সারদা মামলার তদন্ত ভার শেষ পর্যন্ত সিবিআইয়ের হাতেই তুলে দিল সুপ্রিম কোর্ট। শুক্রবার বিচারপতি টি এস ঠাকুর এবং বিচারপতি সি নাগাপ্পনের ডিভিশন বেঞ্চ এই রায় দেয়। সারদা সংক্রান্ত সব নথি সিবিআইয়ের হাতে তুলে দিতে রাজ্য পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছে ডিভিশন বেঞ্চ। সেই সঙ্গে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে সবরকম ভাবে সহযোগিতা করতেও রাজ্য পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। লোকসভা নির্বাচনের শেষ দফার আগে শীর্ষ আদালতের এই রায় নিঃসন্দেহে অস্বস্তিতে ফেলবে রাজ্য সরকারকে।
সারদা কাণ্ডে সিবিআই তদন্ত চেয়ে জনস্বার্থ মামলাটি দায়ের হয় গত বছরের ২০ মে। শুনানি শেষ হয় এ বছরের ১৬ এপ্রিল। ২৩ এপ্রিল ওড়িশা সিবিআই তদন্তে সায় দেয়। আগেই এই মামলায় সিবিআই তদন্ত চেয়েছিল অসম ও ত্রিপুরা সরকার। সারদা ছাড়া এ দিন ওড়িশার আরও ৪৪টি আর্থিক সংস্থার বিরুদ্ধেও সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয় ডিভিশন বেঞ্চ। তাত্পর্যপূর্ণ ভাবে এর মধ্যে ১৭টি সংস্থার রেজিস্ট্রেশন পশ্চিমবঙ্গের। এর মধ্যে সারদাও রয়েছে।
এই কেলেঙ্কারিতে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ কেন সে প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট কয়েকটি কারণের উল্লেখ করেছে। শীর্ষ আদালত বলেছে, এই ব্যাপারে বৃহত্তর ষড়যন্ত্র রয়েছে, এটি দেখা দরকার। টাকার লেনদেন কোন পথে হল তার তদন্ত করতে হবে। আন্তর্জাতিক স্তরেও এর জাল ছড়িয়েছে। দরিদ্র মানুষের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে। সেবি, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, কোম্পানি নিবন্ধকের মতো নিয়ণ্ত্রক সংস্থাগুলি নিয়েও প্রশ্ন আছে। এই সব সংস্থার বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। গোটা অধ্যায়ে বেশ কয়েক জন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। এটি মোট প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারি। এর ফলে ২৫ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। রাজ্য পুলিশ যথাযথ তদন্ত করতে পারেনি বলেও জানায় ডিভিশন বেঞ্চ।
রাজ্য সরকারের তদন্তের তীব্র বিরোধিতা করে মামলাকারীদের তরফে আইনজীবী অশোক ভান জানান, শাসকদলের তরফ থেকে রাজ্যসভায় এমন কয়েক জনকে পাঠানো হয় যাঁরা তেমন বড় মাপের কেউ না হলেও সারদায় উচ্চপদস্থ কর্মী ছিলেন। তাঁর দাবি, এর থেকেই স্পষ্ট হয় সারদা ও শাসকদলের মধ্যে সম্পর্ক। এই অবস্থায় কখনওই রাজ্য সরকারের পক্ষে নিরপেক্ষ তদন্ত করা সম্ভব নয়।
প্রথম থেকেই সিবিআই তদন্তের বিরোধিতা করেছিল রাজ্য। সরকারের পক্ষে সর্বোচ্চ আদালতে জানানো হয়েছিল, যে অন্যান্য রাজ্যে সিবিআই তদন্ত হলেও পশ্চিমবঙ্গে সিবিআই তদন্তের কোনও প্রয়োজন নেই। বিশেষ তদন্তকারী দলই এই ঘটনার তদন্ত করতে পারে। রাজ্যে পঞ্চম দফায় ১৭টি কেন্দ্রের নির্বাচন ১২ মে। তার আগে এই রায় ভোট বাক্সে কী প্রভাব ফেলবে সেটাই দেখার।
কে কী বললেন
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়: সিবিআই কেন, সিবিআইয়ের বাবা তদন্ত করলেও আমার কোনও আপত্তি নেই। আমি তো বেঁচে গেলাম। চার লক্ষ মানুষের টাকা আমরা ফেরত দিয়েছিলাম। এ বার সিবিআই টাকা ফেরত দিক। আমাদের আর কোনও দায়িত্ব রইল না। আমি ও আমার সরকার বেঁচে গেল। এর পর সিপিএম, কংগ্রেস ও বিজেপির ঘরে ঘরে গিয়ে বাংলার মানুষ টাকা চাইবে।
অমিত মিত্র: রায়কে স্বাগত জানাচ্ছে রাজ্য। যে কোনও ব্যাপারে তদন্তের জন্য প্রস্তুত। কোর্টের রায়ে সিটের কাজের প্রশংসা করা হয়েছে।
অধীর চৌধুরী: রায়কে স্বাগত। এই রায়ের পরে শাসক দলের রাজনীতি, গোঁয়ার্তুমি আরও প্রকট হল। তৃণমূল এত দিন সততার নামাবলী গায়ে দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে সর্বস্বান্ত করেছে। সে ক্ষেত্রে তৃণমূল ও তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এটি একটি ব্যক্তিগত পরাজয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নৈতিকতা, বিশ্বাসযোগ্যতা ধুলোয় মিশে গেল।
বিমান বসু: তিন বছর ধরে তৃণমূল কংগ্রেস পাঁকে নিমজ্জিত। সিবিআইয়ের উচিত দোষীদের অবিলম্বে গ্রেফতার করা।
রবিশঙ্কর প্রসাদ: সিবিআই তদন্তের জন্য আগেই রাজ্যকে বলেছিলাম। যেখানে এত লক্ষ আমানতকারী আত্মহত্যা করেছেন, সেখানে আগেই রাজ্যের এ ব্যাপারে রাজি হওয়া উচিত ছিল।
প্রকাশ কারাট: সিবিআই তদন্ত স্বাগত। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধিতা করায় এত দিন সিবিআই তাদের কাজ করতে পারেনি। এই তদন্তের পরে আসল দোষীদের চেনা যাবে। সারদা গোষ্ঠীর যেখানে যত সম্পত্তি আছে বাজেয়াপ্ত করে ২৫ লক্ষ আমানতকারীর প্রাপ্য টাকা ফেরত দেওয়া উচিত।
দীপা দাসমুন্সি: পরিকল্পনামাফিক যাঁরা এই কাজের সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা কেউ রেহাই পাবেন না। আগামী দিনে তাঁদের জেল হবেই। কেউ ছাড় পাবেন না। সত্য এক দিন উদ্ঘাটিত হবেই। এত দিন তৃণমূল এই সত্যকে আড়াল করে এসেছে। যাঁরা গণ্ডগোল পাকাচ্ছেন আগামী ১২ মে তাঁরা যেন নিজেদের আশ্রয় খুঁজে নেন।
শশী তারুর: সারদা-দুর্নীতিতে যাতে দোষীরা চিহ্নিত হয় এবং শাস্তি পায়, সেটাই চাই। ১৮ লক্ষ বিনিয়োগকারী তদন্তে সুবিচার পাক। তাদের টাকা ফেরত আসুক।
অর্পিতা ঘোষ: এই রায়কে স্বাগত জানাচ্ছি। তবে যে ভাবে তদন্ত হচ্ছিল, তাতেও আপত্তির কিছু ছিল না। দেখতে হবে সিবিআই যেন নন্দীগ্রামের মতো কাণ্ড না করে। তদন্ত যেন ঠিকঠাক হয়।
বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য: রাজ্য সরকার রাজ্যের কোষাগার থেকে টাকা দিচ্ছে, এটাও তো একটা কেলেঙ্কারি। এটা নিয়ে ভবিষ্যতে তদন্ত করতে হবে। মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীকে কে বলেছিল এই দায়িত্ব নিতে? এই কেলেঙ্কারি সারদা গোষ্ঠীর। সুতরাং টাকা ফেরত দেওয়ার দায়িত্বও তাদের। টাকা ফেরত দেওয়ার দায়িত্ব সিবিআইয়ের নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy