Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

বিধান রায়কে নতুন করে চিনতে হবে

কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিধান রায় আজ্ঞাবহ ভৃত্য ছিলেন না। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষালগাঁধীজি এক বার বিধানচন্দ্র রায়কে বলেছিলেন, “আহা আপনি যুক্ত প্রদেশের (অধুনা উত্তরপ্রদেশ) গভর্নরের পদগ্রহণ করতে রাজি হলেন না। আমি ভেবেছিলাম, আপনাকে ‘ইওর এক্সেলেন্সি’ বলে ডাকার সুযোগ পাব। তা হতে দিলেন না!” বিধানবাবু হেসে জবাব দেন, ‘‘আমি আপনাকে আরও ভাল বিকল্প দিতে পারি। আমি পদবীতে রয়, তাই আপনি আমাকে রয়্যাল বলতে পারেন। আর যে হেতু অনেকের চেয়ে লম্বা, সে হেতু আপনি আমাকে রয়্যাল হাইনেস বলতে পারেন! সেটা কিন্তু যথার্থই হবে।’’ সে দিন বিধান রায় গভর্নর হতে রাজি হননি।

শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০১৪ ০০:১০
Share: Save:

গাঁধীজি এক বার বিধানচন্দ্র রায়কে বলেছিলেন, “আহা আপনি যুক্ত প্রদেশের (অধুনা উত্তরপ্রদেশ) গভর্নরের পদগ্রহণ করতে রাজি হলেন না। আমি ভেবেছিলাম, আপনাকে ‘ইওর এক্সেলেন্সি’ বলে ডাকার সুযোগ পাব। তা হতে দিলেন না!” বিধানবাবু হেসে জবাব দেন, ‘‘আমি আপনাকে আরও ভাল বিকল্প দিতে পারি। আমি পদবীতে রয়, তাই আপনি আমাকে রয়্যাল বলতে পারেন। আর যে হেতু অনেকের চেয়ে লম্বা, সে হেতু আপনি আমাকে রয়্যাল হাইনেস বলতে পারেন! সেটা কিন্তু যথার্থই হবে।’’ সে দিন বিধান রায় গভর্নর হতে রাজি হননি। পরবর্তী কালে তিনিই হন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। ১৯৪৮ সালে প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষকে সরিয়ে তাঁকেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী করা হয়।

ভাবতে পারেন, বিধান রায় যদি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী না হতেন! কোনও সন্দেহ নেই ইতিহাস অন্য পথে হাঁটত। বিধানবাবু এক জন বহুমুখী সক্রিয় ব্যক্তি ছিলেন। ভারী শিল্প এবং সমস্ত নতুন নতুন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর, সবই তো ব্যক্তিগত ভাবে তাঁর নিজের হাতে করা।

১ জুলাই তাঁর জন্মদিন, তাই আবার একটু ইচ্ছা হল, বিধান রায়কে নিয়ে পড়াশোনা করি। কিন্তু ওই এক বাঙালি জীবনের রহস্য! বিধান রায়কে নিয়ে গবেষণা, বইপত্র খুবই কম।

নেতাজি সুভাষ বসুকে নিয়ে বাঙালি পাঠকের যে বাজার, যে আগ্রহ, যত বই, তার ভগ্নাংশও বিধান রায়ের জন্য নেই। বিধান রায়ের জীবন পর্যালোচনা করলে কিন্তু দেখা যায়, আজ যে আধুনিক বাংলায় বসবাস করি সেটা কিন্তু বিধানবাবুর নিজের তৈরি। তা কলকাতা বন্দর হোক, লবণহ্রদ বা কল্যাণীর মতো উপনগরী হোক, দুর্গাপুর-আসানসোলের মতো শিল্পাঞ্চল হোক, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে কলকাতার বিমান সংযোগ হোক, সব কিছুরই স্থপতি বিধান রায়।

যশোহরের রাজা প্রতাপাদিত্য, যিনি বিখ্যাত বারো ভুঁইঞার এক জন ছিলেন, বিধানবাবু সেই পরিবারের সদস্য। ব্রাহ্ম পরিবারের সন্তান। বাবা সরকারি অফিসার ছিলেন। এ হেন বিধান রায় যে কলকাতার এক লম্বা মানুষ ছিলেন তা-ই নয়, ওঁর জীবনী অনুধাবন করে তিনটি জিনিস আমার মনে হয়েছে। প্রথমত, বিধান রায়ের সঙ্গে নেহরু ও গাঁধীর এক প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল। বিধান রায় বহু বিষয়ে নেহরুর সঙ্গেও ঝগড়া করার হিম্মৎ রাখতেন। বহু কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে তো নানা বিষয়ে বকেও দিতেন। এর ফলে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিধান রায় আজ্ঞাবহ ভৃত্য ছিলেন না। ইন্দিরা যুগে পরবর্তী কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রীদের কী দশা হয়েছিল, আমরা দেখেছি।

দ্বিতীয়ত, বিধান রায় শুধু যে এক জন পেশাদার রাজনীতিবিদ ছিলেন তা নয়। তিনি বিশিষ্ট চিকিৎসকও ছিলেন। জগৎজোড়া তাঁর খ্যাতি। কেনেডির স্বাস্থ্য পরীক্ষা পর্যন্ত করতে হয়েছিল তাঁকে। তা ছাড়া, ঐতিহাসিক ভাবে সে সময় কলকাতার রাজনৈতিক গুরত্বও ছিল অনেক বেশি। তাই সে সময়ে কলকাতার বিধান রায়ের সঙ্গে দেখা করতেই পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে রাষ্ট্রনেতারা আসতেন। মিশরের প্রেসিডেন্ট কর্নেল নাসের, রাশিয়া থেকে ক্রুশ্চেভ— কে না এসেছেন তখন।

হাওড়ার মালিপাঁচঘড়ায় একটি হাসপাতালের উদ্বোধনে বিধানচন্দ্র রায়।

তৃতীয় একটি বিষয় আমার মনে হয়েছে, বিধানবাবু খুব সংঘাতে গিয়ে লড়াই চালিয়ে কাজ করার পক্ষে ছিলেন না। এ ব্যাপারে সুভাষবাবু অনেক বেশি আবেগপ্রবণ ছিলেন। বিধানবাবু গাঁধী-সুভাষ, দেশবন্ধু-গাঁধী— এ সব পারস্পরিক টেনশনেও নিজে কোনও পক্ষেরই বিরাগভাজন হতেন না। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক ছিল অনবদ্য। রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রশ্নে মতপার্থক্য থাকলেও তিনি শ্যামাপ্রসাদবাবুর উপর বিশেষ ভাবে নির্ভরশীল ছিলেন। কেন্দ্রীয় শিল্পমন্ত্রী হিসাবেও তাঁকে বিধানবাবু কাজে লাগাতেন।

বিধানবাবুর পরে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, যে সিদ্ধার্থকে বিধানবাবুই রাজনীতিতে এনেছিলেন এক যুবক-মুখ তুলে আনার জন্য। তার পর জ্যেতি বসুর দীর্ঘ অধ্যায়ের থেকে আজকের বাংলা। এক ক্রমিক অধঃপতনের ইতিহাস। বিধানবাবু যা করে গিয়েছেন, তা করে গিয়েছেন। তার পর আর কী হয়েছে? তবু বুদ্ধবাবু সিঙ্গুরে টাটার কারখানা করতে চেয়েছিলেন। সেটিও রাজনৈতিক বিতর্কে বাস্তবায়িত হয়নি।

কয়েকটি নমুনার উল্লেখ করা যাক। কোথাও তিনি সফল হয়েছিলেন, কোথাও হননি।

১) বজবজে অথবা রাজ্যের কোনও উপযুক্ত স্থানে তেল শোধনাগার করতে চান তিনি। এই নিয়ে অসম এবং বিহার নিজেদের মধ্যে রাজনীতি শুরু করে। বারাউনিতে পূর্ব ভারতের তেল শোধনাগার তৈরি হয়।

২) দার্জিলিঙে দেশের প্রথম পর্বতারোহণ শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা।

৩) কলকাতার পর হলদিয়া নদী বন্দর।

৪) ফরাক্কা ব্যারাজ।

৫) দুর্গাপুর-আসানসোল শিল্পাঞ্চল।

৬) কলকাতা থেকে ইস্ট ইন্ডিয়ান রেল ও বেঙ্গল নাগপুর রেলের সদর দফতর বিলুপ্ত করে দুই রেলের বহু বিভাগ উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছিল। শ্যামাপ্রসাদ দিল্লিতে গোপন সূত্রে তা জানতে পেরেই জানিয়ে দেন বিধান রায়কে। তার পর দু’জন মিলে লড়াই করে তা থামান। রেলওয়ের পুনর্বিন্যাস হয় বটে, তবে তা হয় বিধান রায়ের শর্ত মেনে। তাতে উত্তর-পূর্বাঞ্চল রেলের বড় অংশ আবার পূর্ব রেলের অধীনে কলকাতার হাতে আসে। বিধানবাবুর সমর্থন নিয়ে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ধর্মঘট ও হরতাল ডেকেছিলেন।

প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো এলে বিধানবাবু তাঁর সঙ্গে গ্যাসভিত্তিক শিল্প সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেন। দুর্গাপুর উপনগরী নির্মাণ এবং তার সম্প্রসারণ তো এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত। দুর্গাপুরের শিল্পকেন্দ্রগুলিকে ঘিরে উপনগরীকে গড়ে তুলতে যে ধরনের রাস্তা, পার্ক, ক্রীড়া উদ্যান, বেচাকেনার শ্রেণিবদ্ধ দোকান-বাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির নকশা— সমস্ত খুঁটিনাটি বিধান রায় নিজের চোখে দেখে সিদ্ধান্ত নেন। সময় ও জনসংখ্যার সঙ্গে তাল রাখতে দুর্গাপুর রেলস্টেশন সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন তিনি। জিটি রোড থেকে প্রশস্ত চার লেনের সড়ক, দুর্গাপুর স্টেশনে রেললাইনের উপরে যে ওভারব্রিজ নির্মাণ করা হবে তার খরচ রেল, পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও দুর্গাপুর ইস্পাত নির্মাণ কর্তৃপক্ষ বহন করবেন। ওভারব্রিজ তৈরির এক-তৃতীয়াংশ ব্যয়ভার বহন করতে রাজি হলেও কেন্দ্র পশ্চিবঙ্গ সরকারকে জানিয়ে দেয়, এত টাকা কেন্দ্রের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। বিধানচন্দ্র এতই চটে যান যে তিনি সঙ্গে সঙ্গে তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী টি টি কৃষ্ণমাচারি-কে ফোন করে বলেন, “তোমরা দিল্লির নেতারা কলকাতার মধু নিতে খুব পটু আর পশ্চিমবঙ্গকে দেওয়ার ব্যাপারে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠি? এ ভাবে চলবে না। আমি জওহরকে বলছি।” ব্যস। এর পর নেহরুর কাছে নালিশ এবং ফের রাজ্যের জন্য অর্থ বরাদ্দ। বিধাননগরে থেকে দণ্ডকারণ্য প্রকল্প, সবই ছিল বিধানবাবুর ভাবনা।

আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ভবন উদ্বোধনে।

এমনকী, এ কথাও অনেকে জানেন না যে দিল্লিতে রাজ্য সরকারের অতিথিশালার জন্য জমি কিন্তু প্রথম আদায় করেন বিধানবাবু। দিল্লিতে এসে হয় গাঁধীর কাছে থাকতেন অথবা তাঁর এক চিকিৎসক বন্ধুর বাড়ি। এক বার বৈঠক করতে অনেক অফিসার একসঙ্গে আসেন। তখন থাকার খুব অসুবিধা হয়। তখনই বিধান রায়ের মাথায় আসে বঙ্গভবন গড়ার কথা। বাংলাকে দেখে পরে অন্য রাজ্যও একই ভাবে ভবন বানায়। মজার ব্যাপার কি জানেন? সে দিন বিধানবাবু যখন বঙ্গভবন তৈরির কথা বলেন, তখন বিরোধী নেতারা প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, এ সব হচ্ছে মুখ্যমন্ত্রীর আমোদ-প্রমোদের জন্য। সুভাষচন্দ্র বসুর ঐতিহাসিক অবদানকে কোনও ভাবে খাটো না করেই বলব, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সর্বভারতীয় রাজনীতি নিয়ে অনেকে ব্যস্ত ছিলেন। ছিলেন অনেক আবেগপ্রবণ। কিন্তু বিধানবাবু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদেই থাকুন বা কলকাতা পুরসভার মেয়র— যখনই যে পদে থেকেছেন, তাঁর সেরাটা দেওয়ারই চেষ্টা করে গিয়েছেন। উপাচার্য থাকার সময়ে শিক্ষা বিল নিয়ে যেমন ভেবেছেন, তেমনই মেয়র থাকাকালীন কলকাতার জলনিকাশি ব্যবস্থা নিয়ে চিন্তা করেছেন। সে দিন এ ভাবে রাজ্যটাকে নিয়ে আর কেউ ভেবেছি কী?

দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় প্রয়োজনের অতিরিক্তি সোভিয়েত মডেল অনুসরণ করে শিল্পায়নের চেষ্টার প্রশান্ত মহলনাবিশের বিরোধিতা করেন বিধানবাবু। কেন্দ্র-রাজ্য কর রাজস্বের অসম বণ্টন নিয়েও তিনি আওয়াজ তোলেন।

এত লড়াই করলেও বিরোধীরা, মূলত কমিউনিস্টরা প্রচার চালাতেন, বিধানবাবু অভিজাত ভোগী জীবনে অভ্যস্ত, মদ্যপান করেন। প্রমোদে ব্যস্ত। বিধানবাবুর জীবনীকার কে পি থমাস পরে জানিয়েছেন, বিধানবাবু মদই খেতেন না। অপপ্রচার কাকে বলে!

আমাদের যাদের শিকড় আজ বাংলার মাটিতে, তাদের বোধহয় আরও বেশি করে, বিশেষত নতুন প্রজন্মের বিধানবাবুকে নিয়ে পড়াশোনা করার সময় এসেছে।

গ্রন্থঋণ

১) কে পি থমাস— ডঃ বি সি রায়

২) সরোজ চক্রবর্তী— ডঃ বি সি রায় অ্যান্ড আদার চিফ মিনিস্টারস

৩) অশোককুমার কুণ্ডু— ডঃ বিধান রায় (এনবিটি, ১৯৮৮)

৪) নীতিশ সেনগুপ্ত— ডঃ বিধানচন্দ্র রায় (২০০২)

৫) জ্যোতিবাবুর রচনাবলি (বিধানসভায় বিধানবাবুর সঙ্গে তাঁর বিতর্ক)

অন্য বিষয়গুলি:

jayanta ghosal bidhan chandra roy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE