এ বারও ভোট দেবে চরমেঘনা। — গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
ন্যূনতম স্বাস্থ্য পরিষেবা পেতে পেরোতে হয় কম করে কুড়ি কিলোমিটার। স্কুল, কলেজ, বাজার কোনওটির দূরত্বই ১০ কিলোমিটারের কম নয়। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) ভারী বুটের শব্দে ঘেরা গ্রাম চরমেঘনা। দিনের আলোয় নানাবিধ পরিচয়পত্র দেখিয়ে, ত্রিস্তরীয় নিরাপত্তা বেষ্টনী পার হয়ে যাওয়ার অনুমতি মেলে, সন্ধ্যা গড়ালে আপৎকালীন অবস্থাতেও অনুমতি জোগাড় করতে পেরিয়ে যায় মহামূল্যবান কয়েক ঘণ্টা। বিএসএফের কাছে আধার কিংবা ভোটার কার্ড জমা দিয়ে তবেই মেলে নিজের দেশের মূল ভূখণ্ডে পা রাখার অনুমতি! কিন্তু ভোট এলে সাময়িক ভাবে বদলে যায় অনেক কিছুই। গাঁয়ে উড়তে থাকে লাল, সবুজ, গেরুয়া পতাকা। বড় বড় হোর্ডিং আর ব্যানারের মোটা চাদরে ঢাকা পড়ে চরমেঘনার নিত্য দিনের কান্না। কিন্তু চরমেঘনা জানে, ভোট মিটলেই যে কে সেই!
নদিয়ার মেঘনা বিএসএফ ক্যাম্পের অনতিদূরে ভারত-বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া। সেখানে বসানো একটি পেল্লায় লোহার ফটক, চরমেঘনা। ভোটার কিংবা আধার কার্ড জমা দিয়ে, বিএসএফের হাজারো প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারলে তবেই চরমেঘনায় ঢোকা বা বেরোনোর অনুমতি মেলে। খুবলে বেরিয়ে আসা ইটের রাস্তা গ্রামে চলাচলের একমাত্র ভরসা। কাঁটাতারের ও পারে বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার মহিষকুণ্ডি এবং জামালপুর। মাঝে জল শুকিয়ে নালার মতো পড়ে থাকা মাথাভাঙা নদী। মাঝেমধ্যেই নদীপথ টপকে বাংলাদেশি দুষ্কৃতীরা হানা দেয় চরমেঘনায়। লুট হয়ে যায় বাড়ির পর বাড়ির গবাদি পশু, মাঠের ফসল। বিএসএফে অভিযোগ জানিয়েও মেলে না সুরাহা।
মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত করিমপুর বিধানসভার মধ্যে পড়ে চরমেঘনা গ্রাম। জেলা হিসাবে নদিয়া। গ্রামের মোট ভোটারের সংখ্যা ৫৯৮, এর মধ্যে ৩১০ জন পুরুষ এবং ২৮৮ জন মহিলা। গ্রামের একমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়কে ভোটকেন্দ্র হিসাবে ব্যবহার করা হয়। তবে, ইতিউতি প্রচার চললেও চরমেঘনায় প্রার্থীদের দেখা সচরাচর মেলে না। তা হলে প্রতি বার নিয়ম করে ভোট দেয় কেন চরমেঘনা, কিসের টানে? অশীতিপর বৃদ্ধ নকুল মাহাতো লাঠিতে ভর দিয়ে বিরক্তি লুকিয়ে দিলেন তারই জবাব। বললেন, ‘‘শুধুমাত্র ভোটার আর আধার কার্ডটা বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তাই ভোট দিতে যাই। ওগুলি না থাকলে কবে আবার আমাদের বাংলাদেশি করে দেবে! এ সব ঝক্কি না থাকলে আর ওমুখোই হতাম না!’’ নকুলের কথায় সহমত পোষণ করেন স্থানীয় লোকজনও। এক জন বললেন, ‘‘গ্রামের আশি থেকে নব্বই শতাংশ মানুষ ভোট দেন। নিজের পরিচয়পত্র বাঁচিয়ে রাখতে ওঁরা এ বারও ঠিক ভোট দেবেন। কোনও না কোনও দলকে তো দেবেন!’’
সুবিধা কিছুই নেই, অভিজ্ঞতা শিখিয়েছে, প্রত্যাশাও রাখা বারণ। তবুও প্রতি বার নিয়ম করে ভোট দেয় চরমেঘনা। গ্রামবাসীদের দাবি, ভোট এলে অনেক গালগল্প শোনা যায়। সাংসদ, বিধায়কেরা ফোন করেন, গাঁয়ে পঞ্চায়েত প্রধানের আনাগোনা শুরু হয়। রাশি রাশি প্রতিশ্রুতি থাকলেও, ভোট মিটে গেলে সে সব ভোজবাজির মতোই হাওয়া! আবার বিএসএফের ‘শাসনে’ চলে যায় গ্রাম। গ্রামের মহিলা পঞ্চায়েত সদস্য সুমিত্রা মাহাতো বলেন, ‘‘বিএসএফের চোখরাঙানি আর বাংলাদেশি দস্যুদের ভয়ে আমাদের সিঁটিয়ে থাকতে হয়। ভোট পেরিয়ে গেলে কেউ খোঁজ রাখে না। কবে যে এর সুরাহা হবে তার উত্তর আমাদের কাছেও নেই।’’ ফলস্বরূপ, গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে পারতপক্ষে মেয়ের বিয়ে দিতে চান না অন্য গ্রামের বাবা-মায়েরা। স্থানীয় বাসিন্দা বিমল মাহাতো রসিকতা করে বললেন, ‘‘জামাইষষ্ঠীতে আম, কাঁঠাল, লিচু নয়, মনে করে আধার কার্ড আর ভোটার কার্ড আনলে, তবেই শ্বশুরবাড়ি পৌঁছনো যায়!’’
স্থানীয়দের একাংশের অভিযোগ, গত পাঁচ বছরে এক দিনের জন্যও গ্রামে দেখা মেলেনি সাংসদের। অভিযোগ প্রসঙ্গে বিদায়ী সাংসদ আবু তাহের খান বলেন, ‘‘চরমেঘনার উন্নতির জন্য সংসদে দাবি জানিয়েছি। আমরা সস্তার রাজনীতি করতে চাই না।’’ ঘটনাচক্রে, আবু তাহেরকে এ বারও এই কেন্দ্রেই প্রার্থী করেছে তৃণমূল। এই কেন্দ্রের কংগ্রেস সমর্থিত বাম প্রার্থী সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। তিনি বলেন, ‘‘এর আগে আমাদের যিনি সাংসদ ছিলেন, তিনি এই চরমেঘনা নিয়ে বার বার সংসদে আওয়াজ তুলেছেন। বদরুদ্দোজা খানের সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে আমার এ নিয়ে আলোচনাও হয়েছিল। তৃণমূলের বঞ্চনার জবাব চরমেঘনার মানুষ দেবেন।’’ বিজেপি প্রার্থী গৌরীশঙ্কর ঘোষ বলছেন, ‘‘চরমেঘনা নিয়ে যা করেছে, বিজেপিই করেছে। সীমানা পিলার তুলে নির্দিষ্ট জায়গায় বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। কাঁটাতার পিছিয়ে চরমেঘনাকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করার কাজও চলছে।’’
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালে ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে ছিটমহল হস্তান্তর চুক্তি কার্যকর হলেও, কোনও এক অজ্ঞাত কারণে বাদ থেকে গিয়েছিল চরমেঘনা। পরে তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের কাছে গ্রামকে ভারতের মূল ভূখণ্ডে অন্তর্ভুক্তির আবেদন করেন গ্রামবাসীরা। তার পর ভারত অন্তর্ভুক্তি তালিকায় ঠাঁই মেলে গ্রামের। কিন্তু ঠাঁই মেলাই সার, আর সবই যে অমিল! তবুও ভোট দিতে ভোলে না পরবাসীদের নিজভূম চরমেঘনা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy