বয়েস চার। মা মরে গেছে, দুই ভাইবোনও। বাবা আর শায়মা আল-মাস্রি এখনও লড়ছে। গাজা, ১৪ জুলাই। ছবি: রয়টার্স।
কারও গাল দুটো যেন ঠিক ছাল ওঠা আপেল, কেউ ভারী ফুটফুটে কিন্তু পুড়ে গিয়েছে নাক-কান-গলা, কেউ অবাক চোখে তাকিয়ে, কারও চোখে ব্যান্ডেজ, কারও গাল বেয়ে রক্ত, কেউ দু’পা হারিয়ে হাসপাতালের বেডে, কারও মাথায় তখনও গেঁথে রয়েছে বোমার টুকরো এরা সবাই গাজা-র শিশু। কাগজে, মিডিয়ায়, ফেসবুকে, মিছিলের প্ল্যাকার্ডে, আমাদের নিরুপায় মনে এখন এদের নিত্য যাতায়াত। ইজরায়েল আকাশ থেকে বোমা ফেলে উড়িয়ে দিচ্ছে গাজার শত শত মানুষকে। ‘হামাস-ধ্বংস’ মিশন। আর এই মহৎ মিশনের ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’, যাকে আমরা বাংলায় বলি, ‘ও রকম একটু-আধটু হয়েই থাকে’, এই শিশুরা। এ বারের ধ্বংসলীলার শুরুটাও তিন জন ইজরায়েলি কিশোর আর এক জন প্যালেস্টিনীয় কিশোরের খুন দিয়ে। কোনও পক্ষই কমতি নয়। এ-ও বদলা নেবে, ও-ও।
যুদ্ধে, দাঙ্গায়, হিংস্র আগ্রাসনে শিশুহত্যার কাণ্ড চলেছে আদিকাল থেকেই। ইতিহাস বেয়ে এখন এই অবস্থায় পৌঁছেছে। এবং সে ইতিহাস কেবল আফ্রিকা বা এশিয়ার নয়। বসনিয়া সে দিনের ঘটনা। কিংবা, জার্মানি? ইহুদি নিধনের কালে কত শিশু মারা গিয়েছিল, তার সত্যিকারের হিসেব আছে আমাদের কাছে? ইউরোপের একটা মিউজিয়মে রাখা আছে কয়েক হাজার ছোট্ট ছোট্ট পায়ের জুতো। ইজরায়েলের সংগ্রহশালায় একটা কাচের বাক্সে খুব যত্নে রাখা আছে একটা ফ্রক আর এক পাটি জুতো। মেয়েটি মুছে গিয়েছিল কত অনায়াসে, সে কথা ওই বাক্স থেকে এসে বুকের মাঝখানে আছড়ে পড়ে। যুগ যুগ ধরে কোটি কোটি ভাইবোনের প্রতিনিধিত্ব করে চলেছে সে। শিশুহত্যা চলেছে এখনও, এই মুহূর্তেও। কেবল সিরিয়াতেই কিছু না হলেও দশ হাজার শিশু মারা গিয়েছে। এখনও সেই সংখ্যা বেড়ে চলেছে। সুদান, শাদ, সোমালিয়া যুদ্ধে, গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে, উগ্রপন্থার কারণে ত্রাণ পৌঁছনোর অভাবে বাচ্চাগুলো মরে যাচ্ছে তো মরেই যাচ্ছে। এখন তো আবার ইরাকও যোগ হয়েছে, আশা করা যায় রাষ্ট্রপুঞ্জের কাছ থেকে আর কিছু দিনের মধ্যেই চোখ কপালে তোলার মতো মৃত-শিশুর সংখ্যাটা আমরা পেয়ে যাব।
যুদ্ধের সিদ্ধান্ত, কূটনৈতিক প্যাঁচ, যতই বড়রা ঠিক করুক, যুদ্ধ আসলে কেবল বড়দের জন্য নয়। আর, যে বড়রা যুদ্ধের বিরুদ্ধে, তারা তো তবু অমত দিতে পারে। কিন্তু এই বাচ্চাগুলো কী পারে? ওরা পারে কেবল অসহায় ভাবে মরতে, অনাথ হতে, পঙ্গু হতে, মা-বাবা-দেশ সব কিছু থেকে আলাদা হয়ে রিফিউজি হতে, ধর্ষিত হতে, শিশু-সৈনিক হতে, ধীরে ধীরে অন্ধকারে তলিয়ে যেতে। হিউম্যানিয়াম নামক একটি আন্তর্জাতিক এনজিও শিশুদের নিয়ে কাজ করে। তাদের ২০১২ সালের রিপোর্ট বলছে, ২০০২ থেকে দশ বছরে এক কোটি শিশু যুদ্ধের কারণে মারা গিয়েছে। এক কোটি, সংখ্যাটার বিশালতা আমরা ভাল করে বুঝতেও পারি না।
নব্বইয়ের দশকে শিশুদের ওপর যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে কাজ করেছিলেন আফ্রিকার মানবাধিকার আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী গ্রাচা মাচেল। তিনি বিশেষ ভাবে বলেছিলেন শিশুসৈনিকদের কথা। সৈনিক কথাটার একটাই অর্থ এদের ক্ষেত্রে যুদ্ধ বা উগ্রপন্থার নামে এরা বেঘোরে প্রাণ দেয়। একে-৪৭ বা ৫৬ বা আরও বড় কিছু চালাতে পারলেই তো আর কেল্লা ফতেহ্ করা যায় না। মহাভারতও তা-ই বলে। অভিমন্যু তো চাইল্ড-সোলজার হিসেবেই অস্ত্রশিক্ষা রপ্ত করেছিল। পরিণতি? সাত জন মহারথী মিলে তাকে নিকেশ করে দিল। এই যে সাংঘাতিক চক্রব্যূহটা দুনিয়া জুড়ে আমরা রচেছি শিশুসৈনিকদের জন্য, তার থেকে বেরিয়ে আসার কৌশল তো এরা জানে না। একে-৪৭ ধরার আগে বাবার হাত ধরে বাজার যেত সে। তাই এই সব মহারথীর কবল থেকে পালিয়ে আসবে কী করেই বা? এক শিশুসৈনিক বলেছিল, ‘আমি যদি বন্দুক না চালাই, তা হলে যারা বন্দুক দিয়েছে, তারাই আমায় মেরে ফেলবে।’ অন্য দেশে খুঁজতে হবে না, ছত্তীসগঢ়ে মাওবাদী আন্দোলন রুখতে সরকার তৈরি করেছিল সালওয়া জুড়ুম। গ্রামবাসীদের হাতে বন্দুক তুলে দিয়েছিল মাওবাদী আক্রমণ থেকে নিজেদের বাঁচাতে। সালওয়া জুড়ুম-এর শিশু শাখাটির নাম বাল মণ্ডল, যে শাখার সদস্যদের বয়স ১০-১২, আর তারা চালাচ্ছে বন্দুক। মারছে, মরছে। তবে শুধু ছত্তীসগঢ় নয়। মনিপুর, অসম, অন্ধ্রপ্রদেশ, কাশ্মীর, মেঘালয়, ত্রিপুরা, সিকিম, সব জায়গায় শিশুসৈনিক নিয়োগ চলছে। কখনও সরকার পক্ষের হয়ে, কখনও সরকার-বিরোধী হয়ে এরা যুদ্ধ করছে। এমনকী পাঁচ বছরের শিশুও স্পেশাল পুলিশ অফিসার। আর বছর চোদ্দো বয়সটা তো সবচেয়ে আকর্ষক। ধরা পড়লে আঠারো বলে চালিয়ে দিয়ে অসুবিধে নেই। সারা বিশ্ব এমন রে রে বেগে এগোচ্ছে, কেবল ভারত কি পিছিয়ে থাকবে?
শিশুরা কেবল কোল্যাটারাল ক্ষয়ক্ষতি বা শিশুসৈনিক নয়, অনেক যুদ্ধেই তারা সরাসরি শত্রুর টার্গেট। ১৯৯৪। আফ্রিকার রোয়ান্ডায় টুটসি জনজাতির মানুষের বিরুদ্ধে ঘোষিত হয়েছিল ‘বাচ্চা মেরে ফেলো’ মিশন। রাজধানী কিগালি শহরে রেডিয়ো মিল, যে রেডিয়ো স্টেশন চলার মেয়াদ ছিল কেবল একটি বছর, যে স্টেশন মারফত অহরহ ছড়িয়ে পড়ত সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণা-বার্তা, সেখান থেকে একটি সাংকেতিক প্রচার করা হয়। বলা হয়, ‘বড় ইঁদুরদের মারতে হলে আগে ছোট ইঁদুরদের মারতে হবে।’ এর চার মাসের মধ্যে প্রায় তিন লাখ টুটসি বাচ্চাকে কেটে, কুপিয়ে, গুলি করে বা পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল। রাষ্ট্রপুঞ্জের হিসেব বলছে, তাদের মধ্যে সদ্যোজাতরাও ছিল। বে-হিসেব হয়তো আরও বেশি। রোয়ান্ডার কুখ্যাত গণহত্যার অংশ এই শিশু-সাফাই। সত্যিকারের জয়, সর্বতোভাবে অধিকার, পুরোপুরি রাজ করতে চাইলে তো কেবল শত্রুপক্ষের প্রাপ্তবয়স্কদের মেরে ফেললেই চলবে না, ময়দান পরিষ্কার করতে হলে দ্রৌপদীর পাঁচ ছেলেকেও রাতের অন্ধকারে কেটে ফেলতে হবে। ছোট ছোট শিশুদের ভবিষ্যৎ-শত্রু হিসেবে গণ্য করতে হবে, সুতরাং বলি চড়াও। রোয়ান্ডায় এত মানুষ মারা যাওয়ার পরও রেডিয়ো মিল একটি সম্প্রচারে বলেছিল, ‘কিছু শত্রু তোমরা মিস করেছ। ফিরে যাও। শেষ করো তাদের। কবর এখনও ভর্তি হয়নি।’
আসলে, বাচ্চাদের টার্গেট করার সবচেয়ে বড় লাভ হল, ওরা বড় অসহায় টাইপ। কিছু বুঝতে পারে না, পালাতে পারে না, আত্মরক্ষা করতে পারে না, সবচেয়ে বড় কথা, ঘুরে মারতে পারে না। আর তাই সবচেয়ে নিরাপদ নিশানা। আট বছরে কী এমন আর পালোয়ন হতে পারে যে হাতটা মুচড়ে ভেঙে দিলে, কিংবা পেটে কষিয়ে লাথি মারলে বা যৌনাঙ্গে সিগারেটের ছ্যাঁকা দিলে, মুখ চেপে ধর্ষণ করলে সে চারটে কারাটে-র মার ফিরিয়ে দিতে পারবে? পারবে না বলেই এদের ওপর বেশ নিরাপদে বিষ উগরে দেওয়া যায়।
আচ্ছা, যারা এদের মারে তারা কী পায়? পৈশাচিকতার সর্বোচ্চ স্তরে উত্তরণ। আলবাত! ক্ষমতার খেলায় এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি কী-ই বা হতে পারে? এর পর তো লজ্জা থাকে না, বেদনা থাকে না, আবেগের একটা দানাও আর পড়ে থাকে না। সবচেয়ে কোমল, সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে মিঠে এমন কিছুকে দুমড়ে-মুচড়ে দলা পাকিয়ে মাড়িয়ে যেতে পারলে বাকি হৃৎপিণ্ডে এমন আর কিছুই থাকে না যা দিয়ে তৈরি করা যায় পিছুটান, যা দিয়ে তৈরি করা যায় মন, যা দিয়ে তৈরি করা যায় মানবিকতা। আর তাই ওই পিশাচদের মানবতায় ফেরানোর চেষ্টা করে কোনও লাভ নেই, সেই ভাবনাটাই নেহাত বাড়াবাড়ি।
তার চেয়ে আমরা বরং গাজার ইসমায়েল আবু মোসাল্লেন-এর পাশে থাকি, যিনি হাসপাতালের দেওয়ালে হেলান দিয়ে কাঁপছিলেন। কারণ এ বার তাঁকে তিন সন্তানের কবরের ব্যবস্থা করতে হবে। আর অন্য যে তিনটে শিশু পায়রাকে দানা দিচ্ছিল, তাদেরও নিঃশেষ করেছে ইজরায়েলি মিসাইল। যে চার জন ভাই খুব খেলছিল, প্রথম রকেটটা তাদের কিছু করতে পারেনি, তারা পালিয়ে বাঁচতে গিয়েছিল। পারেনি। দ্বিতীয়টা অব্যর্থ লক্ষ্যবেধে মিশন সার্থক করেছে। এই দুরন্ত বাচ্চাদের মা’রা তখনও অপেক্ষা করছিল, ডানপিটেগুলো কখন বাড়ি ফিরবে। এলে আজ বেশ করে বকে দেব। কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই, এই সময় খেলতে গেছে! কিন্তু সেটি আর হবার নয়। সারা জীবন, মা, তুমি ফুঁপিয়ে মরো। বেঁচে থাকা ইস্তক কাকুতিমিনতি করো বাবুটা, একবাট্টি ফিরে আয় না, সারা দিন খেলতে দেব বাবা। টিভি দেখবি? তাই দেব মানিক আমার। এক বার মা’র কথা শোন। কম্পিউটার-গেম খেললেও কিছুটি বলব না। এক বার ফিরে আয়। দুধ না খেলেও বকব না, পড়াশোনা না করলেও বকব না। বোনের সঙ্গে ঝগড়া করলেও বকব না। কেবল মা’র কাছে আয়। আমি আমার মধ্যে লুকিয়ে রেখে দেব সোনা তোকে।
পাউরুটি আনতে গিয়ে ফেরেনি যে জন, পাঁচ মাসের যে অমৃতের কন্যার মাথায় বিঁধে গেল মারণ-শেল, যে ছ’বছরের ভ্যাবলাটা এখন অন্য দেশে রিফিউজি কাকে ঠিক বলা যায়, বোঝানো যায়, এদের কথা? আর ওই যে মা-বাবাগুলো? তাদের জন্য কী করতে হবে? ত্রাণ? ডোনেশন? রিফিউজি ক্যাম্প? অর্থ সাহায্য? সাইকায়াট্রিক হেল্প? কিন্তু যে মা সারা জীবন বালিশের নীচে লাল পশমের ফুলতোলা জুতোজোড়া নিয়ে শোবে প্রতিটা রাত, তাকে এই সব সাহায্য সোয়াস্তি দেবে তো?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy