বিপন্নতা। মেদিনীপুর, ২০১৩। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল।
স্বাস্থ্যে প্রগতির হাত ধরে এ দেশের মানুষের গড় আয়ু এখন প্রায় সত্তর ছুঁইছুঁই। বয়সে প্রবীণ, কিন্তু ভাবনায় স্থবিরতা নেই, এ রকম মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে প্রতিদিন। তাঁদের প্রভাতী পথচলা এবং কথা বলার আসরে মাঝেমধ্যেই অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিতে শাণিত কিছু আলোচনা উঠে আসে, যা অনেক দূর পর্যন্ত ভাবতে সাহায্য করে। কানে ঢুকলেও মাথায় দোলা দেয় না এ রকম নাগরিক শব্দাবলিতেই যখন আমরা অভ্যস্ত, তখনও পথচলতি কানে আসা প্রাসঙ্গিক নানা প্রশ্ন মগজে কড়া নাড়ে।
এ রকমই এক আলোচনার বিবেচ্য বিষয় ছিল চিকিত্সার খরচ। হরেক জিনিসের মূল্যবৃদ্ধিতে অবরোধ, মিটিং করার আবাল্য লালিত সংস্কৃতিতে এখনও চিকিত্সার আকাশছোঁয়া দামের বিষয়টা সুর তোলে না কেন? স্বাস্থ্যক্ষেত্রে আরও বেশি সরকারি বরাদ্দের দাবি এ দেশের কোনও ভোটে ওঠে না কেন? জীবন বাঁচাতে গিয়ে উন্নত চিকিত্সার মোহময় জাঁতাকলে সব-খোয়ানো মানুষজনেরা ফেসবুকে অন্তত একটা অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন না কেন?
প্রবীণদের চিন্তার সঙ্গে তথ্যের তাল মেলানো যেতেই পারে, এবং তা যথেষ্টই বাঙ্ময়। এ দেশের চিকিত্সা ব্যবস্থা এই মুহূর্তে অনেকাংশেই ব্যক্তিগত আর্থিক সঙ্গতির উপর নির্ভরশীল। তথ্য বলছে, চিকিত্সার খরচের অন্তত ৭০ শতাংশ গাঁটের কড়ি, বাকিটা সরকারের বদান্যতায় চুঁইয়ে পড়া। সরকার বাহাদুরও এখন প্রেরণা হারিয়েছেন চিকিত্সা ব্যবস্থা পরিচালনায়। বেসরকারি ব্যবস্থার উন্নত পরিচালন পদ্ধতি ও দৃশ্যত প্রতীয়মান সাফল্যের খতিয়ান সরকারের পরিচালকদের মধ্যেও ক্রমাগত এই ধারণার ভিত্তি দৃঢ় করেছে যে, সরকারি কর্মীদের পিছনে সময় ও অর্থব্যয়ের থেকে সরকারি চিকিত্সা ক্ষেত্রেও বেসরকারি উদ্যোগীরা অংশগ্রহণ করলে আর্থিক সাশ্রয় হবে, সামাজিক সুফলও পাওয়া যাবে।
এরই পাশাপাশি ফি বছর চিকিত্সার খরচ জোগাতে গিয়ে দরিদ্রতর হচ্ছেন দেশের প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ। চিকিত্সার প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে ধারদেনা করেন অন্তত ত্রিশ শতাংশ মানুষ। প্রয়োজন সত্ত্বেও চিকিত্সা করানোর কথা ভাবতে পারেন না গ্রামের পাঁচ শতাংশ মানুষ। সব মিলিয়ে শারীরিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা এবং সুস্থ, সক্ষম জীবনযাপনের জন্য দায়বদ্ধ যে স্বাস্থ্যব্যবস্থা, তা এই মুহূর্তে এই দেশের মানুষের আর্থিক এবং সামাজিক সুরক্ষার অন্যতম বাধা হিসেবে উঠে আসছে। ব্যক্তিগত কিংবা ছোটখাটো বেসরকারি উদ্যোগ এবং সর্বব্যাপী সরকারি উদ্যোগের বাতাবরণে দীর্ঘকাল ধরে যে ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, সেখানে এখন কর্পোরেটের আধিপত্য ক্রমশ বাড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে তাই স্বাস্থ্যে সংস্কার, মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার সরকারি দায়বদ্ধতার প্রশ্নগুলিও আরও বেশি করে আলোচনায় আসছে।
স্বাস্থ্যে আমাদের দেশে সরকারি বিনিয়োগ তাইল্যান্ডের এক-তৃতীয়াংশ, শ্রীলঙ্কার অর্ধেক। বিনিয়োগ বাড়ানোর দিকে সরকারের নজর দেওয়ার প্রশ্নে কোনও দ্বিমত নেই। পাশাপাশি দেখা দরকার, চিকিত্সা সংক্রান্ত বিপর্যয়ের হাত থেকে দেশের মানুষকে বাঁচানোর জন্য সরকার কী করছে এবং কী ভাবে সেই বন্দোবস্ত আরও সুচারু করা যায়। সরকারের ভাবনা ও কর্মপদ্ধতিতে খামতির জায়গাগুলোই বা কী কী? অবশ্যই এ ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে উঠবে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা যোজনা। প্রান্তিক, দারিদ্র সীমার নীচে থাকা মানুষজনকে নির্দিষ্ট কিছু হাসপাতাল-কেন্দ্রিক চিকিত্সার খরচ দেওয়ার এই কর্মসূচি আরও বড় সামাজিক সুরক্ষার বার্তাবহ হোক, এটাই কাম্য। এর পাশাপাশি এটাও ভাবা দরকার যে, ‘লাভ’ এবং ‘লোভ’-এর সমন্বয়ে যাঁরা চিকিত্সা বিক্রি করেন, সরকারের কল্যাণ কর্মসূচির জন্য ব্যয় করা অর্থ যেন তাঁদের স্ফীত করার কাজে না লাগে।
এই প্রশ্নটা উঠছে এ কারণেই যে, কর্মসূচিটির এখনকার সামগ্রিক বিন্যাসে বেসরকারি নির্ভরতার দিকটা প্রকট হয়ে উঠছে। এটা ঠিকই যে, দেশের চিকিত্সা ব্যবস্থার বর্তমান অবস্থায় বেসরকারি অংশগ্রহণের প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু কল্যাণ কর্মসূচিতে বেসরকারি সহযোগিতা কী ভাবে ব্যবহার করা যাবে, সে ব্যাপারে পরিষ্কার বিধি ও বাঁধন থাকা দরকার। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে কেউই সমাজসেবা বা দানধ্যান আশা করেন না। কিন্তু দেশের অগণিত শিক্ষারিক্ত মানুষের স্বাস্থ্যের দেখভাল করার প্রধান দায়িত্ব যদি তাঁরা পান, তা হলে তাঁদের লাভের কড়ি গুনতে গিয়ে ‘সুরক্ষা’র ক্ষেত্রে যে বিপত্তি ঘটতে পারে, তা সহজেই ভাবা যায়। অসচল সরকারি প্রতিষ্ঠানের ভার এবং ভর বইতে গিয়ে ক্লান্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এই নতুন পথে বড় বেশি নুইয়ে পড়ছে বলেই এ শঙ্কা জাগছে। রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা যোজনার বর্তমান অবস্থাতেও এর প্রতিফলন যথেষ্টই আছে। এটাকে নীতির ব্যর্থতা হিসেবে না দেখে প্রয়োগের ভুল হিসেবে দেখাটাই দরকার। প্রয়োজন সরকারি ক্ষেত্রের আরও বেশি অংশগ্রহণ। সে জন্য সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে।
আরও কতকগুলি বিষয়ে ভাবনাচিন্তাও জরুরি। রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা যোজনা এই মুহূর্তে হাসপাতালের অন্তর্বিভাগের কিছু চিকিত্সার ব্যয় বহন করে থাকে। দেশের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত খরচের হিসাবনিকাশ কিন্তু বলে, মানুষ চিকিত্সার জন্য মোট যত খরচ করেন, তার প্রায় সত্তর ভাগ যায় আউটডোর চিকিত্সায়। যদি আর্থিক দুর্গতি লাঘব করতে হয়, বিপর্যয় সৃষ্টিকারী চিকিত্সার খরচ থেকে সুরক্ষা দিতে হয়, তা হলে আউটডোর চিকিত্সাকে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমার আওতায় আনা জরুরি। তাতে আরও একটা লাভ হতে পারে। এই প্রকল্পের প্রাথমিক দুর্বলতার অন্যতম হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় হাসপাতালে ভর্তি ও অস্ত্রোপচার। এ রকম ভাবেই মহিলাদের ঋতুচক্রের গোলযোগ হলেই জরায়ুনাশের ব্যবস্থায় পারদর্শী বেশ কিছু হাসপাতাল এই মুহূর্তে দেশের গ্রামেগঞ্জে গজিয়ে উঠছে। ভর্তি সংক্রান্ত চিকিত্সার উপর নির্ভরতা কমালে, নিয়মনীতি মানা হচ্ছে কি না তা দেখভাল ও প্রয়োজনে শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা জোরদার হলে এ ধরনের বিপদ কমানো যেতে পারে।
মনে রাখতে হবে, স্বাস্থ্য ও চিকিত্সা একটি একমুখী, একদেশদর্শী বিদ্যা, যেখানে মানুষের ভূমিকা শুধু গ্রহীতার। সরকারি কর্মসূচি রূপায়ণের ধ্বজা হাতে নিয়ে, যার অসুখ নেই তাকে অসুস্থ বানিয়ে হাসপাতালে ভর্তি, এমনকী অস্ত্রোপচার এ দেশের বেসরকারি অসংস্কৃত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দগদগে ক্ষত। কাজেই এ দিকে নজর দেওয়া আশু প্রয়োজন। এই প্রবণতা আর্থিক ভাবে অ-ফলদায়ী ও অপচয়মূলক। তা ছাড়া, এর প্রভাবে মানুষের মধ্যে সুখ-অসুখের ধ্যানধারণাই পাল্টে যেতে পারে। বেসরকারি হাসপাতাল ও বিমা সংস্থাগুলি নিজেদের খেয়ালখুশি মতো যদি দরকারি কল্যাণ-অর্থ নিয়ে যায়, আর অপ্রয়োজনীয় হাসপাতালীকরণ যদি তার ভিত্তি হয়, তা হলে সমস্যা আরও বাড়বে।
এরই পাশাপাশি সমস্ত জীবনদায়ী সমস্যা সংক্রান্ত খরচকে বিমার মধ্যে আনা দরকার। আর প্রয়োজন বিমার আর্থিক পরিধি বৃদ্ধি। দারিদ্র সীমার নীচে থাকা প্রায় নিরক্ষর, আশীর্বাদ ও দয়া-নির্ভর জীবনে অভ্যস্ত মানুষজনকে হাসপাতালে এনে কল্যাণ করার চেষ্টা জারি থাক। কিন্তু চিকিত্সার অভিঘাতে বিপন্ন বিপর্যস্ত হচ্ছে নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণিও। বিকাশমান বেসরকারি পরিষেবাও এদের টার্গেট করেছে। এক দিকে অনুজ্জ্বল সরকারি পরিষেবার দীন রূপ, অন্য দিকে বিভিন্ন বেসরকারি চিকিত্সা প্রতিষ্ঠানের তরফে বাজারের প্রচার দুইয়ের মাঝখানে পড়ে এরাই সব থেকে বেশি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে থাকেন। চিত্ত আর বিত্তের প্রবল সংঘর্ষে এদের প্রান্তিক অবস্থা ‘উন্নত চিকিত্সা’র দরজায় ক্ষতবিক্ষত হয়। এই প্রান্তিক আর্থিক শ্রেণিকে স্বাস্থ্য সুরক্ষা দেওয়ার আশু প্রয়োজন। সামাজিক নিরাপত্তা, সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আর দেশের বৃদ্ধি-বিকাশের মধ্যে যে সম্পর্ক, তাকে যদি ফলপ্রসূ হতে হয়, তা হলে সুষম ভাবে বণ্টিত ব্যবস্থা দরকার।
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যথেষ্টই ঝুঁকি নিয়ে মার্কিন মুলুকে ‘সংগতিমূলক স্বাস্থ্য পরিষেবা নীতি’ চালু করেছেন। এরই বিরুদ্ধে সে দেশের সমৃদ্ধ স্বাস্থ্যবণিক মহলের ধাক্কায় এ বছরের গোড়ায় সারা আমেরিকা প্রায় দশ দিন স্তব্ধ হয়ে গেছিল। লাগামহীন ঘোড়াকে খুঁটিতে বেঁধে সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য আমেরিকা যখন চেষ্টা করছে ঠেকে শিখে, আমরা এ দেশে ঠিক সে সময় ক্রমাগত লাগাম আলগা করছি। বেসরকারি চিকিত্সা-শিল্পের ধারক ও বাহকরা ক্রমাগত দেশের নানান জনস্বাস্থ্য নীতি নির্ধারণেও শক্তির ভরকেন্দ্র হয়ে উঠছেন, রাজনীতিবিদেরাও প্রভাবিত হচ্ছেন তাঁদের ঠমকে-গমকে। কিন্তু এটা বোধহয় জোর গলায় করা উচ্চারণ জরুরি যে, সরকারি কল্যাণ কর্মসূচির নির্ধারিত অর্থের সদ্ব্যবহারে মানুষের কল্যাণ সরকারি পরিষেবার উন্নয়নের মধ্যে দিয়েই হতে পারে। তাকে ত্যাগ করে কিংবা বিকলাঙ্গ করে যদি কর্মসূচি চলে, তা হলে সুদূরপ্রসারী ক্ষতি হতে পারে।
চিকিত্সক, লিভার ফাউন্ডেশনের সচিব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy