(বাঁ দিক থেকে) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কার্তিক মহারাজ এবং অধীর চৌধুরী। —ফাইল চিত্র।
রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রমের মতো প্রতিষ্ঠানের সাধু-সন্তদের একাংশের ‘ভূমিকা’ নিয়ে মন্তব্য-বিতর্কে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে অনেকটাই সুর মেলালেন অধীর চৌধুরী। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতিও সরাসরি নিশানা করলেন বহরমপুরের ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের কার্তিক মহারাজকে। তাঁর মন্তব্য, ‘‘সাধু-সন্তের যে রকম চরিত্র হওয়া প্রয়োজন, সেই চরিত্র ওঁর নেই!’’ রাজ্য-রাজনীতির সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে যা নজিরবিহীন বলেই মনে করছেন অনেকে। অধীরকে পাল্টা কটাক্ষ করেছেন কার্তিকও।
মমতা-অধীরের অমসৃণ সম্পর্কের কথা রাজ্য-রাজনীতিতে কারও অজানা নয়। এ বারের লোকসভা ভোটের আবহে তা আরও ‘তীব্র’ হয়েছে। অনেকেরই মত, দেশে বিজেপি-বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’ তৈরি হওয়ার পর প্রাথমিক ভাবে মমতা ‘নমনীয়’ হলেও অধীরের নেতৃত্বাধীন প্রদেশ কংগ্রেসের আপত্তির কারণে পশ্চিমবঙ্গে সেই জোট বাস্তবায়িত হয়নি। বাংলায় লোকসভা ভোটে আলাদা লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মমতা। অন্য দিকে, কংগ্রেস বামেদের সঙ্গে জোট করে ভোটে লড়ছে। ভোটের প্রচারেও লাগাতার মমতাকে নিশানা করেছেন অধীর। পাল্টা আক্রমণ করেছেন মমতাও। বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রে সরাসরি মমতাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়েছিলেন অধীর। ওই আসনে ভোট মিটে গিয়েছে। তার পরেই বিরোধী জোট নিয়ে মন্তব্যে মমতার পাশে দাঁড়িয়ে, অধীরকেই নিশানা করেছিলেন কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে। এর ফলে প্রকাশ্যে এসেছে কংগ্রেস হাইকমান্ড আর প্রদেশ কংগ্রেসের ‘মতবিরোধ’! সেই আবহে কার্তিক মহারাজকে নিয়ে বিতর্কে মমতার সুরে অধীরের বক্তব্যকে অনেকেই তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছেন। অধীর অবশ্য কার্তিক মহারাজের সমালোচনার পাশাপাশি তাঁর সঙ্গে তৃণমূল এবং বিজেপির ‘সম্পর্ক’ নিয়েও কটাক্ষ করতে ছাড়েননি।
সোমবার সাংবাদিক বৈঠকে অধীর বলেন, ‘‘যাঁর কথা বলেছেন, তাঁর পরিচিতি নিয়ে এখানে বহু মানুষের প্রশ্ন রয়েছে। সাধু-সন্তের যে রকম চরিত্র হওয়া প্রয়োজন, সেই চরিত্র তাঁর নেই। উনি সরাসরি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসাবেই এখানকার মানুষের কাছে পরিচিত। উনি কখনও তৃণমূলের, কখনও বিজেপির! উনি কখন কোন দলের সমর্থক, তা নিয়ে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি রয়েছে।’’ কার্তিক মহারাজকে ‘উপদেশ’ও দিয়েছেন অধীর। তাঁর কথায়, ‘‘ধর্মের কথা অন্যকে না-বলে, নিজে শিখুন, নিজে পড়ুন। আপনি আচরি ধর্ম। নিজে আগে ধর্ম পালন করুন, তার পর লোককে শেখান।’’ পাল্টা অধীরকেও বিঁধেছেন ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের বেলডাঙা শাখার অধ্যক্ষ কার্তিক মহারাজ (স্বামী প্রদীপ্তানন্দ)। তিনি বলেন, ‘‘আমি কোনও ডন নই, আমি মস্তান বাহিনী পরিচালনা করি না। আমি হিন্দু সমাজের সন্ন্যাসী। আমি সমাজ, ধর্ম, সংস্কৃতি নিয়ে চলি। হিন্দুরা কোথাও আক্রান্ত হলে আমি চুপ থাকতে পারি না।’’
বিতর্কের সূত্রপাত শনিবার মুখ্যমন্ত্রী মমতার কিছু মন্তব্যে। আরামবাগ লোকসভা কেন্দ্রের কামারপুকুরে সভা করতে গিয়ে মমতা ওই দিন বলেছিলেন, ‘‘সব সাধু তো সমান হন না! সব স্বজন সমান হয় না।’’ এই সূত্রেই বহরমপুরে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের কার্তিক মহারাজের নাম করে মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ ছিল, তিনি বুথে তৃণমূলের এজেন্ট বসতে দেবেন না বলেছেন! আসানসোলের একটি রামকৃষ্ণ মিশন এবং ইস্কনের ভূমিকা নিয়েও সরব হয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী। তাঁর অভিযোগ, দিল্লির নির্দেশে ওই প্রতিষ্ঠানগুলির তরফে বিজেপিকে ভোট দেওয়ার প্রচার করা হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে ভোটের প্রচারে হাতিয়ার করছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
পঞ্চম দফার ভোটের ঠিক আগে রাজ্যে এসে রবিবার পুরুলিয়ার গেঙ্গারা, বাঁকুড়ার ওন্দা এবং মেদিনীপুর লোকসভা কেন্দ্রের খড়্গপুরে তিনটি সভা করেছেন মোদী। তিন সভা থেকেই ‘সাধু-সন্তদের অপমান’ প্রসঙ্গে সরব হন তিনি। খড়্গপুরে মোদী বলেন, ‘‘তৃণমূল মানে সন্ত্রাস, দুর্নীতি, ভাই-ভাইপোতন্ত্র! হিন্দু সমাজকে তারা লাগাতার অপমান করছে। মুখ্যমন্ত্রীর কথায় দেশ ও গোটা বিশ্বের মানবতাপ্রেমী মানুষ দুঃখ পেয়েছেন। তৃণমূলের এক জন বিধায়ক বলেছিলেন, হিন্দুদের জলে ফেলে দেওয়া হবে। সন্তেরা বলেছেন, এই রকম কথা বলবেন না। তখন মুখ্যমন্ত্রী সীমা ছাড়িয়েছেন! রামকৃষ্ণ মিশন, ইস্কন, ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘকে আক্রমণ করছেন। গোটা হিন্দু সমাজকে অপমান করেছেন।’’ ‘তোষণের রাজনীতি’র চেনা অভিযোগের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে তাঁর আরও মন্তব্য, ‘‘নিজের বিধায়ককে একটা শব্দও বলছেন না। শাহজাহানকে বাঁচাতে দিনরাত পরিশ্রম করছেন! ভোটব্যাঙ্কের সামনে নতজানু হয়ে আছে তৃণমূলের সরকার। এরা একটা ভোট পাওয়ারও যোগ্য নয়!’’
প্রত্যাশিত ভাবেই মমতার অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন কার্তিক মহারাজ। তিনি বলেন, “আমি হিন্দু সন্ন্যাসী, কোনও রাজনৈতিক দলের তাঁবেদারি করি না। যে অভিযোগ তোলা হয়েছে, তার প্রমাণ দিতে পারবেন? এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ। এর বিরুদ্ধে আইনি পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে। সঙ্ঘকে যে ভাবে বদনাম করছেন, তার প্রতিবাদ হবে।” মমতার মন্তব্য নিয়ে বিতর্কে তৃণমূল অবশ্য শনিবারই জানিয়েছিল, কোনও প্রতিষ্ঠানকে লক্ষ্য করে কিছু বলা হয়নি। ওই সব প্রতিষ্ঠানের ‘ব্যক্তিবিশেষ’ সম্পর্কে বলা হয়েছে। অর্থাৎ, তৃণমূলনেত্রী রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রম বা ইস্কন সম্পর্কে ‘প্রাতিষ্ঠানিক’ ভাবে ‘রাজনীতি’ করার বা রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার কথা বলেননি। বলেছিলেন ওই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন সাধু-সন্ন্যাসীর কথা। কিন্তু বিতর্ক থামেনি। মমতাকে আইনি নোটিস পাঠিয়েছেন কার্তিক মহারাজ। জানিয়েছেন, ক্ষমা না-চাইলে মানহানির মামলা করবেন।
কিন্তু মমতা তাঁর আগের বক্তব্য থেকে সরে আসেননি। রবিবার বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের মঞ্চ থেকে তাঁকে নিশানা করেছিলেন মোদী। সোমবার সেই বিষ্ণুপুরে দাঁড়িয়েই প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের জবাব দেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘আমি রামকৃষ্ণ মিশনের বিরুদ্ধে নই। কেন আমি একটা ইনস্টিটিউশনের (প্রতিষ্ঠানের) বিরুদ্ধে হব? আর আমি অসম্মানই বা কেন করব? কয়েক দিন আগেও মহারাজ অসুস্থ ছিলেন। আমি তো তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম। গঙ্গাসাগরে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের অফিস আছে। আশ্রম আছে। ওরা এত ভাল! মানুষের কাজ করে, ওরা সত্যি আমাকে ভালবাসে। সেটা নয়। আমি বলেছি দু’-এক জনের কথা। আমি একটি লোকের নাম করে বলেছিলাম। তাঁর নাম কার্তিক মহারাজ। তিনি আমাদের এজেন্ট বসতে দেননি। ভোটের দু’দিন আগে মুর্শিদাবাদে যে অশান্তি হয়েছিল, তার হোতা ছিলেন উনিই। আমি সেই জন্য বলেছিলাম। এবং বলে যাবও।’’
কার্তিক মহারাজকে চ্যালেঞ্জ করেই মমতা বলেছেন, ‘‘ওখানে কিছু লোককে (উনি) খেপিয়েছেন, যাঁরা ছানার ব্যবসায়ী। খবর আমিও রাখি। এলাকায় এলাকায় গিয়ে ধর্মের নামে আপনি বিজেপি করে বেড়ান। আমি বলছি, আপনি করুন! কিন্তু বিজেপির চিহ্নটা বুকে লাগিয়ে রেখে করুন। লুকিয়ে লুকিয়ে কেন? আমি যেটা বলি, আমি প্রমাণ ছাড়া বলি না।’’ আত্মপক্ষ সমর্থনে জনতার উদ্দেশে মমতা প্রশ্ন করেন, ‘‘আমাদের রাজ্য বাংলা। আর সেখানে তৃণমূলের এজেন্ট বসবে না! আর ভোটের দু’দিন আগে দাঙ্গা বাধিয়ে দেবে! তাদের আমি ছেড়ে দেব? আপনারা কী মনে করেন? ছেড়ে দেওয়া উচিত?’’
কার্তিক মহারাজের ‘রাজনীতি’ নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘উনি আগে অধীর (চৌধুরী) করতেন। এখন বিজেপি করেন। মুর্শিদাবাদের যে জায়গাটায়, রেজিনগরে, দু’দিন আগে দাঙ্গা করেছিল, সেইখানটায় ওঁর আশ্রম। উনি আশ্রম চালান। আমার কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু আমি যখন জিজ্ঞাসা করলাম, ওখানে তৃণমূলের এজেন্ট নেই কেন? তখন আমাকে বলল, ওখানে কার্তিক মহারাজ বলেছে, তৃণমূলের এজেন্টকে আমরা বসতে দেব না।’’ সোমবার কার্তিক মহারাজের বিরুদ্ধে অধীরও একই অভিযোগ করেছেন।
তবে গোটা বিতর্কে তৃণমূল ও বিজেপিকে আক্রমণ করতেও ছাড়েননি প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি। দু’দলকেই কটাক্ষ করে অধীর বলেন, ‘‘বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনের নেতাদের আমরা বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন চেয়ারে দেখে থাকি। ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ, রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে বাংলার মানুষের ওতপ্রোত সম্পর্ক। বিশ্ব জুড়ে খ্যাতি। কিন্তু তার মধ্যে কি বিচ্যুতি নেই? নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সেই বিচ্যুতিকে সামনে রেখেই রাজ্যের শাসকদল ধর্মের রাজনীতি করছে। আরা যারা ধর্মকে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার বলে মনে করে, সেটাই রাজনীতির পন্থা মনে করেন, তাঁদের মুখেও ও সব কথা মানায় না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy