আর এক ‘আক্ষেপ’, ‘দিদি নম্বর ওয়ান’ খ্যাত রচনার নানা মন্তব্য। রাজনীতিতে নবাগত রচনার সেই সব কথা দ্রুত মিম হয়ে চলে আসছে সমাজমাধ্যমে। অস্বস্তিও বাড়ছে দলের। উপরন্তু দলের সংগঠন ও তার সমীকরণ সম্পর্কেও ততটা অভিজ্ঞতা নেই তাঁর। জেলা তৃণমূলের এক নেতার কথায়, “দুর্নীতি-সহ একাধিক অভিযোগে তৃণমূল কর্মীদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। অস্তিত্ব ধরে রাখতে হলে একযোগে লড়াই চালাতেই হবে।” রচনা বলছেন, ‘‘গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সব জায়গাতেই রয়েছে। তবে এখনও আমার চোখের সামনে পড়েনি। তাঁরা নিজেরাই হয়তো ভিতরে-ভিতরে মিটিয়ে নিচ্ছেন।’’
দুর্নীতির অভিযোগ এই জেলায় একটু বেশিই তাড়া করছে তৃণমূলকে। নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার হাতে গ্রেফতার হয়েছেন বলাগড়ের শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কুন্তল ঘোষ। সেই মামলায় নানা সময়ে হাই কোর্টের মন্তব্যও অস্বস্তিতে ফেলেছে দলকে। সঙ্গে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে অভিযোগ। এই সব সামলাতে এলাকা ধরে ধরে প্রতিটি বাড়িতে দু’-তিন বার করে পৌঁছে লক্ষ্মীর ভাঁড়, মানিব্যাগ দিয়ে রাজ্য সরকারের ‘উদারতা’-র কথা মনে করানোর নির্দেশ কর্মীদের দিয়েছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। জেলায় কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে, এই পরিকল্পনার নেপথ্যে রয়েছে শাসকদলের পরামর্শদাতা সংস্থা। রচনার কথায়, ‘‘লক্ষ্মীর ভান্ডার মহিলাদের কাছে বড় আশ্রয়। এর সঙ্গে জুড়েছে তারকা রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়।’’ বলাগড় ব্লক তৃণমূলের সহ-সভাপতি তপন দাসও বলছেন, “লক্ষ্মীর ভান্ডারের প্রচারের সঙ্গে রচনার তারকা-খ্যাতি কাজ করলেই চলবে।”
বিজেপি এবং সিপিএমের পাল্টা বক্তব্য, শোষণ-বঞ্চনা-দুর্নীতি থেকে নজর ঘোরাতেই আঁকড়ে ধরতে হচ্ছে লক্ষ্মীর ভান্ডারকে। মনোদীপের কথায়, ‘‘কেরল-সহ অনেক রাজ্যে এমন প্রকল্পের আর্থিক পরিমাণ আরও বেশি। মানুষ বরং দুর্নীতি নিয়ে বিরক্ত। আবার একশো দিনের কাজ বা আবাস যোজনায় বঞ্চনাও হয়েছে। বাড়ছে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম।’’
লকেট বলছেন, ‘‘হুগলি রাজনৈতিক ভাবে অনেক সচেতন। এটা নীতি-উন্নয়ন এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই, তা মানুষ বোঝেন।’’ তারকা তকমা ঝেড়ে ফেলে পুরোদস্তুর রাজনৈতিক প্রার্থী হয়ে ওঠার দাবি করছেন লকেট। যদিও তাঁর বিরুদ্ধে তৃণমূলের অভিযোগ, গত পাঁচ বছরে দেখা যায়নি সাংসদকে। বিপদে-আপদে পাশে পাওয়া যায়নি। আবার গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের একটা আঁচ রয়েছে জেলা বিজেপির মধ্যেও। সাংসদের বিরুদ্ধে পড়েছিল ‘নিখোঁজ’ পোস্টারও। যদিও লকেট বলছেন, “দেখা না গেলে সাংসদ তহবিলের ১৭.৬২ কোটি টাকার কাজ হল কী করে!’’
এ বারের ভোটে প্রার্থী বদলেছে সিপিএম। স্বচ্ছ ভাবমূর্তির মনোদীপ ছুটছেন এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে বামেদের ভোট বৃদ্ধির একটা ইঙ্গিত ধরা পড়েছিল। বাম নেতৃত্বের একাংশ মনে করছেন, সেই ধারা অব্যহত থাকবে এই ভোটেও। তা বাস্তবে ঘটলে ভোট কাটাকাটির আশা রাখছেন তৃণমূল নেতারা। কিন্তু এত প্রচারের ঢক্কানিনাদ, সেখানে শিল্পের কথা কই! সিঙ্গুর থেকে টাটাদের চলে যাওয়া এবং কারখানা মাটিতে মিশে যাওয়ার পরে সেখানে শিল্পের প্রতিশ্রুতি ছিল শাসক তৃণমূলের তরফে। বাস্তবে যা এখনও ঘটেনি। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের পশ্চিম ধারের সেই কারখানার জমি এখন কার্যত পোড়ো মাঠ। ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ কৃষক পরিবারগুলির জন্য সরকারের ‘কল্যাণ প্রকল্প’ চলছে এখনও। ভোটের কথা উঠলে মুখ ঘোরাচ্ছেন অনেকে।
চা তৈরি করতে করতেই স্থানীয় দোকানির মন্তব্য, “উটকো ঝামেলা ঘাড়ে নিতে এখন আর কেউই চায় না। কোন কথায় কার খারাপ লাগবে, তার পরে দাদাদের ঝক্কি সামলাতে হবে। যা হবে দেখা যাবে ভোটের ফলেই।” অবশ্য রচনা বলছেন, ‘‘রাজনীতিতে নাম লিখিয়েই শিল্প নিয়ে বড় বড় কথা বলতে পারব না। সংসদে গেলে নিশ্চয়ই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে, পড়ে থাকা সিঙ্গুরের জমি নিয়ে আলোচনায় বসব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy